একজন বোকা মানুষের জীবনী
আত্মহত্যার চিঠিতে তিনি ক্ষমা চাইছেন। যেন এক ফেসবুক পোস্ট, যেখানে লেখক বলছে, "ভাইরা, বোনেরা, আমি জানি, আমি একটা ফালতু বাবা, ছেলেমেয়েরা আমার জন্য ট্রমা পাবে, কিন্তু ভাই, ইহলোকের পেটব্যথা সহ্য হয় না, ত
রিউনোসুকে আকুতাগাওয়া আত্মহত্যা করেছিলেন—এই বাক্যটায় যেমন একটা নিরেট তথ্য আছে, তেমনি আছে একটা সাংঘাতিক রকমের মেলোড্রামা। আমাদের দেশে হলে এই গল্পটা ‘রূপমঞ্জরী’ টাইপের টেলিভিশন সিরিয়ালের ট্র্যাজেডি হয়ে যেত। কিন্তু ওটা জাপান। সেখানে আত্মহত্যা একটা শিল্প। আত্মপতনের সময়েও কীভাবে অ্যাংল-সেক্সন সাহিত্য ও বাইবেলকে বালিশ বানিয়ে ঘুমিয়ে পড়া যায়, সে কায়দাটা সম্ভবত কেবল আকুতাগাওয়ার পক্ষেই সম্ভব ছিল। বয়স? পাঁচত্রিশ। মানে, আমাদের বাঙালি সাহিত্যিকদের তুলনায় তখনও চারটে সেমিনার, দুটো ইউনিভার্সিটি লেকচার, আর একটি মধ্যবয়সী লেখিকাকে ‘সাহিত্যিকী’ আখ্যা দেওয়ার পূর্ণ অধিকার পাননি।
এই লোকটা কী করেন জানেন? যিশুকে নিজের মতো করে লিখতেন। একজন 'অটোবায়োগ্রাফিকাল ক্রাইস্ট'—যিনি নাকি পৃথিবীর সব মানুষের মনের কথা জানেন, নিজেরটা ছাড়া। শুনে মনে হবে স্যর, আপনাকে পত্রভারতীতে লেখা দিতে বললে এত মিনমিন করছেন কেন? নিজেই তো বলছেন আপনি 'সবার মনের কথা' জানেন। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, তিনি যে নিজের ভেতরে তাকাতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ যদি ভেতরে কিছু একটা পাওয়া যায়? যদি সেটা একটা অভিযোগ হয়? যদি সেটা বলে, "বাছা, তুই খালি আত্মা আত্মা করছিস, কিন্তু তোকে কেউ অ্যাকচুয়ালি বোঝে না"?
মৃত্যুর আগে তিনি লিখেছেন ‘Note to an Old Friend’—একটা সুইসাইড নোট, যা পড়লে কারও কারও মনে হতে পারে, এ তো অলরেডি একখানা ছোটগল্প। তাতে তিনি লিখেছেন, "আত্মহত্যাকারীরা বেশিরভাগ সময়েই জানে না তারা কেন মরছে"—এই জায়গাটায় এসে আমাদের বাংলা মাধ্যমের 'ফিলোসফি অনার্স' মুখ খিঁচিয়ে বলে ওঠে, "এ তো হ্যামলেট বলেছে আগে!" হ্যাঁ, কিন্তু হ্যামলেট করেছিল এক্সকিউজ। আকুতাগাওয়া এটা করছেন এক্সপ্লানেশন।
তাঁর ‘মান অফ দ্য ওয়েস্ট’ বলে একটা লেখা ছিল, যেখানে যিশু একাধারে লেখক, সেলফ ডিলিউশনিস্ট এবং একলা মানুষের প্রতিমা। ভাবুন একবার—নিজের গল্পে নিজেরই ‘ক্রাইস্ট’ বানিয়ে, তারপর সেই যিশুর গলায় দিয়ে দিচ্ছেন নিজের মানসিক অস্থিরতার নোট। আধুনিক জাপান যে সময়ে পশ্চিমা টুপির নিচে খোঁচা খোঁচা জাত্যভিমান গুঁজে রাখছিল, আকুতাগাওয়া তখন ক্রাইস্টকে কোর্টজিয়ানে পরিণত করে লিখছেন ভেতরের সব পরকীয়া, পারানইয়া, আর পাপবোধ।
মাথা খারাপ হতে শুরু করেছিল তাঁর। মানে সেইভাবে, যেভাবে আমাদের এখানে কেউ ‘ওই মেয়েটা একটু সেনসিটিভ’ বললেই ধরে নিতে হয়, সে নিশ্চয় প্রেমে খারাপ খেয়েছে, কবিতা লেখে আর ব্ল্যাক কফি খায়। কিন্তু আকুতাগাওয়ার মাথা খারাপ মানে সে সময়ের টোকিওর একটা পার্মানেন্ট সাবওয়ে দুর্ঘটনা। হ্যালুসিনেশন হতো। মাইগ্রেন হতো। স্ত্রী হঠাৎ দেখতেন, লেখক শোবার ঘরের দেওয়াল আঁকড়ে ধরে বসে আছে—বিশ্বাস করছে ঘরটা ধসে পড়বে। বলার মতো দুঃখ, অথচ হাসির মতো নাটক।
