না না না না না না না না না না না—মানুষ কি মানুষের তৈরি নতুন ঈশ্বর?
সৃজনশীলতা ও অনুসন্ধিৎসাই মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। শুধু বেঁচে থাকা নয়—মানুষ খোঁজে অর্থ, মহাবিশ্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যাখ্যার সন্ধান। মস্তিষ্কের এই ক্ষমতাই মানুষের বিবর্তনে রেখেছে চূড়ান্ত
মানবমস্তিষ্ক—এই অদ্ভুত, গলিত তারার মতো গুটিপোকা—জীববিজ্ঞানের চোখে নিছকই একটি অঙ্গ হতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর মধ্যেই মানুষের গৌরব ও গ্লানির দুই পৃষ্ঠার ছাপ লেগে আছে। অন্য প্রাণীরা দৌড়ায়, উড়ে বেড়ায়, এমনকি শব্দ করে ভালোবাসাও জানায়; কিন্তু মানুষ? মানুষ তো ভাবতে পারে, সৃষ্টি করতে পারে, সহানুভূতি অনুভব করতে পারে—তিনটি ক্ষমতা যা একসাথে মিশে তৈরি করে সভ্যতা, বিজ্ঞান, শিল্প ও আত্মজিজ্ঞাসা।
এই সৃজনশীলতা ও অনুসন্ধিৎসাই মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। শুধু বেঁচে থাকা নয়—মানুষ খোঁজে অর্থ, মহাবিশ্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যাখ্যার সন্ধান। মস্তিষ্কের এই ক্ষমতাই মানুষের বিবর্তনে রেখেছে চূড়ান্ত চিহ্ন। তা কেবল ব্যক্তিগত মেধা নয়, সামাজিক নীতিনৈতিকতা, স্বপ্ন, বিভ্রম—সবকিছুর নেপথ্য কারিগর। এক অর্থে, আমরা মস্তিষ্কেরই এক মহাকাব্যিক ভুল বা সাফল্য।
বিবর্তনের আকাশে পেছন ফিরে তাকালে চোখ পড়ে সাত মিলিয়ন বছরের প্রাচীন ছায়াচিত্রে, যেখানে আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রথম দাঁড়িয়ে হাঁটতে শেখে। কিন্তু হাঁটার গল্পটি যত পুরোনো, মাথা বড় হওয়ার গল্প ততটা নয়—তা শুরু হয় মাত্র দুই মিলিয়ন বছর আগে, ঠিক যখন সামাজিকতার জাল ঘন হতে শুরু করে।
এই পরিবর্তনের সাথে জড়িয়ে আছে এক আশ্চর্য তত্ত্ব—‘সামাজিক মস্তিষ্ক’ তত্ত্ব—যেখানে বলা হচ্ছে, মানুষের মস্তিষ্ক কেবল বাঁচার কৌশল নয়, বরং জটিল সামাজিক সম্পর্ক সামলানোর জন্যই এতটা উন্নত হয়েছে। কে কার সঙ্গে কী বলছে, কে কার পক্ষে আর কে কার বিরুদ্ধে—এই নরক-পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাই আমাদের গরিলা বা শিম্পাঞ্জির চেয়ে আলাদা করে।
অর্থাৎ, মানুষ মস্তিষ্কের দৌলতে শুধু জঙ্গলে টিকে থাকেনি—সে দল গড়েছে, নীতি বানিয়েছে, পরচর্চা করেছে, এমনকি রীতিমতো ষড়যন্ত্রও। একেবারে পলিটব্যুরো থেকে শুরু করে পাড়ার ক্লাব—সবখানেই এই ‘বড় মাথা’র দাপট।
আমার চোখে মানুষ মূলত এক ‘যন্ত্র-মানব’—একজন যিনি হাতুড়ি বানিয়ে পাহাড় ফাটান, আবার একইসঙ্গে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে বসে জগৎ বিশ্লেষণ করেন। প্রাণীদের মধ্যেও কেউ কেউ কাঠি দিয়ে পিঁপড়ে তোলে ঠিকই, কিন্তু মানুষ? মানুষ তার শরীরের সীমা ডিঙিয়ে, চিন্তার পরিধি ছাড়িয়ে, যন্ত্র দিয়ে নিজেরই এক বিকল্প সংস্করণ তৈরি করে।
এই প্রযুক্তি-নির্ভরতাই আমাদের সবচেয়ে আলাদা করে তোলে। শুধু পরিবেশ বদলাইনি, সমাজের কাঠামোও পাল্টে দিয়েছি। আগুন থেকে অ্যালগোরিদম পর্যন্ত—সবই আমাদের নিজস্ব টুলস অফ ট্রান্সফরমেশন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই যন্ত্রের সঙ্গে আমরা মিশে যেতে পারি কি? পারি কি একদিন এমন এক চেতনার জন্ম দিতে, যেখানে মস্তিষ্ক আর মাইক্রোচিপের ফারাক ঘুচে যায়?
