ফিয়োনা লারকিন-এর কবিতা ‘অ্যাবসেন্স হ্যাজ এ গ্রামার’
শূন্যতার ব্যাকরণ—শোনা যায়, ছুঁয়ে যাওয়া যায় না।
গ্রীষ্মের গা-ঘেঁষে শরতের মুখ, সন্ধেটা তখন হেলসিঙ্কির কাঁপা আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে। রাস্তাগুলো পাথরে মোড়া, আলো লম্বা, বাতাসে যেন বরফগলা চুপচাপ একটা গন্ধ। টুরিস্টের ভঙ্গিতে হাঁটছিলেন না ফিয়োনা লারকিন, হাঁটছিলেন এক আধ-ফাঁকা মায়ের বুক নিয়ে। সঙ্গে পরিবার তো ছিল—তবু ছিল না। ঘরের সবচেয়ে নরম সুরটা, ছেলেটা অ্যালেক্স, ঠিক তখনই রওনা দিয়েছে ব্রিসবেনের দিকে। একটা নিঃশব্দ বিদায়ের দাগ লেগে ছিল তার ছায়ায়, যেন কারো কণ্ঠস্বর—শোনা যায়, ছুঁয়ে যাওয়া যায় না।



ফিনিশ ভাষাটা যেন কোনো ভূতের কেতাব—অদ্ভুত এক যুক্তি, অলক্ষ্য স্তর, স্তব্ধ ব্যাকরণ। ফিয়োনার মনে আগেই তার ছায়া লেগে গেছে। এই ভাষা অভাবকে ধরে রাখে নিয়মে, অনুপস্থিতিকে দেয় কাঠামো, শোককে বাঁধে ব্যাকরণে। এমনকি নামের গড়ন বদলে যায়—কে নেই, কী নেই, তাও ভাষা দিয়ে প্রকাশ পায়। কী এক বিষণ্ন অথচ বিস্ময়কর চিন্তার স্থাপত্য!
এইভাবেই—অনুপস্থিতির গর্ভে, প্রত্যয় আর শীতল বাতাসের ভেতর থেকে, আর জুম স্ক্রিনে দুলে ওঠা এক উষ্ণ ছায়ার মিশ্র আলো-আঁধার থেকে জন্ম নিল তার কবিতা—শূন্যতার ব্যাকর’। ওটা কেবল লেখা নয়, ওটা যেন ফিসফিসে এক সন্ধি—ভাষা আর ভালোবাসার মাঝে, বিদায় আর স্মৃতির মাঝখানে। যেন বাল্টিক জলের গায়ে আলো ঝিকমিক করে ওঠে—তেমন এক কবিতা, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়, মস্তিষ্কের গভীরেও বাজে, আর হৃদয়ের অতলেও।
বিচারকেরা—রোমালিন অঁতে, জন ম্যাকঅলিফ আর স্টিফেন সেক্সটন—এই কবিতাটিকে শুধু “স্পর্শকাতর” বলে থেমে থাকেননি। তাঁদের চোখে, এটি এমন এক সৃষ্টি যা নিজের স্তরেই নিজেকে উদ্ঘাটন করে। অসংখ্য কবিতার ভিড়ে বিচার-প্রক্রিয়াটাকেই তাঁরা তুলনা করেছেন তুষারচাপায় চোখ ধাঁধানোর সঙ্গে—সব যেন একাকার, যতক্ষণ না এই একা কণ্ঠস্বর, যেন সাদা সমতলে একা দাঁড়িয়ে থাকা গাছ, নিজের অস্তিত্বের দাবি জানায়। ফিয়োনার কবিতা আত্মপ্রচারে নয়, বরং শেখাতে জানে, পথ দেখাতে জানে, পাঠককে যেন আহ্বান জানায়—ছড়িয়ে থাকা প্রত্যয়গুলো থেকে যেমন গড়ে ওঠে এক-একটি বাক্য, তেমন করেই গড়ে নিতে নিজের মানে।
তাঁরা মুগ্ধ হয়েছেন এই দ্বৈত কণ্ঠস্বরের জাদুতে—একদিকে মায়ের অন্তরঙ্গ কোমলতা, অন্যদিকে ভাষাবিদের শৃঙ্খলিত নির্ভুলতা। ফিয়োনা যেন এক শিক্ষক, যিনি ফিনিশ শব্দগুলো উচ্চারণ করেন নিখুঁত যত্নে, আবার তেমনি এক মা, যিনি আজও সন্তানের অবয়বটা মনে ধরে রাখেন—ছায়ার মতন, স্পর্শহীন অথচ অমোচনীয়।
