আমেরিকা-চীন বাণিজ্যসম্পর্ক এখন ফুটন্ত কড়াইতে। ট্রাম্প প্রশাসনের একতরফা শুল্ক আরোপ একপ্রকার বাণিজ্যযুদ্ধের ঘোষণা, তবে সেটির যুক্তি যেন পুরনো খোলসে নতুন তেল। চীনের প্রভাব ঠেকানো—এই ছিল শুরুর বুলি, কিন্তু কোথায় কীভাবে শুল্ক আরোপ হচ্ছে, তার কোনও সুস্পষ্ট নকশা নেই। ফলে বিনিয়োগকারীরা দাঁড়িয়ে থাকেন—না জলের পাড়ে, না নৌকায়। শুল্ক কখনও ১০০ শতাংশ পেরোয়, তো চীন পাল্টা দেয়—জরুরি জিনিসের সরবরাহ বন্ধ করে। এ কী রণনীতি, না কি নিজের পায়ে কুড়াল?
এই অস্থিরতা শুধু লগ্নিকারীদের মাথাব্যথা নয়, বরং তা আমেরিকার বৃহত্তর শিল্পনীতি ও বৈদেশিক কৌশলের দুর্বলতা উন্মোচিত করছে। বিনিয়োগের হিসাব কষতে গিয়ে কর্পোরেট আমলারা আজ দিশেহারা। প্রশ্ন উঠছেই—এই যুদ্ধ যদি শেষমেশ আমেরিকার নিজের বিপর্যয়ে গিয়ে ঠেকে, তবে ইতিহাসে এর নাম লেখা হবে কী? নাকি একে ডাকা হবে আধুনিক কালের সবচেয়ে দামী ভুল হিসাব?
ওয়াশিংটনে এখন এক অদ্ভুত একমত দেখা যাচ্ছে—চীন মানেই শত্রু। রিপাবলিকান-ডেমোক্র্যাট মিলেমিশে এক ছাদের নিচে বাস করছেন ‘বাণিজ্য-বিপদ’-এর ভূত নিয়ে। শুরুটা করেছিলেন ট্রাম্প, আর এখন সেই গানের সুর ধরেছেন ডেমোক্র্যাটরাও—চীন যেন বিশ্ববাণিজ্যের এক সুবিধাভোগী চোর, এমন একখানা ছবিই আঁকা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই একমতের ছায়ায় কি আমেরিকার চোখে ধাঁধা লেগে গেছে?
চীনের বর্তমান চালচিত্র বোঝার বদলে আমেরিকা যেন অতীতের ভুলগুলো নিয়েই ব্যস্ত। যেন পুরনো প্রেমিকার চিঠি পড়ে বর্তমান সংসার চালাতে চাইছে। হালে পানি পায় না। এই যে চীনের প্রযুক্তিগত ও কূটনৈতিক উত্থান—সেটা ঠেকাতে যে কৌশল দরকার, তা আমেরিকার হাতে নেই বলেই অনেকে বলছেন।
আমার মনে হয়, আমেরিকার নীতিগুলো এখনো টাইপরাইটার যুগে আটকে আছে—যেখানে চীনের আজকের প্রেক্ষাপট ‘AI + supply chain + statecraft’ দিয়ে লেখা হচ্ছে। অথচ আমেরিকার দৃষ্টি এখনো উইন্ডোজ ৯৫-এর পপআপে আটকে আছে।
আমেরিকা-চীন সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার ঘন্টা বাজছে—একটা নয়, যেন পুরো ক্যারিলিয়ন। আমি মনে করি, আমেরিকা চীন-নীতি নিয়ে এমন এক বিপজ্জনক ভুলপথে হাঁটছে, যার শেষপ্রান্তে হয়তো শুধু কুয়াশা, নয়তো খাড়া খাদ। কোভিড মহামারি সেই দূরত্বকে আরও দীর্ঘ করেছে—ব্যবসায়ী, ছাত্র, গবেষকরা চীন ছেড়েছেন, সংযোগ ছিঁড়েছে, ভুল বোঝাবুঝির বীজ আরও গভীরে গেঁথেছে।
ওয়াশিংটনের এই সম্মিলিত ‘সহমত’—যেটাকে অনেকেই কূটনৈতিক ঐক্য ভাবছেন—আসলে একধরনের প্রতিধ্বনি-কক্ষ (echo chamber)। এখানে কেউ প্রশ্ন তোলে না, শুধু হাততালি পড়ে। ফলে নীতিনির্ধারকরা এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, যা শুনতে ‘দেশপ্রেমিক’, কিন্তু বাস্তবে ঝুঁকিপূর্ণ ভুল হিসাব।
এমন এক সময়ে প্রয়োজন এমন কণ্ঠস্বর, যারা সাহসের সঙ্গে বলবে—এই আক্রমণাত্মক অবস্থান হয়তো সবচেয়ে ফলপ্রসূ বিকল্পগুলোকে ছায়ার আড়ালে ফেলে দিচ্ছে। ভাবো, যদি পারস্পরিক সহযোগিতা হতো মূলমন্ত্র, যদি প্রতিযোগিতা হতো বোঝাপড়ার ভিতের ওপর, তবে কী হতো না এক অন্য রাজনৈতিক কাব্য?
