আমি সবকিছুর মধ্যে বইয়ের গন্ধ পাই। এই কথা বললেই আমার মনে পড়ে যায়—যেন কল্লোল যুগের কোনও চরিত্র ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই বলে উঠছে, "চা দাও না গো, একটা গদ্য পড়ে ফেলি!" কিংবা আমার যখন বালকবেলায় ঘুম ভাঙে উপন্যাসের গন্ধে, আর মা ভাবে হজমের গোলমাল। স্টিভ জবস যেমন ‘There’s an app for that’ বলে আমাদের স্মার্টফোন-পাঠ্য জীবনের অ্যারিস্টটল হয়ে উঠেছিলেন, আমি বলি—‘There’s a book for that’—বইয়ের পাতা মানে মগজের আয়না। সেখানে সব দেখা যায়, শুধু নিজেকে ছাড়া। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেউ হয়ত এই বিষয়ে (যেটা আমি বলতে যাচ্ছি) আগ্রহী নয়। কিন্তু কে না জানে, আটলান্টিকের ওপারের ঝড়ে এপারও নড়ে। এবার মূল গল্পে ঢোকা যাক।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আজ কংগ্রেস লাইব্রেরিতে যে প্রদর্শনীর সূচনা হয়েছে, তার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে ২৫০ বছর আগেকার গুপ্তচরবৃত্তির কিছু নিদর্শন—যেন ইতিহাস নিজেই এক ঠাণ্ডা নিশ্বাস ফেলে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, স্বাধীনতার সেই যুদ্ধ একেবারেই নিছক তলোয়ার আর বন্দুকের ব্যাপার ছিল না। প্রদর্শনীর শিরোনাম: “The Two Georges: Parallel Lives in an Age of Revolution.” একদিকে জর্জ ওয়াশিংটন—উপনিবেশের বিদ্রোহী নায়ক, অন্যদিকে রাজা তৃতীয় জর্জ—এক বিপন্ন সাম্রাজ্যের প্রতীক। দুজনের জন্মের ব্যবধান মাত্র ছয় বছর, দেখা কখনো হয়নি, তবু ইতিহাসের ভেতর তাঁরা চিরকালের জন্য যুক্ত—প্রথমে সহনাগরিক, পরে শত্রু, অবশেষে দুই বিপরীত ভাবধারার প্রতিভূ।
এই প্রদর্শনীতে রয়েছে ওয়াশিংটনের গুপ্তচর রিংয়ের কোডবুকের একটি পাতা, যেখানে নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে বিভিন্ন কাজ, স্থান, এমনকি ব্যক্তিত্বদের। ৭১১—এই সংখ্যাটিই ছিল জর্জ ওয়াশিংটনের কোড নাম। পাশাপাশি রয়েছে একটি নিষ্পাপ চিঠি, যার ফাঁকে-ফাঁকে অদৃশ্য কালি দিয়ে লেখা আছে গোপন বার্তা। হঠাৎ করে যখন এগুলোর দিকে তাকাই, তখন চমকে উঠতে হয়—১৮শ শতকের এই গোপনযোদ্ধারাই যেন আমাদের বর্তমান প্রতিরক্ষা সচিবের চেয়েও কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা অনুসরণ করতেন!
এদিকে, আজকের বাস্তবতা—দুঃখজনক হলেও সত্যি, ট্রাম্প শিবিরের বোধহয় এখনও All the President’s Men পড়া হয়ে ওঠেনি। পড়লে অন্তত “Deep Throat” কী জিনিস সেটা বুঝতে পারত, কিংবা কেন রাজনীতিতে প্রতিশোধের চেয়ে গোয়েন্দাগিরি বেশিক্ষণ টিকে যায়। এখন তারা শুধু নিজেদের বোকা নয়—প্রতিষ্ঠানগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ও আত্মঘাতীও প্রমাণ করছে।
আমরা এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে আছি, যেখানে হোয়াইট হাউসের ভেতরে বসেই কারা যেন ঘুঁটি চালছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন খুবই সচেতনভাবে এবং শিল্পসম্মতভাবে “গোপন তথ্য ফাঁস” কৌশল কাজে লাগাচ্ছে। এবং তা এত নিখুঁতভাবে করা হয়েছে যে, এটা যে কোনও সাধারণ leak নয়, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা একটি “cell”—একটি সচেতন, গোপন অথচ কার্যকর প্রতিরোধ আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ।
প্রথম ফাঁসের টার্গেট ছিল ইলন মাস্ক। তাকে বাইরের লোক হিসেবে, কোনো clearance ছাড়াই, পেন্টাগনের "Operational Plan" সম্পর্কে অবগত করানো হচ্ছিল। তার আগেই The New York Times-এর কাছে সেই briefing-এর সরকারি আদেশ পৌঁছে যায়।
দ্বিতীয় ফাঁসটা আরও নাটকীয়: Atlantic পত্রিকার সম্পাদককে—হ্যাঁ, সম্পাদকে—হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টাদের Signal group chat-এ যুক্ত করে দেওয়া হয় যেখানে ইয়েমেনে হুতি নেতাদের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা চলছিল। জায়গাটা? Palm Steakhouse, হোয়াইট হাউসের পাশের রেস্তোরাঁ। গরুর স্টেক, মার্টিনি আর মিসাইল অ্যাটাক—সব এক জায়গায়!
