চ্যাটজিপিটি-পরবর্তী এই আঠারো মাসের গল্প শুনলে বোঝা যায়, ভাষার জগতে নীরবে এক সুনামি বয়ে গেছে—এমনকি বক্তারাও টের পাননি যে তাদের বাক্যভঙ্গি বদলে গেছে। জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের গবেষকরা ২৮০,০০০ একাডেমিক ইউটিউব ভিডিও খুঁটিয়ে দেখে আবিষ্কার করেছেন, “meticulous,” “delve,” “realm,” “adept”—এই জাতীয় শব্দ আগের তুলনায় ৫১% বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। যেন AI মডেলের ভাষাগত পছন্দের শব্দরা বক্তাদের কণ্ঠে এমনভাবে ঢুকে গেছে, যার বিরুদ্ধে বক্তার নিজেরই কোনো ইমিউন সিস্টেম নেই। সবচেয়ে নজরকাড়া ছিল “delve”—যেটা এখন একাডেমিয়ায় এমন এক পাসওয়ার্ডে পরিণত, শোনা মাত্র বোঝা যায়: এখানে চ্যাটজিপিটির পায়ের ছাপ আছে। গবেষক হিরোমু ইয়াকুরার ভাষায়, আমরা নিজের অজান্তেই এক ভার্চুয়াল ভোকাবুলারি আমদানি করেছি। তবে এটি কেবল AI-এর শব্দ মেনে নেওয়া নয়—বরং প্রশ্ন, আমরা হঠাৎ কেন সেটা মেনে নিতে শুরু করলাম? গবেষণার পরের অনুমান হলো, প্রভাব শুধু শব্দচয়নে নয়, কণ্ঠস্বরেও ছড়িয়ে পড়ছে: বাক্য হচ্ছে দীর্ঘতর, গঠন হচ্ছে বেশি টাইট, আবেগ প্রকাশে আসছে সংযম।
AI-এর প্রভাব আরও স্পষ্ট স্মার্ট রিপ্লাই, অটোকরেক্ট, স্পেলচেক ইত্যাদিতে। কর্নেল ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্ট রিপ্লাই ব্যবহারে ব্যবহারকারীরা নাকি বেশি “পজিটিভ” শব্দ বেছে নেন, ফলে চ্যাটে সহযোগিতার মাত্রা বাড়ে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে—যদি মনে হয়, আপনার সঙ্গী AI ব্যবহার করছে, তখনই আপনি তাকে কম সহযোগিতা করতে শুরু করেন। মানে, বাস্তবে AI ব্যবহার নয়—AI ব্যবহারের সন্দেহই সম্পর্কের ভেতরে অবিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয়।
এখানেই ঢুকে পড়ছে বড় প্রশ্ন—আমাদের লেখালেখিতে AI ঢোকার ফলে আমরা হারাচ্ছি মানবিক সংকেতের তিনটি স্তর। প্রথমত, দুর্বলতার সংকেত—যা প্রমাণ করে “আমি মানুষ”। দ্বিতীয়ত, মনোযোগ ও প্রচেষ্টার সংকেত—যা বলে “আমি এতটাই পরোয়া করি যে নিজে লিখেছি”। তৃতীয়ত, সক্ষমতার সংকেত—যা প্রকাশ করে আমাদের রসবোধ ও দক্ষতা। প্রফেসর মর নামানের মতে, AI-নিয়ন্ত্রিত যোগাযোগকে সত্যিকার অর্থে মানবিক রাখতে হলে এই সংকেতগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে—না হলে চিন্তা ও প্রকাশের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
অবিশ্বাস আরও বাড়ে, যখন বোঝা যায়, AI নির্ধারণ করছে কোন ভাষা “বৈধ” মানে সঠিক শোনাবে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের গবেষণায় ধরা পড়েছে, স্ট্যান্ডার্ড আমেরিকান ইংরেজি ছাড়া অন্য উপভাষা এলে AI হয় সেটিকে না বোঝার ভান করে। এটি শুধু ভাষার ক্ষতিই করে না—একটি ভুল ধারণা পাকাপোক্ত করে যে, “সঠিক ইংরেজি” বলতে কেবল আমেরিকান ইংলিশ। অথচ কথার হোঁচট, আঞ্চলিক বাগধারা, সামান্য বেখাপ্পা গঠনই তো মানবিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার আসল সাইনবোর্ড।
আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি দুই প্রান্তে—একদিকে পেশাগত ভাষা, অন্যদিকে ব্যক্তিগত কথায় ব্যক্তিগত রং। মাঝখানে তিনটি টানাপোড়েন: (১) কিছু মানুষ সচেতনভাবে AI-এর মতো না শোনানোর চেষ্টা করবে, (২) AI হয়তো ভবিষ্যতে আরও অভিব্যক্তিপূর্ণ হবে, (৩) আসল বিপদ—নিজের চিন্তা ও প্রকাশের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানো। প্রশ্নটা AI আমাদের ভাষা বদলাবে কি না, তা নয়—কারণ বদলাবে-ই। প্রশ্নটা হলো—আমরা কি সচেতনভাবে সেই জায়গা রক্ষা করব, যেখানে কথার খামখেয়ালিপনা আর আবেগের অগোছালো প্রবাহ এখনো প্রমাণ করে, হ্যাঁ, এটা মানুষ বলছে বা লিখছে।