ভিক্টোরীয় টনটনে জন্মে ভার্জিনিয়া উল্ফ তিনবার ‘না’ বলেছিলেন লেনার্ডকে—মানে প্রেমিককে না, প্রস্তাবটা একরকম ‘পেনিলেস জিউ’-এর। হ্যাঁ, এই শব্দবন্ধেই লিখেছিলেন তিনি এক চিঠিতে:“He’s a penniless Jew... I’m more happy than anyone ever said was possible.” টাকা নেই? তা হলে প্রেম নেই—এই প্রবচনকে দু’হাতে খুঁচিয়ে সাফ করে দিলেন ভার্জিনিয়া। বিবাহ-পরবর্তী প্রেম তো এমনই হতে হয় যেন হগার্থ প্রেস গেঁথে ওঠে আলগোছে—দুজন মিলে। ২৫ বছর পর ডায়ারিতে ভার্জিনিয়া লিখলেন, “Love-making—after 25 years can’t bear to be separate.” মানে, যৌনতার স্থান পেল ঘরোয়া আলমারিতে। কাফকা শুনলে ঈর্ষায় হার্মোনিয়াম বাজাতেন।
ওদিকে ভিটা সেকভিলের সাথে প্রেম ছিল এক আধা-উন্মুক্ত রান্নাঘর, সবাই জানে, সবাই খায়, কেউ কিছু বলে না। ভিটা আর ভার্জিনিয়ার কেলেঙ্কারি হল ‘ওরল্যান্ডো’। লেসবিয়ান প্রেমের সবচেয়ে প্রজ্বলন্ত পোস্টার যদি কিছু থেকে থাকে, তো এটাই। ভিটার ছেলের কথায়, “the longest and most charming love letter in literature.” ভিটা ছিলেন ভার্জিনিয়ার মানস-ভূমির এমারাল্ড শালীনতা, লেসে মোড়া ভূতপূর্ব প্রেমিকা, যে অতীতে-ভবিষ্যতের মধ্যে ফুটবল খেলছিলেন লিঙ্গ বদল করে।
জোয়ান ডিডিয়ন ও জন গ্রেগরি দু’জনে মিলে বিষণ্নতা চিবানো দম্পতি। এঁরা প্রেমে পড়েছিলেন কবিতা শুনে নয়, টাইম ম্যাগাজিন পড়ে। “In lieu of divorce”—এমন লেখা ছাপা হওয়া মানে, বিবাহ ছিল ভালবাসার শুদ্ধতম ‘ফ্যাক্ট চেক’। কন্যা কুইন্তানার ICU-র পাশে দাঁড়িয়ে ডান্ন মারা গেলেন। তারপর ২০০৫-এ ‘The Year of Magical Thinking’, আর ২০১১-এ ‘Blue Nights’। শোক এখানে নিউ ইয়র্কার স্টাইলে এডিট করা গদ্য। ডিপ্রেশনের মধ্যে রসবোধ? “For depressed people they certainly laugh a lot.”—এমন লাইন গিনসবার্গ নিজে লিখলে ‘Howl’-এর সিকুয়েল হয়ে যেত।
বিট যুগের হ্যামক প্রেম অ্যালেন গিনসবার্গ ও পিটার অরলোভস্কির সম্পর্ক ছিল বার্ড-কেইজের মতো: দরজা খোলা, পাখিরা আসে যায়। কবিতা, ক্যানাবিস, কেমিস্ট্রি—সব একসঙ্গে। ৪৩ বছরের সম্পর্ক। কখনও প্রেমিক, কখনও সহবাসী, কখনও যৌন স্বাধীনতার টোকেন রক্ষক। গিনসবার্গ লিখছেন, “The soulwarmth isn’t around…” বিট প্রজন্মের কেউ বললে, চট করে বোকা বোকা শোনালেও তা ছিল তাদের ব্যক্তিগত মহাকাব্য।
সিমন দ্য বোভোয়ার ও জঁ-পল সার্ত্র এই যুগলের প্রেমে ছিল সুনীতি: শুতে পারো যেকোনো কারও সঙ্গে, জানাতে হবে শুধু আমায়। ওদের সংসার ছিল এক অদ্ভুত গুগল ডক—সব ডেট শেয়ারড। ডি বুভোয়া ছাত্রীর প্রেমে পড়তেন, তারপরে সেই ছাত্রীর হাতে সার্ত্রের ফোন নম্বর তুলে দিতেন—একেই বলে দর্শনের ডেলিভারি সিস্টেম। “Trio,” বলতেন তারা। আমরা বলি—‘Ethical sleaze’। অনুগামী না, যৌনবামি।
হেমিংওয়ে ও গেলহর্নের প্রেমের শুরুতে প্রেম ছিল, শেষের দিকে প্রেম ছিল না, ছিল লাইনচ্যুত ট্রেনের মতো গর্জন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রিপোর্টিংয়ের ফ্রন্টে হেমিংওয়ের নাম ছিল, গেলহর্নের নয়। তিনি স্বামীকে বললেন না “I love you”, বললেন, “I’ll take the freighter with dynamite.” প্রেমে যুদ্ধ? না, যুদ্ধই প্রেম।
