ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস
ওয়ালেস সবসময় ভয় পেত মানুষ একসময় এত বিনোদনের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে যে নিজের সাথে বসতে পারবে না। আমরা হয়েছি তাই। একটানা মনোযোগ, বইয়ের ওপর ঝুঁকে থাকা বা কোনো কাজে ডুবে থাকার ক্ষমতা আমরা হারিয়ে
ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসকে যতবার পড়ি, মনে মনে নিজের গালে হালকা চড় লাগাই। একধরনের ভালোবাসা মিশ্রিত অভিমান ভর করে। আমি যতবারই তার কোনো উক্তি বা হা-হুতাশে ভরা সাক্ষাৎকারের ক্লিপ দেখি, ততবারই একরাশ বইয়ের পাতার মধ্যে ডুবে যাই। Infinite Jest-এর হাজার পাতার অহংকার নয়, কিংবা Pale King-এর অবিরাম অফিসঘুম নয়—আমাকে টানে তার সেই অদ্ভুত প্রজ্ঞা, যা আমাদের কালকে আজকের মতো চিনত। এই লোকটা ’৯০ আর ’০০ দশকে লিখতে লিখতেই বুঝেছিল, মানবসভ্যতা ঠিক এখনকার মতো এক অদ্ভুত ভোগবাদী উন্মাদনায় গড়িয়ে যাবে। মোবাইল স্ক্রিনের প্রেম, ফেসটাইমের ভদ্রসম্মত উঁকিঝুঁকি, বিউটি ফিল্টারের পর্দা, অগণিত উল্লাস-উত্তেজনাময় কনটেন্টের স্রোত—সবকিছুর মরণফন্দি যেন সে আগেভাগেই দেখে ফেলেছিল।
Wallace-এর কথার মধ্যে একধরনের দুঃখমাখা গম্ভীরতা, যেন হেসে ফেললেই সে অপরাধ করবে। Infinite Jest-এ সে যে নেশা, হতাশা আর টেলিভিশনের হিপনোসিস আঁকল, সেটাই আজ আমাদের চশমার ভেতরকার আলো। Pale King-এ যে অনন্ত বিরক্তি আর শূন্যতার অফিস, সেটা এখন আমাদের মস্তিষ্কে ইনস্টল হয়ে গেছে। মানুষ আজ আর একা থাকতে জানে না, একা থাকতে পারলে বুকের ভেতর কেমন যেন থমথমে গহ্বর তৈরি হয়। সেই গহ্বর ঢাকতে আমরা রিল দেখি, শর্ট দেখি, শূন্য দেখি। আর সেই গহ্বরের প্রান্তে ওয়ালেস আগেভাগেই বসে ছিল, নিজের জন্য ছোট্ট এক্সিট র্যাম্প বানিয়ে রেখেছিল।
ওর জীবনটাই যেন নিজের লেখার প্রমাণ। নেশা, অবসাদ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা—সবকিছু মিলিয়ে সে মানুষের এক্স-রে করেছে। তখনো মুক্ত ইন্টারনেট পর্ন, কৃত্রিম অন্তরঙ্গতার বাজার, এবং ভার্চুয়াল বাস্তবতার প্রথম হাতছানি শুরু হয়েছে। Wallace বুঝেছিল, এই “সুখশিল্প” মানুষকে একদিন তীব্র নিঃসঙ্গতার মধ্যে ঠেলে দেবে। তার ভাষায়—আমরা একদিন স্ক্রিনের সাথে এমন বন্ধন গড়ব, যাদের কাছ থেকে আমরা কোনো ভালোবাসা পাই না, তারা শুধু আমাদের টাকা চায়। কিন্তু আমরা থাকব, চোখের পাতার নিচে অন্ধকার গড়ে তুলব, তারপর একদিন চুপ করে ভেতর থেকে মরে যাব।