অনেক আমেরিকান এখনো ভাবেন—চীন নাকি শুধু কপি করে, নতুন কিছু তৈরি করতে পারে না। যেন তারা বিশ্বাস করে চীন মানে এক বিশাল ফটোকপি মেশিন, যার কাজ শুধু আমেরিকার ব্লুপ্রিন্ট নকল করা। অথচ বাস্তব বলছে একেবারে উল্টো কথা। চীন আজ নতুনত্বের হাব, একেবারে পরিণত রূপে—not just a follower, but a frontrunner।
ইলেকট্রিক যান থেকে শুরু করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি—চীন এই খাতে এত দ্রুত ও গভীর গতিতে এগিয়েছে যে, পুরনো খেলোয়াড়দের হারিয়ে দিয়ে এখন নতুন খেলার নিয়ম তৈরি করছে। হুয়াওয়ের মতো সংস্থাগুলো আর কেবল ‘ফোন’ তৈরি করছে না—তারা প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ লিখছে। নতুন নতুন ইভি নির্মাতা তো যেন প্রতিটি শো-রুমকে রিসার্চ ল্যাব বানিয়ে ফেলেছে।
চীনের শহুরে পরিবহন ব্যবস্থায় যে পরিমাণ ডিজিটাল সমন্বয় ঘটেছে, তা শুধু চমকপ্রদ নয়, বরং আমেরিকার স্বস্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগী মনোভাবের ওপর সরাসরি এক চ্যালেঞ্জ। তাদের শিল্প-পরিকাঠামো এত দ্রুত বদলাচ্ছে যে, পুরনো কারখানা-মডেল আর ব্যাখ্যায় ঢুকছে না।
কোভিডের ধাক্কায় যখন আমেরিকান ছাত্র আর ব্যবসায়ীরা চীন ছেড়ে পিছু হটলেন, তখন শুরু হলো একধরনের কূটনৈতিক নিঃসঙ্গতা—যেন দুই বৃহৎ শক্তি একই মহাদেশে বাস করেও আর একে অপরের সীমানা ছুঁতে পারছে না। চীন থেকে এখনও গাদা গাদা ছাত্র আমেরিকায় পাড়ি দিচ্ছে, কিন্তু উল্টো দিকে ছবিটা প্রায় শুন্য। এই অসমতা শুধু সংখ্যার খেলাই নয়—এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক ছেদ, যা যোগাযোগের পথ রুদ্ধ করছে।
যখন কেউ সরাসরি কথা বলে না, তখন কল্পনার ভূত ঢুকে পড়ে আলোচনার ঘরে। এই না-বলা ও না-শোনার জায়গাতেই গড়ে ওঠে ভুলবোঝাবুঝি, রাজনীতির কঠোর রূপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—দুই দেশ এখন যেন সুচের ছিদ্র দিয়ে হাতি দেখছে; কিছুই স্পষ্ট নয়, শুধু বিকৃত ধ্যানধারণা আর আতঙ্কে ভরা অনুমান।
এই বিচ্ছিন্নতা, যদি চলতেই থাকে, তবে শুধু ভুল কূটনীতি নয়—ভবিষ্যতের বাণিজ্যনীতি, প্রযুক্তি অংশীদারিত্ব এমনকি মানুষের হৃদ্যতার জায়গাটাও শুকিয়ে যাবে। একসময়ের সম্ভাবনার মাঠ হয়ে উঠবে দুঃস্মৃতির মরুভূমি।
ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য-নীতি যেন এক তরফা অস্ত্রোপচার—শুধু শুল্ক, শুল্ক, আর শুল্ক। উদ্দেশ্য—উৎপাদন আবার ফিরিয়ে আনা হোক আমেরিকার মাটিতে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই ‘ফিরিয়ে আনা’র পর ঠিক কী করা হবে, তা নিয়ে কোনও সুস্পষ্ট নকশা নেই। যেন আগুন লাগানোই কৌশল, কিন্তু পানি কোথা থেকে আনবে সেটা ভাবা হয়নি।
শুল্ককে সব সমস্যার ম্যাজিক ওষুধ ভেবে তারা যা করছে, তাতে মূল কাঠামোগত শিল্পনীতি—যেটা টেকসই প্রতিযোগিতার জন্য জরুরি—সেটা পড়ে থাকছে একপাশে। অন্যদিকে চীন, যতোই সীমাবদ্ধতায় ভরা হোক না কেন, তার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি দিয়ে অন্তত একধরনের উদ্ভাবন ও পরিসরের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে।