শেষ জীবনে আকুতাগাওয়া I-novel লিখতে শুরু করেন। মানে আজকালকার ‘অটোফিকশন’। সে সময় এর মানে ছিল, আপনি কতোটা ‘অপছন্দনীয়’ চরিত্র লেখার সাহস রাখছেন। অর্থাৎ, আপনি কতোটা নিজের পচা রোমাঞ্চকে ঠোঁটের নিচে রেখে ফেলতে পারেন। তাঁর ‘The Life of a Stupid Man’ পড়ে মনে হয়, লোকটা নিজেকে নিয়ে মজা করতে পারতেন। কিন্তু মজাটা ছিল ম্যাজেন্টা রঙের বিষণ্ণতা দিয়ে মোড়া। যেমন তিনি এক জায়গায় লিখছেন, তাঁর প্রিয় শিক্ষক মারা গেছেন, এবং তিনি "pain close to joy" অনুভব করছেন। মানে এটাও এক ধরনের orgasmed guilt।
আত্মহত্যার চিঠিতে তিনি ক্ষমা চাইছেন। যেন এক ফেসবুক পোস্ট, যেখানে লেখক বলছে, "ভাইরা, বোনেরা, আমি জানি, আমি একটা ফালতু বাবা, ছেলেমেয়েরা আমার জন্য ট্রমা পাবে, কিন্তু ভাই, ইহলোকের পেটব্যথা সহ্য হয় না, তাই সামান্য স্বস্তির আশায় বিদায় নিচ্ছি।"
তাঁর শেষ ক'টা লেখায় যেমন ‘Spinning Gears’, চোখে দেখি চক্রাকারে ঘুরছে গিয়ারের মতো হ্যালুসিনেশন, কানের পাশে ফিসফিস করে পবিত্র আতঙ্ক। গিয়ার নয়, যেন হেজ্জীকেল-এর দেবদূতের ডানা। তার মাঝেই তিনি ক্রমাগত প্রশ্ন তুলছেন, শিল্পের মানে কি শুধু সৌন্দর্য? শিল্প কি ব্যথাকে ব্যবহার করতে পারে? করতে পারলে সেটা আর্ট না নিছক ক্যানিবালিজ়ম?
আকুতাগাওয়ার ‘Hell Screen’-এর মতো গল্পগুলো যেন আত্মজৈবনিক নির্যাতনের ড্রাফট। একজন চিত্রকর আগুনে পোড়া দৃশ্য আঁকতে গিয়ে নিজের মেয়েকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলছে—আজ্ঞে হ্যাঁ, একবারে প্রতীকী নয়। সেই ছবি অসামান্য হয়ে উঠছে, এবং সেই শিল্পী আত্মহত্যা করছেন। শিল্পের জন্য যা-ই হোক, মেয়ে তো পুড়ে গেছে!
শেষ অব্দি আকুতাগাওয়া বোঝাতে চেয়েছিলেন—যাঁরা বেশি বোঝেন, বেশি অনুভব করেন, তাঁরা নরক-প্রাপ্তির প্রথম সারির টিকিটধারী। তিনি লেখেন, “আমি পৃথিবীর চেয়ে বেশি বুঝি, তাই আমার দুঃখগুলো বেশি”। নিজেকে ঈশ্বর বানাতে চেয়েছিলেন? সম্ভবত। শেষ চিঠিতে লিখছেন, "Empedocles-এর জীবন পড়ে বুঝলাম, নিজেকে দেবতা বানানোর বাসনা বহু পুরনো।"
তারপর টোকিওর অলিগলিতে একা ঘুরে বেড়িয়েছেন, মাথায় গিয়ার ঘুরেছে, ভেতরে আত্মপোড়ার ছাই জমেছে। 'Inferno' পড়া ডান্তের মতো, হেঁটেছেন নিজস্ব নারকে। শেষে বলেছিলেন, “হে ঈশ্বর, আমি তোমার শাস্তির প্রার্থনা করছি।” পাঠকের মনে তখন শুধু একটা প্রশ্ন: শাস্তি কে দিল? ঈশ্বর, না নিজের সেই অতিরিক্ত অনুভবশক্তি?
আকুতাগাওয়ার ‘Note to an Old Friend’ পড়লে মনে হয়, যেন কেউ simultaneously নিজেকে ঈশ্বরও ভাবছেন, আবার সেই ঈশ্বরের বিরুদ্ধেও মামলা করতে চাইছেন। তাঁর শেষদিককার লেখায় ছিল যে নির্মোহ স্বীকারোক্তি—"লিখছি, কারণ কিছু না লিখলে আমি নিজেকে মারব”—তা কি শুধুই ট্রাজেডি? নাকি একমাত্রিকভাবে গভীর?
নাকি এ-ও হতে পারে, ফেসবুক থাকলে আজ তিনি লিখতেন, “আজ আর লিখতে পারলাম না। মাথায় পোকা ঘুরছে। Mozart-এর Symphony No. 40 চালিয়ে কান্না পেল।”
তারপর হয়তো ট্যাগ করতেন: #FeelingLikeAGear #InfernoIsAStateOfMind
আপাতত প্রশ্ন একটাই—এই গিয়ারের ঘূর্ণনে, আমরা যে-কোনো একজনের চৈতন্যে ঢুকে লিখছি না তো? আপনি তো নন, তাই তো?