চারু মজুমদার: এক বিপ্লবী ভূতের জীবদেহ
চারু মজুমদার ছিলেন সেই রাঁধুনি, যিনি সমাজতন্ত্রের হাঁড়িতে ভাত বসাতে গিয়ে গোটা রান্নাঘরে আগুন ধরিয়ে দেন। তিনি জনযুদ্ধের কথা বলতেন, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল ‘মানুষ’ই নির্ধারক উপাদান।
রিটন খান
চারু মজুমদার মারা যাননি। তাঁর নখের ফাঁকে জমে থাকা মাটি এখনো দার্জিলিঙে বাতাসে ধুলো হয়ে উড়ে বেড়ায়। ৫৩ বছর! জাতি ভুলে গেছে কংকালের গন্ধে বেঁচে থাকার অভ্যাস, ভুলে গেছে একদা গাঁ-গঞ্জে মাওয়ের মতাদর্শ ঠেসে খাওয়ানোর লালবর্ণ বুলেটিন। ভুলে গেছে—কিন্তু চারু ভুলতে দেননি। তিনি এখন শিয়ালদা স্টেশনের পেছনে একটা জংধরা ব্যারিকেডে বসে পাতিলে ফুটন্ত দার্শনিকতা রাঁধেন, কখনো তিনি পঞ্চাশ বছর আগে লেখা নিজের দলিলগুলো খুলে চা বানান। কড়া, কালো, কামড় বসানো চা।
তিনি ছিলেন এক খসড়া মানুষ, যাঁর গা থেকে শব্দ ঝরে পড়ত। মাওয়ের চোখের জল, লেনিনের গোফের ভাঁজ, দেকার্তের সুষম যুক্তি—সব কিছুকে এক কড়াইয়ে ফেলে বলেছিলেন, “সত্যি বলতে, বিপ্লব হচ্ছে রক্তাক্ত প্রসব। আর তুমি যদি প্রসবকে ভয় পাও, তবে তুমি পুঁজিপতি স্ত্রীর ব্যথাহীন অপারেশনের পাশে দাঁড়াও।”
চারু মজুমদার চেয়েছিলেন একটা রাষ্ট্রের জরায়ু চিরে নতুন এক কৃষক-সন্তান জন্ম দিতে। কিন্তু রাষ্ট্র তো সিজারিয়ানে সন্তুষ্ট ছিল না। সে চেয়েছিল গর্ভপাত। গর্ভপাতের রাজনীতি—একটা রাষ্ট্রকে গর্ভে নিয়েও জন্ম না দেওয়ার বীভৎস দক্ষতা।
তিনি বলতেন, “খতম মানে শুধু হত্যা নয়। খতম মানে, এক অট্টালিকার কাঠামো খুলে এনে চুলায় পোড়ানো।” তাঁর ‘আটটি দলিল’—ভারতের ফুঁসে ওঠা দরিদ্রদের জন্য ছিল একধরনের পরমাণু বোমা, যেটা কেউ পড়ত না কিন্তু সবাই কাঁপত।
চারু জানতেন—পৃথিবী পাল্টাতে গেলে মানুষের ছাল খুলে ভেতরের পোকাগুলোর সঙ্গে কথোপকথনে নামতে হয়। তিনি নামতেন। এক হাতে মার্কস, অন্য হাতে জংধরা হাড়গিলে মুগুর, কাঁধে চাষির কোদাল, মুখে উচ্চারণ: “কৃষি বিপ্লবই রাজনৈতিক শিক্ষা।”
চারু মজুমদার ছিলেন সেই রাঁধুনি, যিনি সমাজতন্ত্রের হাঁড়িতে ভাত বসাতে গিয়ে গোটা রান্নাঘরে আগুন ধরিয়ে দেন। তিনি জনযুদ্ধের কথা বলতেন, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল ‘মানুষ’ই নির্ধারক উপাদান। অস্ত্র তো টুলকিট, হাতিয়ার। বিপ্লব হবে মানুষের বুকে, পেটের খিদেতে, চোখের ঘুমহীনতায়। বিপ্লবের একমাত্র শর্ত: আত্মত্যাগ—না হলে আত্মস্বার্থ। তিনি লিখতেন, “মাঝামাঝি কিছু নেই”—আর রাষ্ট্র, টেলিভিশনের রিমোট হাতে, চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে ফিসফিস করে বলত, “ও আছেন না আর... এখন আমরা খবর পড়ি...”
চারু আজ নেই। বা আছে। বা আধা-আছে। হয়তো বেহালা কিংবা নকশালবাড়ির কোনো কুয়োর ধারে, কোনো স্কুলের ভাঙা দেওয়ালে তাঁর লেখা পড়ে আছে: “ক্ষমতা আসে বন্দুকের নল থেকে।” লোকজন ভুল করে ভাবে ওটা কারো ক্যালিগ্রাফি। অথবা দেয়ালচিত্র।
আসলে চারু মজুমদার কোনো মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক গণহত্যার ব্যাকরণ। এক রাজনৈতিক দণ্ডবিধির ভাঙা শ্লোক। এক আগ্নেয়গিরি, যার মুখে আজ ফুল ফুটেছে, কিন্তু গায়ে এখনো গন্ধক আর ধোঁয়ার রেখা।
তাঁকে নিয়ে কেউ আর কথা বলেন না। মিডিয়া বলে: “ও তো ছিল একটা ভুলপথে হাঁটা নরকের ডাক্তার।” সুশীল সমাজ বলে: “ও তো সন্ত্রাসবাদী।” কিন্তু হঠাৎ কোনো চা-দোকানে, কোনো ছাত্রনেতার উচ্চারণে, হঠাৎ হাওড়ার রেললাইনে পা রাখা কৃষকের চোখে জ্বলে ওঠে চারুর আগুন। কেউ চেনেনা, কিন্তু চেনা লাগে।
চারু মজুমদার মরে যাননি।
তিনি কেবল ছায়া হয়ে গেছেন।
যতদিন রাষ্ট্র থাকবে,
আর রাষ্ট্রে থাকবে অসমতা,
ততদিন তাঁর দলিলগুলো লুকিয়ে থাকবে আমাদের বুকপকেটে।
অবিকল শিরা ছিঁড়ে যাওয়ার প্রস্তুতির মতো।
সালুট, কমরেড। তোমার মৃত্যু বারবার হবে। কিন্তু শেষ কোনোদিন হবে না।