আজ আমরা হাসির ইমোজিতে বিদ্রুপ করি, বিজ্ঞাপন নিজেই নিজের নাক কেটে কুলাঙ্গার সাজে, পডকাস্ট “অন্তরঙ্গতা” বিক্রি করে, আর সংবাদ আমাদের ভয়ের টনিক হয়ে থাকে। “সত্যতা”র বাজারদর পড়ে গেছে। সবকিছুই অভিনয়, সবকিছুই অ্যাফেকটেশন। এই হাইপাররিয়ালিটির ফাঁদে আমরা রিলেশনশিপ, খবর, এবং নিজের মনের ভেতরকেও আউটসোর্স করে ফেলেছি। আর সোশ্যাল মিডিয়া নামের অ্যাম্ফিথিয়েটারে আমরা প্রতিদিন নিজেদের ছোট ছোট আত্মহত্যা দেখি—লাইক, ভিউ, ডোপামিন।
Wallace সবসময় ভয় পেত মানুষ একসময় এত বিনোদনের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে যে নিজের সাথে বসতে পারবে না। আমরা হয়েছি তাই। একটানা মনোযোগ, বইয়ের ওপর ঝুঁকে থাকা বা কোনো কাজে ডুবে থাকার ক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ওর কণ্ঠস্বর এখনও কানে বাজে—যেন ভিতরে একটা যন্ত্র বানাতে হবে, যেটা আমাদের শেখাবে এই অবিরাম আনন্দের সাথে কীভাবে বাঁচতে হয়।
ওর লেখার সবচেয়ে মূল্যবান দিকটা ছিল সৎ থাকা—প্রাণপণে, রক্তপাত করে, ঘাম ঝরিয়ে। ওর ছোটগল্প My Appearance-এ কিংবা বিখ্যাত প্রবন্ধ E Unibus Pluram-এ সে এই অসহ্য বিদ্রুপময় মিডিয়া সংস্কৃতিকে আয়নায় ধরেছিল। সেখানে সে বলেছিল, ব্যঙ্গ আর বিদ্রুপে আমরা এতটাই স্বচ্ছন্দ যে পাখির খাঁচাকে ভালোবেসে ফেলেছি। সত্যিকারের আত্মপ্রকাশ হারিয়ে গেছে, সবকিছু “লাগছে” বলে সাজানো। ওর চোখে আজকের ইনফ্লুয়েন্সাররা হয়তো শুধু চলমান প্রলাপ।
কিন্তু এইসব ভবিষ্যদ্বাণীর ভেতরেও ওর হাতে কোনো প্রতিষেধক ছিল না। Pale King-এ এক ঝলক পাওয়া যায়—মানুষকে “unborable” হতে শিখতে হবে। অর্থাৎ, বিরক্তি, শূন্যতা, একাকীত্বকে সহ্য করতে শিখতে হবে। অন্য কোনো শর্টকাট নেই। আর This is Water-এ যে শান্ত উপদেশটা সে দিয়েছিল—সচেতন হও, মনোযোগ দাও—সেটাই হয়তো তার শেষ চেষ্টা ছিল আমাদের বাঁচানোর।
আজ আমরা, যাদের হাতে অসীম আনন্দের গ্যাজেট, আসলে আরও দুঃখী। Wallace না থাকলেও, তার আতঙ্ক আমাদের হাড়ে মাংসে ঢুকে গেছে। আর প্রতিবার আমি ওর কোনো লাইন পড়ি, মনে হয় সে কোথাও বসে মুচকি হেসে বলছে—“দেখলে তো? আমি তো আগেই বলেছিলাম।”
আমরা একদিন স্ক্রিনের সাথে এমন বন্ধন গড়ব, যাদের কাছ থেকে আমরা কোনো ভালোবাসা পাই না, তারা শুধু আমাদের টাকা চায়। কিন্তু আমরা থাকব, চোখের পাতার নিচে অন্ধকার গড়ে তুলব, তারপর একদিন চুপ করে ভেতর থেকে মরে যাব।