এখানেই মূল ফারাক: চীন যেখানে নীতিকে কৌশলে রূপান্তর করে—শক্তভাবে, সংগঠিতভাবে—আমেরিকা সেখানে নীতিকে চিৎকারে পরিণত করছে। তাই এখন প্রয়োজন এক বহুমাত্রিক, ভবিষ্যতমুখী প্রতিযোগিতার কৌশল—যেটা শুধু প্রতিক্রিয়াশীল নয়, বরং নির্মাণমুখীও।
আমি বিশ্বাস করি—জলবায়ু পরিবর্তন আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো বৈশ্বিক সংকট, যা অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়, সেগুলোর মোকাবিলায় আমেরিকা আর চীনের পারস্পরিক সহযোগিতা বাধ্যতামূলক। দুই পরাশক্তি যদি নিজেদের ঠেলা-ধাক্কা ভুলে এক ছাতার নিচে না আসে, তবে আগামী পৃথিবীর ছায়া পড়বে শুধু ধ্বংস আর বিভেদের রেখায়।
কিন্তু সমস্যা হলো, এই সহাবস্থানের জরুরি দৃষ্টিভঙ্গি ওয়াশিংটনের বর্তমান রাজনীতিতে প্রায় ‘বিকল্পবাদ’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কূটনৈতিক বাতাসে এখন শুধু সংঘাতের গন্ধ—যেন ভবিষ্যতের শান্তি নয়, বরং অতীতের অভিমানই চালক হয়ে উঠেছে।
আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে সবচেয়ে দরকার এমন কিছু কণ্ঠস্বর, যারা জোর দিয়ে বলবে—যে সমস্যাগুলো ভূখণ্ডের সীমানা মানে না, তাদের সমাধানও একক হাতে সম্ভব নয়। জলবায়ুর ঢেউ যেমন একসঙ্গে আছড়ে পড়ে সব দেশের তটে, ঠিক তেমনি AI-এর নীতিমালাও একা রাষ্ট্র বানালে একদিন বুমেরাং হয়ে ফিরবেই।
শুল্ক আর প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞার গুঁতোয় আমেরিকা ও চীনের সম্পর্ক এখন এমন এক আগুনে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রতিটি পাল্টা পদক্ষেপ যেন ঘি ঢালছে দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্বের কুণ্ডলীতে। আমার সবচেয়ে বড় ভয়—এই প্রতিশোধের পরস্পর পরিক্রমা দুই দেশকেই এমন এক মনস্তাত্ত্বিক গণ্ডিতে আটকে ফেলবে, যেখানে অপরপক্ষ শুধুই ‘শত্রু’। তখন আর সহাবস্থানের কোনো ভাষা থাকবে না—থাকবে শুধু ঠান্ডা যুদ্ধের শব্দভাণ্ডার।
‘থুসিডিডিস ফাঁদ’—প্রাচীন ইতিহাসের সেই চেনা গল্প, যেখানে এক বিদ্যমান শক্তি এক নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর উত্থান দেখে ভয় পায়—তা আজকের চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্বে যেন পুনর্জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, ইতিহাস এখানে শুধু পাঠ্যবই নয়—এটা এখন রণনীতি, যা ভবিষ্যতের পথ কুরে খাচ্ছে।
চীন এখন তার জিনিসপত্রের সরবরাহ-নিয়ন্ত্রণকে অস্ত্রে পরিণত করছে—ঠিক যেন সূক্ষ্ম বাণিজ্যিক ব্ল্যাকমেইল। আর তার প্রভাবে বৈশ্বিক বাজার হঠাৎ কেঁপে উঠছে, বিনিয়োগ থমকে যাচ্ছে, প্রবৃদ্ধির গতি থেমে যাচ্ছে। এইসব দেখে প্রশ্ন জাগে—আমরা কি সত্যিই বুঝে এগোচ্ছি? নাকি প্রতিযোগিতার উত্তেজনায় আমরা দৃষ্টিহীনভাবে নিজেকেই ঠেলে দিচ্ছি সেই ফাঁদে, যাকে এড়ানোর জন্যই কূটনীতি আবিষ্কার হয়েছিল?
একটি এমন পৃথিবীতে, যেখানে অর্থনৈতিক সাফল্য নির্ভর করে আন্তঃসংযুক্তি ও উদ্ভাবনের প্রবাহের ওপর—আমেরিকার সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে এক দ্বিধার মুখোমুখি রাস্তা: খোলা দরজার নীতি না কি আত্মকেন্দ্রিক দুর্গতন্ত্র?
“দেয়াল তোলার চেয়ে জানালা খোলা রাখা বেশি কার্যকর”—তা আজ যেন আরও বাস্তব। আন্তঃসম্পর্কের পথ প্রশস্ত হলে যেখানে পারস্পরিক শেখা, প্রতিরোধক্ষমতা, ও অর্থনৈতিক পুনরুত্থান সম্ভব; সেখানে নিজের গণ্ডি টেনে রাখলে অপেক্ষা করে শুধু স্থবিরতা আর সংঘর্ষ। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই—ওয়াশিংটনের কথামালা দিনকে দিন বেশি ঝুঁকে পড়ছে সংঘাতের দিকে, যেন নীতির চেয়ে প্রতিপক্ষকে ঠেকানোই মুখ্য লক্ষ্য।
তবু, যাঁরা এখনও কূটনীতির ভাষায় বিশ্বাস রাখেন, তাঁরা জানেন—সফল প্রতিযোগিতা মানে অন্ধ দরজা নয়, বরং কৌশলগত উন্মুক্ততা। এমন এক খোলা নকশা, যেখানে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত থেকেও বিশ্বমঞ্চে অংশগ্রহণ করা যায়।
আমি প্রস্তাব করি এক সংমিশ্রিত কৌশল—যেখানে দৃঢ়তা থাকবে, কিন্তু তা হবে অন্তর্মুখী নয়, বরং সংলাপসঞ্জাত। ট্রাম্পের শুল্ক-রাজনীতি যতই মিডিয়ার শিরোনাম দখল করুক, তাতে যে কৌশলগত গভীরতার অভাব, সেটাই সবচেয়ে বড় অপচয়। এক সুপরিকল্পিত, তথ্যনির্ভর কৌশল—যেটা শুধু রাজনৈতিক তাৎক্ষণিকতা নয়, বরং ভবিষ্যতের জিওস্ট্র্যাটেজিক পটভূমি মাথায় রাখে—সেইটাই আজ দরকার।
এই সময়টা সেই শিল্প ও প্রযুক্তির দিকে নজর দেওয়ার, যা আগামী দশকগুলো নির্ধারণ করবে। সেগুলোর দিকে শুধু নজর নয়—সাহসী বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বে প্রণোদনা, এবং পারস্পরিক আস্থার বীজ বপনের দিকেও মনোযোগ জরুরি। আমেরিকা তখন নেতৃত্ব দেবে শুধু পেশিশক্তি দিয়ে নয়—বুদ্ধির দীপ্তি ও নীতির জোরে।
তাই যাঁরা আজ নীতিনির্ধারকের চেয়ারে বসে আছেন, তাঁদের জন্য এটাই সময়: নতুন কূটনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ার, যেখানে আলোচনার টেবিলেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া যায়, কিন্তু শত্রুতার রঙ ছড়ায় না। এই পথেই সম্ভব দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্ব এবং অর্থনৈতিক সুদিন।