বিল্টমোর এস্টেটে এক পারিবারিক অভিযান: ইতিহাস, শিল্প আর মদের টানে
যখন বিল্টমোর এস্টেটের অটল সিংহদ্বার পেরিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করি, তখন মনে হয় যেন শতাব্দী পেরিয়ে আসা ইতিহাস এক বিশাল প্রাসাদরূপে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। এই আমেরিকার সর্ববৃহৎ বাসভবনটির প্রতিটি প্রাচীর,
রিটন খান
আমরা আটলান্টার বাসিন্দা—দক্ষিণের রাজপ্রাসাদসদৃশ বাড়ির স্থাপত্যে চোখ সওয়া। বারান্দার খোলা জ্যামিতি, সাদা কলাম, আর ছায়াঘন ওকগাছের সুশীতলতা আমাদের প্রাত্যহিক দৃশ্য। তবু অ্যাশভিলের বিল্টমোর এস্টেটের সামনে এসে দাঁড়াতেই বুঝলাম, সত্যিকারের রাজকীয়তা কাকে বলে। ফরাসি রেনেসাঁর ঐশ্বর্যকে অবিকল ধারণ করে জর্জ ভ্যান্ডারবিল্ট ১৮৯৫ সালে নির্মাণ করেছিলেন এই ৮,০০০ একরজুড়ে বিস্তৃত মহাপ্রাসাদটি। শুধু ইতিহাস নয়, এখানে সংস্কৃতির সূক্ষ্মতা আর ওয়াইনের মোলায়েম নেশা মিলেমিশে এক এমন অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে—যা জীবনে একবার না দেখলে যেন কিছু একটা অপূর্ণ থেকে যায়।
বিল্টমোর হাউসের সেই মহাকায় ফোয়ারেতে প্রথম পদক্ষেপেই যেন আমাদের পায়ে আটকে গেল সময়ের চাকা। এক মুহূর্তে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল অতীতের প্রতিধ্বনি—যেন আমরা ঢুকে পড়েছি গিল্ডেড এজ-এর এক দুর্লভ অধ্যায়ে, যেখানে বিলাসিতা ছিল জীবনের ধর্ম আর আভিজাত্য ছিল প্রাত্যহিক নিঃশ্বাস। এই ২৫০ কক্ষবিশিষ্ট প্রাসাদ, যা আজও আমেরিকার বৃহত্তম ব্যক্তিগত বাসভবন, আমাদের চোখের সামনে উদ্ভাসিত করে তোলে ভ্যান্ডারবিল্ট পরিবারের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন, আর সেই সঙ্গে তাঁদের অনুগত কর্মচারীদের নীরব, কিন্তু অপরিহার্য উপস্থিতি।
যখন বিল্টমোর এস্টেটের অটল সিংহদ্বার পেরিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করি, তখন মনে হয় যেন শতাব্দী পেরিয়ে আসা ইতিহাস এক বিশাল প্রাসাদরূপে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। এই আমেরিকার সর্ববৃহৎ বাসভবনটির প্রতিটি প্রাচীর, প্রতিটি অলিন্দ যেন সময়ের খরস্রোতা গাঁথা। আর সেই প্রাসাদেই এবার স্থান পেয়েছে রেনেসাঁ যুগের ইতালীয় চিত্রকলার এক জাদুময় রূপ—‘আলাইভ’ নামের প্রদর্শনী। আলো, রঙ আর সংগীতের যুগলবন্দিতে এই প্রদর্শনী যেন মৃত শিল্পকে নয়, বরং ঘুমন্ত সময়কে জাগিয়ে তোলে।
এই ভ্রমণ ছিল যেন এক পরতে পরতে খোলা ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি, যেখানে প্রতিটি কক্ষ নিজস্ব গল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নীরব অথচ জীবন্ত। অলংকরণে মণ্ডিত ঘরগুলো যেন একেকটি চিত্রনাট্য—উইন্টার গার্ডেন, কাঁচে মোড়া এক সবুজ নীরবতার ঠাঁই, যেখানে আলো পড়ে নিরবধি, আর পাতার ফাঁকে ফাঁকে বাজে অদৃশ্য বসন্তের সুর। ব্যাংকোয়েট হলের দিকে চোখ যেতেই থমকে দাঁড়ালাম—জটিল খচিত গবাক্ষ আর সত্তর ফুট উঁচু ছাদ যেন উচ্চারণহীন বিস্ময়ের আহ্বান জানায়। আর যে পাঠাগার—দশ হাজারের বেশি বইয়ে ঠাসা সে কক্ষটিকে দেখে মনে হল, যেন বইপোকাদের জন্য স্বর্গ দরজা খুলে দিয়েছে।