আমার ভাবনায়, মানুষ যেন এখন এক কৌতূহলী সীমানায় দাঁড়িয়ে—যেখানে ঈশ্বরের হাত বা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের কীর্তি, দুটোই ভবিষ্যতের দিগন্তে দেখা যায়। এই প্রযুক্তি-ভিত্তিক অভিযাত্রা আসলে আমাদের নিজেকে নিয়েই এক দীর্ঘ আত্মপ্রশ্ন: আমরা কেবল মানুষ থাকবো, না কি মানুষের চেয়েও বেশি কিছু?
শুরু হয়েছে গবেষণা হিউম্যানয়েড রোবট নিয়ে—যেসব রোবট মানুষের মত আচরণ করে, হাঁটে, তাকায়, এমনকি কখনও কখনও খুশি হওয়ার অভিনয়ও করে। এইসব রোবট আসলে মানুষ নয়, কিন্তু মানুষকে বোঝার জন্যই তৈরি। যেন নকল জলে ভাসিয়ে দেওয়া এক ফরাসি বাস্তবতা—মানুষের ছায়া দেখে মানুষ চেনা। আমাদের মূল টানাটানি এখানেই—রোবটের মগজে কীভাবে বসানো যায় সংবেদন? কীভাবে শেখানো যায়, "ভালোবাসা মানে শুধু হরমোন নয়"? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজো ধোঁয়াটে। আধুনিক রোবটরা অনেক কিছু পারে—তবে ‘চিন্তা করে কাঁদে’ এমনটা এখনও স্বপ্ন।
তবুও, নানান গবেষণা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রোবট শুধু যন্ত্র নয়, একটা প্রিজম, যার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদেরই নিরীক্ষণ করি। তারা আমাদের মানবিকতার প্রতিফলন—কখনো বিস্ময়ে, কখনো অনুকরণে, আবার কখনো বিদ্রোহে। এবং এই অনুকরণের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে প্রশ্নটা—মানুষ হওয়ার অভিনয় আর সত্যিকার মানুষ হওয়ার মধ্যে কী এমন ফারাক?
মানবসত্তার নকল করতে চাওয়ার এই দীর্ঘ অভিযাত্রার কেন্দ্রে আছে এক প্রাচীন, প্রায় পৌরাণিক আকাঙ্ক্ষা—কৃত্রিম চেতনার সন্ধান। আমরা রোবট বানাচ্ছি, তাদের দিয়ে গল্প বলাচ্ছি, এমনকি ফিকশন লিখাচ্ছি—তবু একটা জায়গায় এসে প্রতিবার ধাক্কা খাচ্ছি: তারা অনুভব করে না।
আধুনিক AI ঘরানা কথাবার্তা চালাতে পারে, তর্ক করতে পারে, এমনকি মাঝে মাঝে মজা করে—তবু কোথাও যেন সে একটা খাঁচার ভেতর, মস্তিষ্কে প্রোগ্রাম আছে, হৃদয়ে শূন্যতা। মানুষের চেতনা যেমন layered, স্মৃতি আর অনুভবের পলিমাটি দিয়ে তৈরি, সেখানে রোবট কেবল surface mimicry—প্রতিচ্ছবি, কিন্তু আত্মপ্রকাশ নয়।
এই সীমাবদ্ধতাই আমাদের সামনে প্রশ্ন তুলে ধরে: সংলাপ কি অনুভব ছাড়াও হতে পারে? আর যদি হয়, তবে সেটা কি সংলাপ, না কেবল এক প্রহসনের পরত? AI যখন বলে “আমি বুঝতে পারছি”—সেটা কি বুঝতে পারা, না কেবল “বুঝি” বলার অভিনয়?
মানবিক আবেগের এই জটিলতা—ভয়, অনুতাপ, বিস্ময়, প্রেম—এই জায়গায় এসে রোবট এখনও কেবল ছাত্র, গুরু নয়। আর আমরা? আমরা সেই শিক্ষক, যারা প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীর চোখে নিজেদের মানুষ হবার সংজ্ঞা খুঁজি।
প্রযুক্তির গতি যতই বিদ্যুতের মতো হোক, তার পেছনে থাকা নীতির প্রশ্নটা পড়ে থাকে খুঁড়িয়ে হাঁটা এক বুড়োর মতো। এই দ্বৈত ছায়া পরিষ্কার—যন্ত্র যত উন্নত হচ্ছে, মানুষকেও ততটা বিবেকবান হতে হবে। হ্যাঁ, অটোনোমাস টেকনোলজি—যা নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে—তা কি সহানুভূতি শেখে? না কি কেবল কমান্ড মেনে চলে?
