নারীবাদ, ন্যারেটিভ আর ৯২০ ডলারের টি-শার্ট
আদিচি এমন এক বিরল প্রজাতির লেখক, যিনি কথাসাহিত্য আর নন-ফিকশনের দুনিয়ায় সমান স্বচ্ছন্দ, যেন এক হাতে কলম আর অন্য হাতে মেগাফোন। একদিকে তিনি ধ্রুপদী সাহিত্যিক, অন্যদিকে জনতার কণ্ঠস্বর।
বইচর্চা
রিটন খান
দীর্ঘ সময়ের পর চিমামান্ডা এনগোজি আদিচির তৃতীয় উপন্যাস প্রকাশ পেয়েছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে তিনি অবসর সময়ে খাতার পাতা ভরতে গিয়েছিলেন। বরং জীবন যখন তার ওপর অতল গম্ভীর ফ্রেঞ্চ প্রেসের মতো চেপে বসেছিল, যখন ব্যক্তিগত শোক আর বেদনাগুলো একেকটা পাথরের মতো তার অস্তিত্বে জায়গা করে নিচ্ছিল, তখনই লেখা হয়ে গেল এই উপন্যাস। একরকম বেঁচে থাকার হাতিয়ার হিসেবেই।
এই গল্পে চারজন আফ্রিকান নারীর জীবন একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, সম্পর্ক বলতে যা বোঝায়, তার সংজ্ঞা এখানেই এসে নতুন করে লেখা হয়। মাতৃত্ব এখানে নিছক একটা অনুভূতি নয়—একটা অতল গহ্বর, যার একদিকে আগলে রাখার প্রবল দায়িত্ব, অন্যদিকে ক্লান্তি, হতাশা আর নিঃসঙ্গতার ভয়াবহ ভার। যেন এক দেয়াল, যেটা একদিকে সংসারের ঝড়ঝাপটা থেকে রক্ষা করে, আবার কখনো নিজেই ধসে পড়ে সময়ের ভারে।
এখন পাঠকের কপালে একটা ভাঁজ পড়তে পারে—উপন্যাসটা কি অতই গুরুগম্ভীর? নাহ, জীবনের মতোই, এখানে রয়েছে আনন্দের লুকোচুরি, ভালোবাসার ছোট ছোট রোদ্দুর আর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ। কারণ শেষমেশ, ভালো উপন্যাস তো সেই, যেটা আমাদের চেনা বাস্তবতার মধ্যে থেকেও অচেনা কিছু দেখিয়ে দেয়।
Dream Count আদিচির শুধু একটা উপন্যাস নয়, এটা আসলে এক নিঃশব্দ সংলাপ, যা তিনি চালিয়েছেন তার প্রয়াত মা, গ্রেস ইফেওমা আদিচির সঙ্গে—যে মা, ২০২১ সালের মার্চে বিদায় নিলেন এমনভাবে, যেন বাতাস থেকে কোনো গাছের পাতা খসে পড়ল, নিঃশব্দে, অথচ ফাঁকা করে দিয়ে গেল গোটা আকাশটাকে। এই বইটা সেই শূন্যতার দিকে তাকিয়ে লেখা, যে শূন্যতা নিছক অনুপস্থিতির নয়, বরং এমন এক অনুভূতির, যা শব্দের আড়ালে থেকে যায়, দমবন্ধ করা শোকে পরিণত হয়, আর অস্তিত্বের আনাচে-কানাচে ছায়ার মতো লেগে থাকে।
তাই একদিক থেকে দেখলে, এই বইটা তো শুধুই কাগজ-কালির ব্যাপার নয়, বরং একটা নরম মেঘের মতো, যেখানে লেখার প্রতিটি ছত্রে আছে মায়ের স্পর্শ, স্মৃতির একেকটা সূক্ষ্ম রেশ। মা তো শুধু জন্ম দেন না, তিনি থেকে যান—অদৃশ্য সুতোর মতো, যেটা জীবনের একেকটা ভাঁজে জড়িয়ে থাকে, নিঃশব্দে, কিন্তু অমোচনীয়ভাবে। এই বই তারই প্রমাণ, আর তাই স্বাভাবিকভাবেই, উৎসর্গ করা হয়েছে তাকে—শুধু এক মাকে নয়, এক শাশ্বত অস্তিত্বকে, যিনি জীবন দিয়ে যান, অথচ কখনো হারিয়ে যান না।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, "আমি বুঝতেই পারিনি যে, আমি আমার মাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখছি," যেন কথাটা বলার মধ্যেই নিজেকে ধরে ফেললেন। "আমি তো ভেবেছিলাম, আমি নারীদের পারস্পরিক বন্ধন নিয়ে লিখছি।" কিন্তু আসলে? প্রতিটি বাক্যের ফাঁকে লুকিয়ে ছিল এক নীরব প্রার্থনা, এক দমবন্ধ করা শূন্যতা। একরাশ কথা না-বলার যে আর্ট, আদিচি সেটাই নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করেছেন। "আমি শুধু চাই, তিনি ফিরে আসুন।"
