অনুবাদ
রিটন খান
তুমি জানো, আমার এক বিচিত্র বদভ্যাস আছে—মানুষকে লেখক হওয়ার পরামর্শ দেওয়া, এমন মানুষদের, যাদের সামনে ছিল আরও যুক্তিসঙ্গত, নিরাপদ পথ। আমি কয়েকজনের নামও বলতে পারি, যাদের এই ‘ভুল’ পরামর্শটা আমি দিয়েছিলাম—এমন পরামর্শ, যা তাদের জীবনটাকে লেখালেখির দোটানায় ফেলে দিয়েছে।
যাই হোক, আমি ভাবলাম একটু কথাবার্তা বলি—যেহেতু আমাকে এখানে ডাকা হয়েছে ধর্মদ্রোহিতা নিয়ে কিছু বলার জন্য, তাই ভাবলাম, কিছুটা বলেই ফেলি—তারপর চাইলে যেকোনো কিছু নিয়ে গল্প জমতে পারে।
এই বক্তৃতার শিরোনামের পেছনে একটা গল্প আছে—যেটা আমার জীবনের সেই দুর্বিষহ সময়ের, The Satanic Verses নিয়ে তীব্র আক্রমণ শুরু হওয়ার পরের পর্বে। সেসময়, এক পাঠক—যাকে আমি চিনতাম না, কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল যে সে আমার কাজের অনুরাগী—আমার ঠিকানায় একটা টি-শার্ট পাঠাল ডাকযোগে। তার সামনের দিকটায় লেখা ছিল: “Blasphemy is a victimless crime.”
তাহলে, মূলত এই কথাটার জন্ম একখানা টি-শার্টে। আর আমি ধরে নিচ্ছি, লেখক বলতে চেয়েছেন—যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে ধর্মদ্রোহও নেই। কারণ, যদি ঈশ্বরই না থাকেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহ করার প্রশ্নই ওঠে না। এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে, বলতেই হচ্ছে, আমার একটা গভীর সহমর্মিতা ছিল।
আমি আসলে নিজেকে কখনো ধর্ম নিয়ে লেখেন এমন লেখক বলে ভাবিনি। কিন্তু ধর্ম, আফসোস, এই নিয়ে আলাদা একটা মত পোষণ করেছিল—আর এটাও তার বহু ভুলের মধ্যে আরেকটা।
আমি বড় হয়েছি এক ঘরে, বম্বে শহরে—যেটাকে তখনো ‘বম্বে’ই বলা হতো, আজকের মুম্বাই—আর সে ঘরটা ছিল মোটামুটি সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। এর একটা বড় কারণ ছিল আমার বাবা-মার প্রজন্ম, যারা প্রত্যক্ষ করেছিল ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগের সেই রক্তাক্ত পর্বকে—যেখানে হিন্দুরা মুসলমানদের মেরেছিল, মুসলমানরা হিন্দুদের। এক ভয়াবহ রক্তস্নাত জন্ম—যেখানে ভূখণ্ড জন্মেছে, কিন্তু মানুষ মরেছে।
সরকারি হিসেব বলে নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ লাখ, কিন্তু বাস্তবে তা বিশ লাখের কাছাকাছি, এমনকি তারও বেশি হতে পারে। আমার বাবা-মা ছিলেন মুসলিম পরিবার থেকে আসা, কিন্তু পাকিস্তানে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না তাঁদের। তাঁদের পরিচয় ছিল মুসলিমের চেয়ে অনেক বেশি—ভারতীয়। তবে আমার মনে হয়, এই রক্তাক্ত জন্মের পর তারা আর ধর্মের সঙ্গে বিশেষ কোনো সম্পর্ক রাখতে চাননি।
আমার পরিবারের ধর্মচর্চার পরিসর বলতে যা ছিল, তা মূলত আমার মায়ের একটাই বিধি—শূকরজাত কিছু খাওয়া যাবে না। শূকর বর্জন—এইটুকুই ছিল আমাদের ইসলামের সারাংশ।
আমি যখন ইংল্যান্ডে বোর্ডিং স্কুলে গেলাম, ঠিক করলাম বিদ্রোহ করব। স্কুলের দোকানে গিয়ে কিনে ফেললাম একখানা হ্যাম স্যান্ডউইচ। একখানা অতি গুরুত্বপূর্ণ হ্যাম স্যান্ডউইচ। স্বাদ তেমন কিছু ছিল না, কিন্তু ওই ১৩ বছর ছয় মাস বয়সে, নিষিদ্ধ শূকর-মাংস খাওয়ার যে অভিজ্ঞতা—তা ছিল রীতিমতো অলৌকিক। এবং... কিছুই ঘটল না। না কোনো বজ্রপাত, না ঈশ্বরের তিরস্কার। সেদিনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম—ঈশ্বর বলে কিছু নেই। এটাই ছিল সেই হ্যাম স্যান্ডউইচের পাঠ।
আমি যখন কলেজে, ষাটের দশকের মাঝামাঝি, তখন ধর্ম ছিলই না আলোচনার বিষয়। ১৯৬৮ সালে আমি ২১, 'Summer of Love'-এর সময় আমি ২০। মাথায় ছিল অন্য জিনিস—রাজনীতি, প্রতিবাদ, প্রেম, বিপ্লব। সময়টা ছিল তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনার—ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন, প্রথম তরঙ্গের নারীবাদ, সিভিল রাইটস মুভমেন্ট। প্রচুর কিছু ছিল বলার, লড়ার, ভাবার। কিন্তু ধর্ম? সেটা যেন কোনো কোণার একপাশে পড়ে থাকা ধূলিধূসরিত চিঠির মতো—যা কেউ পড়তে চাইছিল না।
আমার জীবনের এক বড় বিস্ময়—ধর্ম আবার কীভাবে কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে এল। শুধু ইসলাম নয়—এই দেশে খ্রিস্টধর্ম, ভারতে হিন্দুধর্ম—সবকটাই কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির মুখোশ পরে ফিরে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রে। এবং এর সঙ্গে ফিরেছে ধর্মদ্রোহের সেই পুরোনো হাতিয়ার—যা ধর্ম চিরকাল ব্যবহার করে এসেছে মানুষের কথাবার্তা আর চিন্তাধারার ওপর দখল রাখতে।
সাম্প্রতিককালে আমি কিছু পড়াশোনা করছি—ভলতেয়ার আর আলোকপ্রাপ্তির যুগের লেখকদের নিয়ে, কারণ এই নিয়ে একটা কাজ করছি। ভলতেয়ার ছিলেন গির্জার এক প্রবল বিরোধী; তাঁর বিশ্বাস ছিল—চিন্তার ওপর সবচেয়ে নির্মম দমনচাপ আসছে রাষ্ট্র নয়, চার্চের দিক থেকেই। তাঁর সেই বিখ্যাত উচ্চারণ, Écrasez l’infâme!—অর্থাৎ, “নষ্ট জিনিসটাকে চূর্ণ করে দাও”—আর এই 'নষ্ট জিনিস' ছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চ নিজেই।
আলোকপ্রাপ্তির যুগের লেখকদের মৌলিক বিশ্বাস ছিল, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রধান শত্রু রাষ্ট্র নয়, বরং গির্জা। তারা মনে করতেন, মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে, প্রথমেই গির্জার ওপর থেকে এই নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে হবে—কারণ গির্জাই ঠিক করত, কোন কথা বলা যাবে, কোনটা নয়। রাষ্ট্রের ক্ষমতা নয়, বরং গির্জার সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।
এমনকি কিছু লেখকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেমন ফ্রাঁসের ক্ষেত্রে—তাঁদের গির্জা আক্রমণ করেছে, কিন্তু রাষ্ট্র তাঁদের রক্ষা করেছে, এবং তাঁদের প্রতিভার ভিত্তিতে সেই সুরক্ষা দিয়েছে। অর্থাৎ, সেই সময়ে রাষ্ট্র কখনো কখনো লেখকদের বৌদ্ধিক স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, যেখানে গির্জা ছিল দমনকারী শক্তি।
আলোকপ্রাপ্তির সেই যুগ থেকেই—যার ভাবনা থমাস পেইন গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন—উত্পত্তি ঘটল আমেরিকান ‘লিবার্টি’ আর ‘ফ্রিডম’-এর ধারণার। অর্থাৎ, মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা আসলে জন্ম নিয়েছিল এক বৌদ্ধিক বিদ্রোহ থেকে—চিন্তাকে রুদ্ধ করে এমন সব শক্তিকে ভাঙার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই। আর সেই ভাঙনের অস্ত্র ছিল ধর্মদ্রোহ—blasphemy।
কয়েক বছর আগে আমি গিয়েছিলাম কলম্বিয়ার কার্টাহেনা শহরের এক সাহিত্য উৎসবে। শহরটা যেমন সুন্দর, তেমনি তার ইতিহাসও ভয়ানক—একদা ক্রীতদাস বাণিজ্যের বড় কেন্দ্র, আর ইনকুইজিশনের এক দুর্ধর্ষ ঘাঁটি। এখন সেখানে আছে Museum of the Inquisition—একটা ভূতের ঘরের মতো জায়গা, যেখানে রাখা আছে নির্যাতনের যন্ত্রপাতি: বঁটি, র্যাক, আঙুল চেপে ধরা স্ক্রু, এমনকি গিলোটিনও—আর প্রতিটির পাশে ছোট ছোট চিহ্নে লেখা, এইসব দিয়ে ঠিক কী করা হতো।
এই সব যন্ত্র আমাকে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন মিউজিয়ামের এক কর্তা ব্যক্তি—যিনি এইসব ‘অস্ত্রের’ গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন কথা বললেন, যেন তিনি নির্যাতনের পক্ষেই দাঁড়িয়ে। তাঁর কথা অনুযায়ী, গির্জার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এইসব পদ্ধতির থাকা ছিল অত্যন্ত জরুরি। অর্থাৎ, সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র জাদুঘর—যেটা খোলাখুলি ভাবে মানুষকে নির্যাতনের পক্ষে অবস্থান নেয়। যেমনটা বহুদিন ধরে ক্যাথলিক চার্চ করেছিল।
ধর্মদ্রোহ—এই অভিযোগ বহুদিন ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই রকম ভাবেই, এবং এখনও কিছু কিছু দেশে একইভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আমি এবার একটু নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। The Satanic Verses নিয়ে যেসব হইচই, হুমকি, রক্তচাপ তৈরি হয়েছিল, তখন আমি ইংল্যান্ডে থাকতাম। কিন্তু তারও আগে, যুক্তরাজ্যে ধর্মদ্রোহের সর্বশেষ সফল বিচার হয়েছিল ১৯৭৬ সালে।
Gay News নামে একটি পত্রিকায় কবি জেমস কার্কআপ একটি কবিতা লিখেছিলেন যিশুর ক্রুশবিদ্ধতা নিয়ে—কল্পনায় এক সমকামী রোমান সেনা, যিনি ক্রুশের পাদদেশে দাঁড়িয়ে যিশুর দেহ নিয়ে কামনায় বিভোর। কবিতাটি ছিল তীব্র, দমবন্ধ করা রকম সাহসী—কোনোভাবেই সংযত বলা যাবে না। এই কবিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান মেরি হোয়াইটহাউজ—একজন ব্রিটিশ নৈতিকতার স্বঘোষিত রক্ষাকর্ত্রী, যিনি মূলত যৌনতা-ঘেঁষা ‘অস্লীলতা’র বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে Gay News-এর বিরুদ্ধে একটি ব্যক্তিগত ধর্মদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়। আদালত দোষী সাব্যস্ত করে পত্রিকাকে। পরে অবশ্য সেই রায় খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু সেটাই ছিল ইংল্যান্ডে শেষবারের মতো ধর্মদ্রোহের অভিযোগে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার ঘটনা।
The Satanic Verses নিয়ে আক্রমণ শুরু হওয়ার পর, ব্রিটেনে অনেকে কার্কআপ মামলার দৃষ্টান্ত টেনে বলল—আমার বিরুদ্ধেও ধর্মদ্রোহের মামলা হওয়া উচিত, আমাকেও দোষী সাব্যস্ত করা উচিত। এবং আইন তো তখনও ছিল—কিন্তু আমি দোষী সাব্যস্ত হইনি। কারণ? সেই আইন কেবল Church of England-এর সুরক্ষার জন্য প্রযোজ্য ছিল।
কিছুটা হাস্যকর, তাই না?
তাই সমাধানটা ছিল এই নয় যে, আইনটাকে অন্য ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য করে তুলতে হবে—যেটার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। বরং আসল সমাধান ছিল আইনটাই তুলে দেওয়া। কিছুটা সময় লেগেছিল, কিন্তু শেষমেশ যুক্তরাজ্যে blasphemy law পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়। এবং সেই বিলোপ আজও বহাল আছে। পৃথিবীর বহু দেশেই এখন আর এরকম কোনো আইন নেই।
কিন্তু এখন এসেছে নতুন এক ফ্যাশন—ধর্মদ্রোহের ছদ্মবেশে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকছে সেন্সরশিপ। এখন বলা হচ্ছে, কাউকে কষ্ট দিলে সেটা ভুল। আর কেউ যদি ‘আঘাতপ্রাপ্ত’ বোধ করে, তাহলে সে বিশ্বাস করে, তার অধিকার আছে তোমার কথা থামিয়ে দেওয়ার।
আসলে এ তো একই জিনিস। Blasphemy এখন গণতন্ত্রের পোশাক পরে এসেছে—যেখানে যে কেউ নিজেকে ‘পোপ’ ভাবতে পারে।
তাই আমি বলি—বিশেষ করে তরুণদের উদ্দেশে, যারা ভাবছে কষ্ট পাওয়াটাই নৈতিক গৌরব—পোপ হয়ে উঠো না। আমাদের ইতিমধ্যেই একজন পোপ আছেন। সেটাই যথেষ্ট।
এই কথাতেই শেষ করি।
পোপ হইও না।—বাহ, দারুণ এক প্রস্থান-বাক্য!
Salman Rushdie’s 2025 William Phillips Lecture, titled “Blasphemy is a Victimless Crime”: