কনজিউমারিজম বা ভোগবাদ: সামাজিক অবক্ষয়
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ভোগবাদ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো জনগণের মনোযোগ মূল সমস্যা থেকে সরিয়ে দেওয়া।
আমেরিকার বর্তমান সমাজব্যবস্থায় এক গভীর বৈপরীত্য প্রকট আকার ধারণ করেছে । যেখানে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং ব্যাপক কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো গুরুতর সমস্যা বিদ্যমান, সেখানে প্রাপ্তবয়স্করা আবার ‘টেডি বিয়ার’ আকৃতির কাপ বা খেলনার মতো তুচ্ছ পণ্য সংগ্রহে উন্মত্ত হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। আধুনিক ভোগবাদ কেবল পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক মানদণ্ডেরও অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। বর্তমান ভোগবাদী সংস্কৃতি আসলে একটি সুপরিকল্পিত পদ্ধতিগত কৌশল, যা জনগণের মনোযোগ অপ্রয়োজনীয় পণ্যের মোহে আচ্ছন্ন রেখে অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবিচার এবং কাঠামোগত শোষণের মতো মৌলিক সমস্যাগুলি থেকে কৌশলে সরিয়ে দেয়।
ভোগবাদের বর্তমান ধারাটি অতীতের তুলনায় অনেক বেশি অযৌক্তিক এবং আসক্তি-নির্ভর। পূর্বে মানুষ ভিডিও গেম বা আইফোনের মতো পণ্যের জন্য অপেক্ষা করত, যা তারা দীর্ঘস্থায়ীভাবে ব্যবহার করত । কিন্তু বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে নিত্যনতুন অকেজো পণ্য দ্রুত ভাইরাল হচ্ছে—যেমন স্ট্যানলি পানির বোতল বা স্টারবাকসের গ্লাস, লাবুবু। এই পণ্যগুলিকে কৃত্রিমভাবে দুষ্প্রাপ্য করে মানুষের মনে ‘ফোমো’ (FOMO - Fear Of Missing Out) বা হারানোর ভয় সৃষ্টি করা হয় । এই প্রবণতা সমাজকে নির্বোধ করে তুলছে এবং মানুষকে আবেগতাড়িত শিশুর মতো আচরণ করতে বাধ্য করছে ।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ভোগবাদ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো জনগণের মনোযোগ মূল সমস্যা থেকে সরিয়ে দেওয়া। এই কৌশল অনুযায়ী, পুঁজিপতি ও কর্পোরেশনগুলো বিভিন্ন খেলনা, গ্যাজেট এবং ট্রেন্ডের মাধ্যমে জনসাধারণকে এমনভাবে শান্ত রাখে, যেমন ইনজেকশন দেওয়ার সময় শিশুকে ললিপপ দিয়ে ভুলিয়ে রাখা হয়। যখন মানুষ ব্ল্যাক ফ্রাইডে ডিল বা নতুন আইফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন তারা সমাজের কাঠামোগত সমস্যা, যেমন মজুরি স্থবিরতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বা গৃহহীনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ পায় না। এটি একটি সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণকে তুচ্ছ ও ভোগের বিষয়ে ব্যস্ত রেখে ধনী শ্রেণী নির্বিঘ্নে তাদের সম্পদ বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে চলে।
ভোক্তাদের এই কেনাকাটার পেছনে একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ কাজ করে, যা ‘প্রেশার ভালভ থিওরি’ নামে পরিচিত। যখন মানুষ অর্থনৈতিকভাবে নিরাপত্তাহীন এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নতায় ভোগে, তখন তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভের জন্ম হয়। তারা সরাসরি তাদের ঊর্ধ্বতনদের ওপর এই ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে না। ফলে, এই অবদমিত রাগ শপিং মল বা দোকানের কর্মীদের ওপর অযৌক্তিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়]। এছাড়াও, জীবনের বড় বিষয়গুলোর (যেমন: বাড়ি কেনা বা ঋণ পরিশোধ) ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলে, মানুষ ছোটখাটো জিনিস কেনার মাধ্যমে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণের একটি মিথ্যা অনুভূতি তৈরি করার চেষ্টা করে । ক্ষণস্থায়ী আনন্দ বা ডোপামিনের জন্য মানুষ এই অনিয়ন্ত্রিত কেনাকাটায় আসক্ত হয় ।
সামাজিক সংহতি বিনাশ এবং সমাধানের পথ ভোগবাদী সংস্কৃতি মানুষের সময়, মনোযোগ এবং যোগাযোগের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়, যা কোনো সামাজিক পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য। মানুষকে বিভিন্ন ছোট ছোট ভোক্তা গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে রাখা হয়, যাতে তারা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে না পারে। এই চক্র থেকে বের হওয়ার উপায় হলো আত্মসংযম এবং নিজের চাহিদাকে পুঁজিবাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে না দেওয়া । প্রকৃত সুখ পণ্য ক্রয়ের মধ্যে নয়, বরং আর্থিক নিরাপত্তা, বিশ্রাম এবং মানসিক প্রশান্তির মধ্যে নিহিত। যখন একজন ব্যক্তির কোনো অপ্রয়োজনীয় চাহিদাই থাকে না, তখন তাকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভভব হয়ে পড়ে।
ভোগবাদ কেবল একটি সাধারণ কেনাকাটার অভ্যাস নয়; এটি জনমতকে ভুল পথে চালিত করে মস্তিষ্ককে অসাড় করার একটি সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত। এর মাধ্যমে মানুষকে পদ্ধতিগত শোষণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ক্ষণস্থায়ী আনন্দের বিনিময়ে তাদের দীর্ঘমেয়াদী সুখ ও মানবিক মূল্যবোধ কেড়ে নেওয়া হয়। এই ভোগবাদী ফাঁদ থেকে মুক্তি পেতে হলে সচেতনভাবে প্রশ্ন করতে হবে, অপ্রয়োজনীয় ভোগ পরিহার করতে হবে এবং বস্তুগত লাভের চেয়ে মানসিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে গুরুত্ব দিতে হবে।