আদিচি এমন এক বিরল প্রজাতির লেখক, যিনি কথাসাহিত্য আর নন-ফিকশনের দুনিয়ায় সমান স্বচ্ছন্দ, যেন এক হাতে কলম আর অন্য হাতে মেগাফোন। একদিকে তিনি ধ্রুপদী সাহিত্যিক, অন্যদিকে জনতার কণ্ঠস্বর। The New Yorker-এর সূচিপত্রে তার নাম থাকা যতটা স্বাভাবিক, British Vogue-এর প্রচ্ছদে তার মুখ দেখা ততটাই অনিবার্য। কেউ যদি ভাবে এটা নিছক প্রতিভার খেলা, তাহলে ভুল করবে—এর পেছনে আছে এক নির্মম স্পষ্টবাদিতা, এক অনমনীয় সাহস, আর সত্য উচ্চারণের সেই ক্ষমতা, যা আজকের দুনিয়ায় ক্রমশ বিলুপ্তপ্রায়।
আর ইদানীং, তার কলম যেন আরও বেশি ব্যক্তিগত, আরও বেশি অনিবার্য বাস্তবতায় জড়িয়ে যাচ্ছে—শোকের সঙ্গে। Notes on Grief-এ তিনি লিখেছিলেন, বাবার মৃত্যু তাকে শিখিয়েছে শোকের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক ঠিক কেমন—ভাষা কতটা অসহায়, কতটা ব্যর্থ, আর সেই ব্যর্থ ভাষাকেই হাতের মুঠোয় ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা। যেন শোকের সাম্রাজ্যে ভাষা এক নির্বাসিত রাজা, যার রাজদণ্ড থাকলেও শাসনক্ষমতা নেই।
ব্যাপারটা একেবারেই নতুন নয়। মানুষের দুঃখ যত গভীর হয়, ভাষা ততটাই গুটিয়ে যায়, সংকুচিত হতে থাকে। আমাদের রবীন্দ্রনাথও তো জানতেন এই সংকটের কথা, তাই লিখেছিলেন—"অকথিত আবেগের ব্যথা সই। মন বলে, কথা কই কথা কই!" অথচ, এই না-বলা কথাগুলোকেই আঁকড়ে ধরার মরিয়া চেষ্টায় কলম হাতে বসে থাকেন লেখকেরা।
মৃত্যু মানুষের ভাষাকে একেবারে দাঁতে দাঁতে চিবিয়ে ফেলে, শব্দগুলো গলায় দলা পাকিয়ে আটকে যায়, আর আমরা অসহায়ভাবে বসে থাকি—শব্দের সেই দুঃসহ অক্ষমতার মুখোমুখি, এক অসম লড়াইয়ে।
তবে আদিচির লড়াই নতুন নয়। তার প্রথম দুটি উপন্যাস—Purple Hibiscus (২০০৩) এবং Half of a Yellow Sun (২০০৬)—পাঠকমহলে প্রশংসিত হয়েছিল, যেমনটি হয়েছিল তার গল্পসংকলন The Thing Around Your Neck (২০০৯)। সে এক অন্য সময় ছিল—যখন তার কলম বিপ্লব, প্রেম আর ইতিহাসের পরতে পরতে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু সময় বদলায়, গল্প বদলায়, আর শোকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্কও নতুন মাত্রা পায়।
কিন্তু সাহিত্যের রঙ্গমঞ্চে তার সত্যিকারের রাজকীয় অভিষেক ঘটল Americanah (২০১৩)-এর হাত ধরে। এটা নিছক এক নাইজেরিয়ান তরুণীর আমেরিকায় নিজের জায়গা খোঁজার গল্প নয়; বরং এক অভিবাসী চেতনার মহাকাব্যিক ক্যানভাস, যেখানে জাত, বর্ণ, শ্রেণি, অভিজাত্য ও প্রান্তিকতা একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে, কখনও সংঘাতে, কখনও সহাবস্থানে। এটা এমন এক উপন্যাস, যা ব্যক্তিগত স্মৃতির গণ্ডি পেরিয়ে সমাজের বিবর্তনের পাঠশালায় এসে দাঁড়ায়, যেখানে গল্প নয়, প্রতিটি বাক্য যেন এক দীর্ঘ প্রতিধ্বনির জন্ম দেয়।