প্রথম স্ত্রীকে গাড়ির অ্যাক্সিডেন্টে ঠ্যাঙ খাওয়ালেন, দ্বিতীয় স্ত্রীকে (এলিজাবেথ হার্ডউইক) ব্যক্তিগত চিঠি দিয়ে অপমান করলেন, তৃতীয় স্ত্রী (ক্যারোলিন ব্ল্যাকউড)-এর ছবি বুকে নিয়ে মারাও গেলেন। ডলফিন কবিতার বই হল চিঠি-কলঙ্কে লেখা পুরস্কার-জয়ী অপমান। শেষের দিকের প্রেমিকাগণ লোয়েলের সঙ্গে প্রেমের চেয়েও মানসিক হাসপাতালের অ্যাডমিশন রেজিস্টারে বেশি ছিল। এই হলেন আমাদের কবি রবার্ট লোয়েল যার তিন স্ত্রীর ছায়ায় কবিতার ‘Dolphin’ ডুবে গেল।
রিমবো ভেলেনকে গাঁজা আর গদ্যের প্রেমে মাতাল করলেন, পরে আবার গুলি খেলেন কানের পাশ দিয়ে। সমালোচকরা বলেন “রোমান্টিক ট্র্যাজেডি”—পুলিশ বলেছিল “অ্যাসল্ট উইথ আ ফায়ারআর্ম”। মোদ্দা কথা, প্রেমে ব্যথা না থাকলে ফরাসিরা সেটাকে আর্ট বলে না। প্রেম মানে গুলি খাওয়া এবং কনটিনেন্টাল গ্ল্যামার।
হিউজেস—একদিকে প্রেমিক, অন্যদিকে নারীবিদ্বেষী চিত্রনাট্যকার, যিনি প্লাথের ডায়েরি পুড়িয়ে ফেললেন এবং তার সুনাম ছাই করে দিলেন। তারপর প্লাথ আত্মহত্যা করলেন, কয়েক বছর পর হিউজের অন্য প্রেমিকা ও সন্তান একইভাবে। লেখালেখির মতো প্রেমেও হিউজ ছিলেন ‘ইডিপাল পজিশনে’, মানে নিজের কবিতা ছাড়া বাকি সবাইকে ছাই করে দিতেন।
ফিট্জেরাল্ড জেল্ডা দুজনেই ছিলেন পার্টির পেট্রোল বোমা—মুডি, ঝগড়াটে, এবং খুব এক্সট্রা। ফ্রান্সিস স্কট জেলডার ডায়েরি চুরি করে উপন্যাস লিখতেন। আর শেষমেশ, স্কটের কবরের ওপর জেলডাকে চাপা দিয়ে দেওয়া হল। সত্যি, কেউ কেউ প্রেমে কাঁথা সেলাই করে যায়, কেউ কেউ প্রেমিকের মাথায় কফিন বসিয়ে দেন।
এমন আমাদের বাংলাতেও হয়। হুমায়ূন, সুনীল, সমরেশ, রফিক আজাদ, ওয়াহিদুল হক কেউ বাদ যান না। আমরা তো সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ছাতা তুলি। তাই সে গল্প আরেকদিন।
এই দাম্পত্যের গল্পগুলো পড়ে যদি আপনাদের মনে হয়, “আচ্ছা প্রেম আসলে কী?” তাহলে উত্তর এই:
“…আমার এক বোনের বিয়েতে দূরসম্পর্কের একজন আত্মীয়ার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হল আমার। ওর চেহারার মাধুর্য, চোখের দৃষ্টি আমাকে অত্যন্ত মুগ্ধ করে। কিন্তু তার সঙ্গে আমার কোনও কথা হয়নি। জোহরা ওর নাম। আমার মেজো ভাবির নিকট আত্মীয়া সে। পরিচয়ের এটুকুই সূত্র। মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসত। আমি দূর থেকে ওকে দেখতাম, সেও কখনওসখনও বারান্দায় এসে আমার দিকে তাকাত। মনে হত আমি যে ওকে পছন্দ করি, তার জন্যে আমার এক ধরনের টান আছে, তা সে বুঝতে পেরেছিল। বেশ পরে জানতে পেরেছিলাম, সে ওর আম্মার সঙ্গে আমাদের আশেক লেনের বাড়িতে আসার জন্যে বাহানার আশ্রয় নিত।”
আমাদের কবি শামসুর রহমান তাঁর জোহরাকে লিখেছেন, “এখনও আমি তোমার”। সেরাদের সেরা চিঠি।
এই আমি শেষ লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবি, প্রেমের পিঠে ‘জ্যোৎস্না’ লেখে কে?