বিল্টমোর এস্টেটের বাগান ও প্রাঙ্গণ যেন এক সম্পূর্ণ পৃথক জগৎ—যার প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি বৃক্ষ, প্রতিটি ফুল ফ্রেডেরিক ল’ ওলমস্টেডের চিন্তার নিখুঁত রূপান্তর। স্থাপত্য যেমন বিস্ময় জাগায়, তেমনই তার পাশে প্রকৃতির এই সুবিন্যস্ত কবিতা যেন মনে করিয়ে দেয়—মানুষ যখন প্রকৃতিকে ভালবাসে, তখন সে দেবশিল্পীর মতো সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে। আমরা ধীর পায়ে হেঁটে গেলাম ইতালীয় উদ্যানের অলিন্দ ধরে, চোখ জুড়োল সযত্নে রাখা সবুজের প্রান্তরে। হাজারো রঙিন আজেলিয়া ফুলে ভরা সেই আজেলিয়া গার্ডেন যেন এক মৌসুমী আনন্দের বিস্ফোরণ, আর প্রাচীরবেষ্টিত ওয়াল্ড গার্ডেন—ফুলের নকশায় সূক্ষ্মতা আর প্রশান্তির এক নিঃশব্দ অনুরণন—ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়া আমাদের মনে এনে দিল এক গোপন শান্তি, এক অনন্ত বিকেলের স্বপ্ন।
আমাদের সমগ্র সফরের যেন শিখরবিন্দু ছিল ‘আলাইভ’—ইতালীয় রেনেসাঁর সোনালি মুহূর্তকে আধুনিক প্রযুক্তির আলো-ছায়ায় জীবন্ত করে তোলা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। বিল্টমোর এস্টেটের অ্যামহার্স্ট উইং-এ গড়ে তোলা এই অস্থায়ী প্রদর্শনীতে বোত্তিচেলি, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জেলোর মতো শিল্পীস্রষ্টাদের অমর সৃষ্টি—যা আমরা আগে শুধুই বইয়ের পাতায় কিংবা জাদুঘরের নীরব দেয়ালে দেখেছি—এখানে যেন নিজেই এগিয়ে এসে দর্শকের চোখে চোখ রাখে। প্রতিটি শিল্পকর্মের পাশে কিউরেটরের ব্যাখ্যা ছিল এমনভাবে সাজানো, যেন ইতিহাস নিজেই ভাষা খুঁজে পেয়েছে। সেই ভাষা আমাদের ঠেলে নিয়ে গেছে রেনেসাঁর মনের ভেতরে—এক সময়, যখন রঙ, রেখা আর দর্শন মিলেমিশে মানুষকে করে তুলেছিল ঈশ্বরের সমকক্ষ স্রষ্টা।









বিল্টমোর এস্টেটের ওয়াইনারিতে না গেলে যেন সফরটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। একদা যে ইটসাজানো ঘর ছিল দুধের খামার, আজ তা রূপ নিয়েছে সুবাসময় ব্যারেল আর মদ্যসিক্ত আলোয় পূর্ণ এক ওয়াইনের রাজ্য। এস্টেটের নিজস্ব আঙুর বাগানের ফল থেকে তৈরি হয় যেসব মদ, সেগুলোর স্বাদে মিশে থাকে মাটি, ঋতু, আর মানুষের যত্নের দীর্ঘ ইতিহাস। ফ্রি টেস্টিং-এ একের পর এক রেড, হোয়াইট, রোজ ওয়াইনের আস্বাদ নিতে নিতে আবিষ্কার করলাম কিছু অচেনা স্বাদ, যেগুলো হঠাৎ করেই আপন হয়ে উঠল। এরপর নাম লিখিয়েছিলাম ‘ভাইন টু ওয়াইন’ নামে এক ঘনিষ্ঠ ট্যুরে—যেখানে আঙুরের লতা থেকে গ্লাসে ঢালার ক্ষণটি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপকে চিত্ররূপে তুলে ধরা হয়েছিল, যেন প্রতিটি ফোঁটার মধ্যেই ধরা আছে একখণ্ড পরিশ্রম, একরাশ ধৈর্য আর শিল্পসত্তার নিঃশব্দ চুম্বন।
বিল্টমোর এস্টেটের আসল যাদুটা বোধহয় এখানেই—এটি একাধারে সময়ের জাদুঘর, আবার আনন্দের খেলার মাঠ। আমাদের সফরের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্যটিও একবারের জন্যও ক্লান্ত কিংবা বিরক্ত হয়নি, কারণ এস্টেটজুড়ে ছিল শিশু ও পরিবারের জন্য নানা মনোরঞ্জনের আয়োজন—উদ্যানের খোলা জায়গা, ছোটদের জন্য ইন্টার্যাকটিভ এক্সপেরিয়েন্স, এমনকি স্ন্যাক্সে ভরা কোণাও। আর আমরা, বড়রা, নির্ভার হয়ে ডুবে যেতে পেরেছিলাম ইতিহাসের নিঃশব্দ অলিন্দে—একেকটি দেয়াল, একেকটি কারুকাজ যেন খুলে দিচ্ছিল এক একটি যুগের দরজা। বিল্টমোর তাই কেবল চোখের আনন্দ নয়, এটি একসঙ্গে থাকা—বয়স-ভেদে ছড়িয়ে থাকা অভিজ্ঞতাকে এক সুতোয় বাঁধার নাম।









ছোটরা তো যেন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল অ্যান্টলার হিল ভিলেজ ঘুরে দেখে—প্রাসাদের জাঁকজমকের বাইরে এই প্রাণবন্ত কোণাটি যেন বিশেষভাবে সাজানো ছোটদের কল্পনার জন্য। বিল্টমোর হাউস থেকে মাত্র একটুখানি শাটল রাইডেই পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে। খামারঘর, খোলা মাঠ, আর ইন্টার্যাকটিভ প্রদর্শনী—সবকিছু মিলিয়ে শিশুরা যেমন ব্যস্ত থাকে আনন্দে, তেমনই বড়রাও এই জায়গা থেকে এক ঝলক পায় এস্টেটের অন্তরজগৎ—যেখানে কাজ করতেন সেই সব মানুষ, যাঁদের শ্রমে গড়ে উঠেছিল এই প্রাসাদপুঞ্জ।
আমার পরামর্শ, বিল্টমোরকে সত্যিকারের অনুভব করতে চাইলে অন্তত দুই দিন সময় রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। প্রাসাদ, বাগান, ওয়াইনারি, আর নানা প্রদর্শনীর পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা সৌন্দর্য ধীরে ধীরে দেখতে হলে তাড়াহুড়ো নয়, দরকার নির্ভার গতি। সকাল সকাল পৌঁছলে ভিড় এড়ানো যায়, আর বিশেষ অনুষ্ঠান বা ট্যুরের জন্য আগেভাগে টিকিট কেটে রাখলে অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে অনেক বেশি সাবলীল।
আর একেবারে শেষে এসে যেটা সবচেয়ে মনে গেঁথে রইল—বিল্টমোর এস্টেটের ভেতরেই থাকা। ‘ভিলেজ হোটেল’ কিংবা ‘দ্য ইন অন বিল্টমোর এস্টেট’—এই আবাসিক ব্যবস্থাগুলো শুধু আরামের, বরং গোটা এস্টেটের মায়া ও ঐশ্বর্যের মধ্যে আপনাকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলে, যেন আপনি শুধু দর্শক নন, বরং এই প্রাসাদের জীবন্ত অংশ। এখানে থাকা মানে, ইতিহাসের গায়ে গা লাগিয়ে একরাশ নিঃশ্বাস ফেলা।









আমাদের এই পারিবারিক সফর ছিল স্মরণীয়—ইতিহাস, শিল্প আর প্রকৃতির এক নিখুঁত সংমিশ্রণ। বিল্টমোর এস্টেটের এই সফর আমাদের পরিবারের জন্য হয়ে রইল এক অনবদ্য সময়ের কোষাগার—যেখানে ইতিহাস, শিল্প আর স্থাপত্য মিলে রচনা করেছে এমন সব মুহূর্ত, যা বহুদিন পরেও মনে পড়বে সন্ধেবেলার আলোছায়ায়। এই বিশাল এস্টেটের প্রতিটি ইট, প্রতিটি ফুলের বিছানা যেন নিঃশব্দে আমাদের মনে গেঁথে দিল এক নতুনরকম শ্রদ্ধা—মানবসৃষ্ট সৌন্দর্যের প্রতি, যা সময় পেরিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে দীপ্তিময়। ফেরার সময় গাড়ির জানালা দিয়ে ব্লু রিজ পর্বতের অস্পষ্ট রেখা চোখে পড়তেই আমরা বুঝে ফেলেছিলাম—এই সফর শেষ নয়, এই জায়গায় ফিরে আসতে হবে আবার, আর একবার বিস্ময়ের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে।