ব্রিট-সাহিত্য পুরস্কার
বই হল এমন আয়না যে রাষ্ট্র যতই ভুলভাল বলুক, গল্পগুলো নিজেদের আলোয় দাঁড়ানোর জায়গা খুঁজে নেয়।
ব্রিটেনের সাহিত্যবিজ্ঞপ্তিগুলো এমনভাবে ছাপে ছাপে সাজানো যে মনে হয় বুক পুরে রাষ্ট্রই ঘোষণা করছে কোন বই নিয়ে আপনার টেবিলের ধারে কাশবন কাঁপানো উচিত। পুরস্কারের টাকাপয়সার অঙ্কগুলো সমান গম্ভীর। আছে রাজনীতি, স্মৃতি, বাজার, প্রযুক্তি, পরিচয়, হাস্যরস। কেউ দাসবাণিজ্যের অসংগৃহীত ইতিহাস অনুবাদ করছেন; কেউ ভবিষ্যতের ব্যবসার মানচিত্র আঁকছেন; কেউ পরিবারে ভাঙন থেকে কমেডির রেখা কেটে দেখছেন; কেউ নিজের দেহের মধ্যে নিজের জাতিকে খুঁজে দেখছেন। সব মিলিয়ে চিত্রটি দাঁড়ায় এইরকম—বই হল এমন আয়না যে রাষ্ট্র যতই ভুলভাল বলুক, গল্পগুলো নিজেদের আলোয় দাঁড়ানোর জায়গা খুঁজে নেয়। আসুন জানি কারা এবং কোন বইগুলো গোপনে পুরস্কার পেলো?
এক. দাসবাণিজ্যের শেষ অধ্যায়ে যে জীবনের রক্ত-দাগ রয়ে গেছে
হান্না ডারকিনের Survivors: The Lost Stories of the Last Captives of the Atlantic Slave Trade পেল ওলফসন হিস্টোরি প্রাইজ। অঙ্কটা বড়, প্রায় ছেষট্টি হাজার ডলার। কিন্তু তার চেয়েও বড় হচ্ছে তাঁর ঠান্ডা মাথায় খুঁড়ে তোলা কাহিনিগুলো, ক্লোটিল্ডা নামের সেই শেষ দাসভর্তি জাহাজের শতাধিক জীবিতদের বংশগত স্মৃতি। গৃহযুদ্ধের আগের শেষ বছরটায় ১৮৬০ সালে যে জাহাজ আলাবামায় এসে দাঁড়ায়,, তার ধাক্কা আমেরিকার ইতিহাসে কোথায় গিয়ে লাগে তা আমরা ঠিক জানি, কিন্তু সেই মানুষগুলোর অন্তঃকথা যেভাবে ডারকিন টেনেছেন তা এই পুরস্কারের আড়ালে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা তৈরি করে। পাঠকের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, রাষ্ট্রের রেজিস্ট্রারে নাম নাও থাকতে পারে, কিন্তু মানুষের স্মৃতির কি কোনও মেয়াদোত্তীর্ণ আছে?
দুই. এআই সম্রাটের উত্থানপতনের আর্থিক ইতিহাস
স্টিফেন উইট পেলেন ফিনান্সিয়াল টাইমস–শ্রডার্স বিজনেস বুক অব দ্য ইয়ার। The Thinking Machine বইটা জেনসেন হুয়াং এবং এনভিডিয়ার গল্প। আমরা আজ যে এআই-আসন্ন-যুগকে বুকে নিয়ে হাঁটছি, সেই মুহূর্তের কারখানাটা কোথায় বসানো, কাকে ঘিরে সেটার নকশা তৈরি—এই বই সেটা খুলে ধরে। মূল ব্যবসার খবর, প্রযুক্তির বাজার, আর পুঁজি কীভাবে ভবিষ্যতের চেহারা বানায়, সেই সব মিলিয়ে হুয়াং একটা থিয়েটারের মতো উঠে আসেন। উইট বুঝিয়ে দেন, রোবটের দখলে ভবিষ্যত যাবে কি না, তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে মানুষের কল্পনা কোন দিক ঘুরছে।
তিন. মজার গল্পের পুরনো পাণ্ডুলিপি আবার আলোচনায়
মারিনা লিউইক্কার A Short History of Tractors in Ukrainian—প্রকাশের দুই দশক পরে, পেল ভিনটেজ বোলিঞ্জার সম্মান। লেখিকা প্রয়াত হওয়ার মাসখানেক পরে এই পুরস্কার দেওয়া হলো । এই বিশেষ বছরে ‘সেরা হাস্যরসাত্মক উপন্যাস’-এর মুকুটটা তার নামেই গেল। লিউইক্কার বই খোলার সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা যায় যে হাস্যরসের কোনও বৃদ্ধাশ্রম হয় না, পুরনো কৌতুকও সময়ে সময়ে নতুন আলো পায়।
চার. সাইক্লিং, দেহ, পরিচয়ের মিশেল
পিপা ইয়র্ক (পূর্বনাম রবার্ট মিলার) এবং সাংবাদিক ডেভিড ওয়ালশের স্মৃতিকথা The Escape: The Tour, the Cyclist and Me পেল উইলিয়াম হিল স্পোর্টস বুক অব দ্য ইয়ার। ট্যুর দ্য ফ্রান্স আর জিরো দ’ইতালিয়ায় যে দৌড় চলে, তার মাঠের ধুলো যেমন আছে এখানে, তেমনি আছে নিজের শরীরকে চিনে নেওয়ার লড়াই। লিঙ্গ পরিচয় বদলানোর যাত্রাটা যেমন রাজনৈতিক, তেমনি ব্যক্তিগত। যে দেশে খেলোয়াড়ের পরিচয় প্রায়ই জার্সির মতো বদলানো যায় বলে মনে হয়, সেখানেই ইয়র্কের গল্প মনে করিয়ে দেয় যে নিজের সত্যিকারের রূপ খুঁজে বের করা কখনও কখনও রেসের শেষ ধাপের মতো—চালিয়ে যেতে হয়।
প্রত্যেকটি বই আসলে রাষ্ট্রের মুখের দিকে নয়, পাঠকের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে। পুরস্কারের ঢাক ঢোলের ভেতরেও এই সরল সত্যটা বোঝা যায়।



