ক্যাপিটালিজম-বিশ্বজন্তু
১৩০০ পাতার এই বইতে শ্রমিকেরা আছে—তাদের বিদ্রোহ আছে, তাদের প্রতিবাদ আছে, তাদের কারণে welfare state নামক মেকআপ লাগানো হয়েছে পুঁজিবাদের গালে। কিন্তু তাদের মুখ; সেটা খুব কম।
স্ভেন বেকার্ট ক্যাপিটালিজমের এমন ইতিহাস লিখেছেন, যেটা অডেনের বন্দর থেকে শুরু করে ১৩০০ পাতা টলটলিয়ে পৃথিবী ঘোরে। অডেন শুনলেই পাঠকের মধ্যে একটা বহিরাগত গন্ধ আসবে, কিন্তু বেকার্ট বলছেন, “না ভাই, ক্যাপিটালিজম কোনো নেটিভ ইউরোপীয় সন্তান নয়। এটা বরং এক ধরনের গ্লোবাল কোলাজ – কায়রো আর চাংঝো একসঙ্গে মিশে গিয়ে যে খিচুড়ি রান্না করেছে।” এমন রান্নার রেসিপি সাধারণত পছন্দ করেন না ইতিহাসবিদেরা, কারণ Cold War-এ “capitalism” শব্দটাই নাকি অশ্লীল। তখন সবাই বলতেন “the economy,” যেন কেউ হয়তো পেঁয়াজ বলার বদলে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন গোলাকার সবজি বলে হাঁটছে। বেকার্ট সেই চোখ টিপে-যাওয়া ভদ্রলোকদের ডেকে বললেন, “নাম ধরে ডাকো। এই জন্তুটার নাম ক্যাপিটালিজম।”
এবং একবার নাম ধরে ডাকলেই দেখা যায়, সে জন্তুটা বাচ্চা থেকে হয়নি, বরং সাত-সমুদ্র-তেরা-নদী পারাপারের পর জন্মেছে। সওদাগররা তখন অডেন থেকে ভেনিস, ক্যান্টন থেকে কায়রো, চাংঝো থেকে জাঞ্জিবার– এমন ভাবে ছুটছিলেন, দেখে মনে হয় আজকের ‘ডেলিভারি চার্জ ফ্রি’-র ওটিটাই মূল শেকড়।
মধ্যযুগের গা-ঢাকা অন্ধকারে, একেকটি শহর নিজের মতো করে ছোট ছোট পুঁজি-কুটির গড়ে তুলছিল। একটু কায়রোর বণিকের জামা, একটু চাংঝোর সুতা, একটু অডেনের লবণ, আর তাতে মেশানো অভিজাতদের রাগ – “ওরে, টাকায় টাকায় টাকা বানানো? এ তো প্রায় জাদুবিদ্যা।”
তারপর এলো বারবাদোস! তখনকার আখের বাগান আসলে মানব শরীরের উপর চালানো একটি অর্থনৈতিক ল্যাব। সেখানে বেকার্ট দেখাচ্ছেন—চিনি যত মিষ্টি, তার উৎপাদন ততটা দাঁত-খিঁচুনিময়। আর পোটোসি? তার খনি ছিল যেন capitalism-এর প্রথম গডাউন। সেখানে রূপো উঠছে, মানুষ মরছে, আর শহরের ধেপুরা নাচছে সাইলোনের হীরা, নাপোলির মোজা, ভেনিসের কাঁচ, চিনের তৈরি চিনামাটির বাসন নিয়ে। মুনাফার মন্দিরে শ্রমিকের মৃত্যু ছিল একরকম ঘরোয়া রীতি।
সাধারণত ক্যাপিটালিজমের বই মানে হাজারটা গ্রাফ, দশটা স্কিম, আর পাঁচটা দার্শনিক নাম। বেকার্ট সেই জঞ্জাল এড়িয়ে, পাঠককে নিয়ে গেলেন—কখনো medieval merchant hub-এ, কখনো Indian Ocean-এর নোনাধরা চিনি-চর্চায়, কখনো Detroit-এর ইস্পাত-ঘাম-গন্ধওয়ালা এসেম্বলি লাইনে। তারপর এক লাফে নমপেনের সেলাইকলের গেটে। সেখানে এক টেক্সটাইল মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বইয়ের শেষে গিয়ে সেই বাস্তবতা ঢুকে পড়ে জোরালো উপসংহার হয়ে। মন্থনচক্রে শ্রমিকেরা ঘোরায় চক্র, আর দেবতা-সদৃশ মালিকেরা শুধু মাখন তোলো।
বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক Montesquieu আর স্কটিশ দার্শনিক Adam Smith—দুজনেই বলেছিলেন, “বাণিজ্য মানে শান্তি।” যেন টাকা থাকলে সবাই মিলেমিশে লুডো খেলে। কিন্তু বেকার্ট দেখালেন—একদম উল্টো। বাণিজ্য মানেই ছিল কামান, বন্দুক, রক্তের দাগ। ১৬৮৯ থেকে ১৮১৫—Britain আর France মোট ৬৪ বছর যুদ্ধেই কাটিয়েছে। এটা কি শান্তির হোমিওপ্যাথি? ব্যাঙ্কার আর রাজা তখন দুচোখে শুধু একটাই চকচক করত—“সেনাবাহিনীর খরচ কে দেবে?” আসলে মার্কেটের হাত অদৃশ্য ছিল না বরং ছিল গ্লাভস পরা বেশ নির্মম।
বেকার্ট দেখালেন, ক্যাপিটালিজম জন্মেছে হিংসা, দমন আর অবাধ লোভের মিশ্রণে। ঠিক গল্পের Frankenstein-এর মতো; একটা মৃতদেহ, একটা বিজলির চমক, আর অনেকগুলো অসহায় ক্রীতদাসের রক্ত। তিনি নিজের Cotton Empire বইয়ের থিমও টেনে এনেছেন—কীভাবে আটলান্টিক দাসব্যবস্থা শিল্প-বিপ্লবকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, তিনি পালতোলা জাহাজগুলোকে উপেক্ষা করেন—যে জাহাজগুলো ছিল গ্লোবাল বাজার তৈরির আসল ‘গাড়ি’।
১৩০০ পাতার এই বইতে শ্রমিকেরা আছে—তাদের বিদ্রোহ আছে, তাদের প্রতিবাদ আছে, তাদের কারণে welfare state নামক মেকআপ লাগানো হয়েছে পুঁজিবাদের গালে। কিন্তু তাদের মুখ; সেটা খুব কম। ক্যাপিটালিস্টরা পুরো রঙিন চরিত্র পায়; শ্রমিকেরা থাকে পটভূমিতে, দলবদ্ধ ফিগার হিসেবে।
এই বই ভরাট, দামী, এবং মহাদেশ সাঁতরে বেড়ানো। পাঠক যেমনই হোন; সমালোচক, সাধারণ মানুষ, বা অর্থনীতির কোনো ছাত্র; বইটা পড়লেই মনে হবে, “এত বড় জন্তুটাকে ইতিহাসের খাতায় ধরাটা সহজ ছিল না।” বেকার্টের ইতিহাস মূলত বলে; পুঁজিবাদ মানে আমাদের মুনাফার আকাঙ্ক্ষা, আমাদের ভয়ের চর্বি, আর আমাদের ইতিহাসের রক্ত–সব একসাথে মেখে তৈরি একটা বিশ্বজন্তু।
হ্যাপি রিডিং…