“আমি বিস্ময়ে আর আনন্দে অভিভূত,”—পরে বলেছিলেন ফিয়োনা। যদিও তার কণ্ঠে ছিল সেই বিনয়, যা আসে প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে অভ্যস্ত একজন মানুষের মুখে—ফেরত আসা কবিতার খামে, না খোলা স্বপ্নের ভিতরে জমা থাকা দীর্ঘ নৈঃশব্দ্যে। তবু, ঠিক যেন ফিনিশ ‘সিসু’ ধারণার মতো—ভিতর পর্যন্ত গাঁথা এক নীরব, অনমনীয় জেদ—তিনি লিখেছিলেন, পাঠিয়েছিলেন, আর বিশ্বাস করে গিয়েছিলেন।
কবিতার পথে ফিয়োনার যাত্রা শুরু থেকেই ছিল নিঃশব্দ সাফল্যের ধারা। ২০২৩-এ পিনড্রপ প্রেস থেকে প্রকাশিত Rope of Sand—তার প্রথম পূর্ণ সংকলন—বালুকণার ভিতরে ধরে রেখেছিল মরু-হাওয়ার নিস্তব্ধতা আর সম্পর্কের ভঙ্গুরতা। তার আগের প্যামফলেটগুলো—Vital Capacity কিংবা A Dovetail of Breath—ইঙ্গিত দিয়েছিল শরীরের ভঙ্গুর ভাষা, নিঃশ্বাস আর উচ্চারণের সংযোগস্থলে জন্ম নেওয়া কবিতার, যেখানে হাওয়ার ভেতরেই রয়ে যায় কথা।
এবং এখন, ফিয়োনা লারকিন—লন্ডনে জন্ম, আইরিশ অভিভাবকের কন্যা, কবি, মা, আর ছিন্নভিন্ন পঙ্ক্তির যত্নবান সংগ্রাহক—শূন্যতার ভিতরেই খুঁজে পেয়েছেন এক ব্যাকরণ, যা ব্যক্তিগত হয়েও সকলের ভাষায় কথা বলে।
অপটু কারও হাতে এ কেবল একখানা রিপোর্ট হয়ে উঠত। কিন্তু ফিয়োনার কাছে, আর তাদের কাছে যারা পাঠ করে মনপ্রাণ মেলে, এই মুহূর্তটি ছিল কবিতার নিজস্ব স্বরূপের নির্ভুল প্রমাণ—অব্যক্তের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ স্থাপত্য।
শূন্যতার ব্যাকরণ
ফিয়োনা লারকিন
আমি শিখছি অনুপস্থিতির ব্যাকরণ—
যেন আমি একজন ফিনিশ ভাষী,
কোন কিছুর না-থাকাকে বোঝাতে,
যা এতটাই মিশে আছে আমার অস্তিত্বে
যে তার অনুপস্থিতিই এক ধরনের স্থাপত্যভঙ্গ।
উপসর্গ -ত্তা একটি শব্দকে
নিজের ছায়া করে তোলে।
তার ভিতরের নির্যাস গলে যায়,
আর সেই ফাঁকা খোলের ভিতর
হাওয়া বয়ে যায় আলোর মতো।
আমার মনে পড়ে চাঁদের আলো—
কোস্কেনকোরভা—
ফিনিশদের জাতীয় মদ,
একবার যখন বোতলটা ফাঁকা হয়ে যায়,
তখন তারা ডাকে তাকে—
কোস্কেনকোরভত্তা।
মানে—যা নেই,
আমি ডাক দিই, ছুঁড়ে দিই আকাশে—
কোস্কেনকোরভত্তা!
Itkin syyttä—মানে,
‘আমি কাঁদলাম অকারণে।’
কিন্তু যখন সন্তান দূরে থাকে,
তখন তো অকারণেরও এক গহীন অর্থ জন্মায়।
এই রাতে আমি কাঁদলাম—
Itkin syyttä।
যদি আমি পুত্র শব্দটির সঙ্গে জুড়ে দিই -ত্তা,
তাহলে সে নিজেই টেনে আনে এই লেখাকে—
না, এটি কোনও সনাটা নয়,
নয় কোনও সনেটও,
তবু এটিও এক রকম সুর,
অভাবের, আকুতির।