এখানে আমরা ঠিক যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখছি। মার্ক ফেল্ট যেমন Watergate স্ক্যান্ডালে নিক্সনকে ধ্বংস করেছিল, ঠিক তেমনই এখন হোয়াইট হাউসের ভেতরেই জন্ম নিচ্ছে একাধিক Deep Throat। তবে এবারে তারা একক নয়, বরং একটি সচেতন সংগঠিত “cell”—হয়তো কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা, NSC সদস্য বা সেইসব কর্মকর্তা যারা আদর্শিকভাবে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে।
এই ব্রিফিংটি “leak” হওয়ার ধরন দেখলেই বোঝা যায়, এটি ছিল একটি surgical strike। The New York Times-এর হাতে briefing-এর সরকারি আদেশ পৌঁছায় ঠিক briefing শুরুর ১২ ঘণ্টা আগে। সময়ের এই সূক্ষ্মতা এবং হিসাবি নাটকীয়তা দেখে বোঝা যায়, এটি কোনও অজ্ঞাত কর্মচারীর ভুল ছিল না, বরং হেলমেট পরা কোনো “অভ্যন্তরীণ সৈনিক”-এর কৌশল।
মাস্ক তখন Pentagon-এ যাচ্ছেন। অভ্যর্থনায় “The Tank” এর ব্রিফিং রুম প্রস্তুত, অফিশাররা দাঁড়িয়ে, ম্যাপ আর স্লাইড সাজানো, ঠিক তখনই Times খবর ছাপায়। হোয়াইট হাউস সঙ্গে সঙ্গে মিটিং বাতিল করে। মাস্ককে বলা হয়, ভুল হয়েছে। তিনি অপমানিত হন, মুখ বেজার করে বেরিয়ে যান। উদ্দেশ্য সফল—“exposure and humiliation”.
হোয়াইট হাউসের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা, Steakhouse-এ বসে স্টেক ও ফ্রাই খেতে খেতে হুতি বিদ্রোহীদের উপর মিসাইল অ্যাটাক প্ল্যান করছে—এটাই কি রাষ্ট্র? এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কেন একটি সিগারেটের প্যাকেটের মতো অরক্ষিত Signal group chat-এ নেওয়া হচ্ছে?
সবচেয়ে মজার অংশ হলো, সেই Signal group-এ যুক্ত করা হয়েছে Atlantic ম্যাগাজিনের সম্পাদকে—সম্ভবত একজন হ্যাকার বা অন্তর্ঘাতকারী পরিকল্পনা করেই এই চেন ভেঙে দিল।
এটা কি accident? নাকি planned sabotage?
আমাদের মত হলে আমরা বলতাম, অবশ্যই এটা পরিকল্পিত। কারণ এতটা পরিপাটি ভুল কেবল সিনেমাতেই হয়।
ট্রাম্পের ভাষায়, “WITCH HUNT!”—এবং এখানে তিনি হয়তো একদিক থেকে ঠিকই বলছেন। তবে এই উইচ, তার নিজের ক্যাবিনেটের ভেতরে। এসব leak আসলে প্রেসিডেন্টকে নিজের ফাঁদে ফেলানোর এক কৌশল। তিনি নিজের লোকদের হাতেই প্রতারিত হচ্ছেন।
এই “cell” যা করছে তা হলো—বারবার রাষ্ট্রের গোপনতা ফাঁস করে প্রেসিডেন্টকে রাজনৈতিকভাবে অযোগ্য প্রমাণ করা। এ যেন “legitimacy erosion” এর এক সূক্ষ্ম লাইন। প্রেসিডেন্ট আর দেশের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা যখন নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস রাখতে পারেন না, তখন গণতান্ত্রিক ক্ষমতার ভিত্তি নিজেই কাঁপতে থাকে।
একটা স্পষ্ট বার্তা এই যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিতরে বসেই একটা সংগঠিত অংশ এখন ট্রাম্পের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করছে। তারা কেবল নীরব বিরোধিতা করছে না, বরং কৌশলগতভাবে তার প্রতি আঘাত হানছে। এবং এটি কোনো “liberal conspiracy” নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বিগ্ন একদল অভ্যন্তরীণ কর্মীর কর্মকাণ্ড।
তারা কোনও JFK নয়, কোনও CIA coup নয়, বরং নিজেদের “institutional dignity” রক্ষা করতেই এগিয়ে এসেছে। কেউ আর মুখ বুজে চুপ করে থাকতে রাজি নয়। এই অবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিটি ভুল—হোক তা একটি steakhouse dinner হোক বা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিকে “brag rights” দেওয়ার অপচেষ্টা—একটি নতুন চক্রের হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
ট্রাম্প বা তার টিম যদি সত্যি ভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করতে চায়, তাহলে “All the President’s Men” পড়া জরুরি। কারণ ইতিহাস বারবার বলে, ক্ষমতা কখনোই কেবল ভাষণে টিকে থাকে না—বিশ্বাস, বুদ্ধিমত্তা ও সতর্কতার মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়। এবং এখনকার leak-গুলো যেভাবে খেলা বদলাচ্ছে, তাতে ট্রাম্পের উচিত সাবধান হওয়া—না হলে শীঘ্রই Oval Office একটি খালি স্টেজে পরিণত হবে, যেখানে দর্শক নেই, applause নেই, কেবল মঞ্চের উপর এক ফাঁকা মাইক পড়ে থাকবে।
এইসব বার্তা নিয়ে আজ কংগ্রেস লাইব্রেরির দেয়ালে জ্বলজ্বল করছে ইতিহাসের সেই পুরনো ছেঁড়া কাগজ—আর আমরা, আধুনিক মানুষ, নিজের মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে ভাবছি, “Maybe George knew better.”