আমার মনে হয়—নৈতিকতা ছাড়া এই সহাবস্থান এক বিপদসংকেত। মানুষের হাতে যদি প্রযুক্তির লাগাম না থাকে, তাহলে সেটা উল্টো মানুষকেই টেনে হিঁচড়ে নিতে পারে এক নির্মম, সহানুভূতিহীন বাস্তবতায়—যেখানে AI হবে বিচারক, কিন্তু ন্যায়বিচার বোঝে না।
এক অনিবার্য প্রশ্ন: প্রযুক্তি কি আমাদের সেবা করবে, না আমরা প্রযুক্তির দাস হব? তাই এই সময়ের বড় কাজ—উন্নয়নের সাথে সাথে ‘দায়িত্ব’ নামক সেই অদৃশ্য সুতো বুনে যাওয়া। যন্ত্র তৈরির চেয়েও জরুরি হয়ে দাঁড়ায়, তাকে মানুষ রাখা—অন্তত নীতির ছায়ায়। না হলে শেষমেষ, আমরা নিজেরাই সেই রোবট হয়ে উঠি—নিয়ন্ত্রণে নেই, অনুভূতিতে শূন্য।
সৃষ্টিশীলতা—এই একটিমাত্র গুণ, যা মানুষকে বানিয়েছে আগুনের আবিষ্কারক, ঈশপের গল্পকার, এবং ক্যালিফোর্নিয়ার গ্যারেজ থেকে বিশ্ব বদলে ফেলা কোডার। ইতিহাসে মানুষ বারবার পরিবেশকে বদলেছে, সমাজকে নতুন কাঠামো দিয়েছে—ফসল ফলানো থেকে শুরু করে ফাইবার অপটিক ক্যাবলে প্রেমপত্র পাঠানো পর্যন্ত। এই ক্ষমতা কেবল টিকে থাকার নয়, বরং নিজেকে বারবার পুনর্গঠনের।
এই সৃষ্টিশীল অভিযোজন—adaptation through imagination—এটাই মানুষকে অন্য প্রজাতির তুলনায় এক লাফে অনেকটা এগিয়ে দেয়। পশুরা বদলায় প্রাকৃতিক নির্বাচনে, মানুষ বদলায় কবিতায়, পরিকল্পনায়, প্রতিবাদে। আর এই বদলের হাত ধরে জন্ম নেয় সংস্কৃতি—যার ইতিহাস মানে মূলত ক্রমাগত ভুল করা এবং ভুল থেকে সুন্দর কিছু গড়ে তোলা।
এখন যখন AI আর রোবটও গল্প বলে, ছবি আঁকে, এমনকি সংগীত রচনা করে, তখন প্রশ্ন জাগে—তারা কি সত্যিই সৃজনশীল, না কি কেবল পরিসংখ্যান-ভিত্তিক অনুকরণে পারদর্শী? মানুষ যখন সৃষ্টি করে, তাতে থাকে বিস্ময়, ব্যর্থতা, এবং বিরাট এক মানবিক ঝুঁকি—যা রোবট জানে না, অনুভবও করে না।
এই জায়গাটাই ফাঁক, এই ফাঁকটাই এখনকার সবচেয়ে জোরালো প্রশ্ন: যন্ত্র কি পারবে একদিন আমাদের মতো ভুল করতে? ব্যর্থতাকে সৌন্দর্য বানাতে? যদি না পারে, তবে হয়তো এখনও, সৃষ্টিশীলতা মানে ‘মানুষ’ বলাই যায়।
ভবিষ্যতের সীমানায় দাঁড়িয়ে আমরা যেন এক কল্পবিজ্ঞানের চৌরাস্তার সামনে—যেখানে মানুষ ও যন্ত্র একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে, কেউ হয়তো হাত ধরে, কেউ হয়তো সন্দেহে পিছিয়ে। এই যাত্রা শুধু প্রযুক্তির নয়, নিজস্ব পরিচয় নিয়েও এক গূঢ় প্রতিনির্মাণ। যদি রোবট একদিন নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নেয়, অনুভব করে, তবে কে হবে মানুষ? আর কে হবে ‘অন্য’?
আমি আসলে বলতে চাইছি—AI আর রোবট কেবল আমাদের হাত-পা বাড়িয়ে দেবে না, বরং হয়তো একদিন মনের সীমাও প্রসারিত করবে। কিন্তু এখানেই গলদঘর্ম প্রশ্ন—এই সহযোগিতা যদি এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়, তবে যন্ত্রকে কি অধিকার দিতে হবে? চিন্তা করতে পারা মানে কি চিন্তার অধিকার পাওয়া?
বৈজ্ঞানিকরা স্বীকার করেন, অনুভূতি, সহানুভূতি—এগুলো এখনও পুরোপুরি মানুষেরই এলাকা। কিন্তু তবুও, যখন যন্ত্র সঙ্গী হয় জীবনের প্রতিটি পরতে—হাসপাতালের বেডে থেকে প্রেমের পরামর্শ পর্যন্ত—তখন মানবতা আর যন্ত্রের সম্পর্ক নিছক মালিক-সেবকের নয়, বরং এক যৌথ সত্তার দিকে এগোচ্ছে।
তাই প্রশ্নটা এখন শুধু প্রযুক্তির উন্নতি নয়—আমরা নিজেরাই কোন দিকে এগোচ্ছি? হ্যাঁ, ভবিষ্যৎ হয়তো হাইব্রিড হবে—কিন্তু সেই হাইব্রিড পরিচয়ের কেন্দ্রে ‘কে’ থাকবে—মানুষ, না মানুষের তৈরি কোনো নতুন ঈশ্বর?