সেই যে এক কালে বাবার হাতে চুড়ি পরা হত, এখন আমরা নিজেরাই মাথায় দোল পরিয়ে ঝাঁপ দিচ্ছি ডিজিটাল ফুলবাগানে। আর ফল কী? ইনস্টাগ্রামে পপি-সেলফি। ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়াকার ক্যানিয়নে ফোটে এক দুর্দান্ত কমলা রঙের সুপারব্লুম—ভেবেছিলাম প্রকৃতির প্রেমিকেরা খুশি হবে। কিন্তু প্রেমিকেরা এল না, এল ‘ইনফ্লুয়েন্সার’। মোবাইল ক্যামেরা হাতে এক ২৪ বছরের ডিজিটাল দেবী, দুটো পপির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ক্লিক করলেন দু’খানা সেলফি। ব্যাস, #superbloom হয়ে উঠল দিগ্বিজয়ী মন্ত্র। পপিগুলো মরে গেল, কিন্তু ইনস্টাগ্রাম অমর।
নিকোলাস কার-এর বই Superbloom এই ‘সেলফি সভ্যতা’র অন্তর্বর্তী অস্থিরতার কাব্য। না, ছন্দে না, সংকটে। বইয়ের সূচনা যেন হরলিক্স-এর বিজ্ঞাপন হলেও পরিণতি শুদ্ধ রেডিও অ্যাকটিভিটিতে গিয়ে পৌঁছেছে—অর্থাৎ আধুনিক মিডিয়া ব্যবস্থার ধ্বংসযজ্ঞ।
কারের কলমে রেডিওর ইতিহাস এক মহাকাব্য: যখন জাহাজ ‘টাইটানিক’ বরফের চুম্বনে ছিন্নভিন্ন, তখন রেডিও তরঙ্গে ভেসে এল ভুয়ো খবর—‘সব ভালো আছে, আমরা হ্যালিফ্যাক্স যাচ্ছি’। মার্কিন কংগ্রেস ধড়মড় করে রেডিও অ্যাক্ট ১৯১২ পাস করল। কিন্তু আজকের ট্যুইটার-ঝড়ে কে কাকে আটকাবে? কার বলছেন—একসময় যেভাবে রেডিওর ‘ফ্রিকোয়েন্সি’ গোছাতে সরকার হস্তক্ষেপ করেছিল, তেমনি ৯০-এর দশকে ইন্টারনেটের ‘অ্যাপ স্টোর’ খুলে না দিয়ে দরজা আটকে রাখা উচিত ছিল।
কিন্তু না। তখনকার বাতাসে ছিল বিজয় উল্লাস: সোভিয়েত পড়ে গেছে, সিলিকন ভ্যালি দাঁড়িয়ে গেছে। তাই ‘টেলিকমিউনিকেশনস অ্যাক্ট ১৯৯৬’ পাশ করে, কংগ্রেস নিজেদের হাত ধুয়ে বলল, “বাজারই সব ঠিক করে দেবে।” এই বাজার-ভক্তরা বিশ্বাস করলেন, “মেইলম্যানে যতখানি পিয়ন ততখানি গোয়েন্দা”—কারণ Gmail তখনই জানিয়ে দিয়েছিল, “আমরা সব পড়ব, পড়তেই থাকব।”
আর সোশ্যাল মিডিয়া? ওদের ঠ্যাঙ ছুঁয়ে ধন্য হও। সেকশন ২৩০ একদিকে প্ল্যাটফর্মদের বলে, “তুমি কাউকে চাইলেই ব্লক করতে পারো, চাইলে পোস্ট মুছে দিতে পারো, এমনকি সংবিধান যতই ঘ্যানঘন করুক”—অন্যদিকে আবার বলছে, “তুমি কিছুতেই দায়ী হবে না!” এমন আইনের পৃষ্ঠপোষকতায় জন্ম নেয় এক ‘সোশিওপ্যাথিক সোস্যালাইজেশন’। লোকজন এখন অতি ব্যস্ত, অথচ একা; ভার্চুয়াল বন্ধু পায়, বাস্তবের ঠোঁট খোলে না।
কারের লেখায় ক্ষোভের সঙ্গে থাকে স্নায়ু, একটা অসহায়তার সুর। তিনি বলেন, আমরা যা করছি, তা আসলে নিজেকে মুহূর্তে মুহূর্তে স্ক্রিনে খোদাই করে চলা। নিজেদেরই ক্লোন বানাচ্ছি, যেন আত্মার লাইভ টেলিকাস্ট। আমরা আগেও বন্ধু খুঁজতাম, এখন ফলোয়ার খুঁজি।
এই সংযমহীন প্রযুক্তিপুজার বিরুদ্ধে কারের প্রস্তাব frictional design—মানে সোশ্যাল মিডিয়া একটু ধীর করো, পোস্ট দেওয়া যেন মোবাইলে মাখন না হয়, একটু ঘষাঘষি লাগুক। কিন্তু তিনিই বলেন, দেরি হয়ে গেছে। ডিজিটাল ছাঁচ এত গভীরে ঢুকে গেছে যে, সমাজই এখন এক ‘সার্ভার ফার্ম’।
তার পর আসে শেষ পাঁজর-ভাঙা হাসির গল্প—মার্ক অ্যান্ড্রেসেন বলছেন, “AI মানুষকে আরও মানবিক করে তুলবে।” কবিতা লিখবে, প্রেমিক সাজবে, ক্যানসার পেশেন্টকে ‘ধৈর্য্য ধরো’ বলবে। শুনলেই যেন মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ আর চানাক্য মিলে WhatsApp গ্রুপ খুলেছে।
কার চিৎকার করে বলছেন, “ওরা যেন দয়া করে আগে প্রমাণ করে, তারপর যেন পৃথিবী রক্ষা করতে আসে।” আর যদি না পারে? তাহলে AI বটদের একটা করে শবদাহের জন্য মাইকেল স্কফিল্ড টাইপ ‘ডিজিটাল কারাগারে’ পাঠানো হোক।
শেষ কথা?
পপি ফুল আর পোস্টের ভিড়ে আমরা আসলে হারিয়ে ফেলেছি কীভাবে কথা বলা যায়। একসময় শব্দ ছিল আবেগের বাহন, এখন শব্দের পিঠে চড়ে আসে নেটওয়ার্ক ল্যাটেন্সি। কার আমাদের বলেন, “তখনও দেরি হয়ে যায়নি, যদি এখন নিজেকে পাল্টাই।” কিন্তু নিজের স্ক্রিন-প্রেমে আমরা এতটাই বিভোর যে পাল্টানোর আগে দরকার একটা ভালো WiFi সিগনাল।
নইলে আত্মার ওএস আপডেট হবে না।
আর আমরা থেকেই যাব #superbloom এর সেলফি-পোজে।
আলোচিত বইঃ
Superbloom: How Technologies of Connection Tear Us Apart
Nicholas Carr
New York, NY: W.W. Norton, 2025.