আর এই বই-ই আদিচিকে এমন এক সাহিত্যিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নিয়ে গেল, যেখানে তিনি আর কেবল অভিজাত বুদ্ধিজীবীদের বইয়ের তাকের অলংকার হয়ে থাকলেন না। বরং সুসজ্জিত চেইন বুকস্টোরের কাঁচের জানালায় জায়গা পেলেন, সেইসব লেখকদের কাতারে, যাদের নিয়ে শুধু সাহিত্যের ক্লাবে নয়, পপ-কালচারের আলোচনাতেও বিস্তর কথা হয়। এক অর্থে, তিনি হলেন আমাদের সময়ের সেই সাহিত্যিক, যিনি একসঙ্গে নিউ ইয়র্কের কোনো সেমিনারে নোবেল সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুনছেন, আবার হঠাৎই দেখা যাচ্ছে, Beyoncé-র সাক্ষাৎকারে তার বই নিয়ে উচ্ছ্বাস চলছে। ঠিক যেমন একদিন জেমস জয়েস ছিলেন ডাবলিনের, কিংবা Toni Morrison ছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান অভিজ্ঞতার এক অমোঘ কণ্ঠস্বর—ঠিক তেমনই, আদিচিও হয়ে উঠলেন এই শতকের অনিবার্য সাহিত্যিক আইকন।
সাহিত্য যখন সাহিত্যের সীমানা ছাড়িয়ে বাজারের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করে, তখন তার পরিচয়ও বদলে যায়—একদিকে এর পরিধি বাড়ে, অন্যদিকে কপালের টিপটাও ফিকে হয়ে যায়। আদিচি সেই লেখকদের দলে, যাঁরা গল্পের জানালা খুলে বাইরে সূর্যের আলো ঢুকতে দিয়েছেন, পাঠককে টেনে এনেছেন শুদ্ধ সাহিত্যের একচিলতে নির্জনতায় না ফেলে, বরং তাকে বাজারের গোলমালে শামিল করেছেন।
বইটা শুধু আমেরিকায়ই বিকিয়েছে মিলিয়নের ওপর কপি। The Times একে ২০১৩ সালের সেরা দশটি বইয়ের তালিকায় রেখেছিল, আর আদিচিকে ঘোষণা করেছিল এক "নির্ভীক লেখক" হিসেবে—যাঁর কলম মানুষের বহুমাত্রিক সত্তা ও সংস্কৃতির সংঘর্ষ গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারে।
এমন স্বীকৃতি তাঁর জন্য নতুন নয়, কিন্তু এর তাৎপর্য অনন্য। নাইজেরিয়ার মতো একটি প্রান্তিক সাহিত্য-ভূখণ্ড থেকে উঠে এসে একজন নারী লেখক পশ্চিমের সাহিত্যে নিজের জায়গা করে নেবেন—এটা কেবল বাণিজ্যের খেলা নয়, এটা সাংস্কৃতিক টেকটোনিক শিফট। আদিচি শুধু জনপ্রিয় লেখক নন, তিনি এমন এক কণ্ঠস্বর, যা সাহিত্যের মানচিত্র বদলে দিতে পারে। Americanah যেন প্রমাণ করল, আফ্রিকার সাহিত্য কেবল আফ্রিকার জন্য নয়।
পাঠকেরা শুধু গল্প চান না—তারা চান এমন এক দৃষ্টি, যা তাদের চেনা জগতকে নতুন করে ব্যাখ্যা করতে পারে, এমন এক ভাষা, যা পরিচিতকে অচেনার মোড়কে মেলে ধরে, এমন এক আলো, যা দেখার কোণটাই পাল্টে দেয়। আদিচি সেই কাজটাই করেছেন—গল্পের সূক্ষ্ম বুননে, চরিত্রের গভীরে, আর সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা সংঘাতকে নির্ভীকভাবে তুলে ধরে।
তার ভক্তরা ঝাঁপিয়ে পড়ল ইউটিউবে। TED আর TEDx-এর দুই আইকনিক বক্তৃতা—The Danger of a Single Story আর We Should All Be Feminists—হুহু করে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ ছাড়িয়ে গেল। কিন্তু আসল বিস্ফোরণ ঘটল দ্বিতীয়টি নিয়ে।
এ যেন আধুনিক নারীবাদের নতুন ম্যানিফেস্টো—একদিকে বিয়ন্সের গানের লিরিকে জায়গা পেল, অন্যদিকে রূপ নিল ছোট্ট উপহারযোগ্য বইয়ে। কিন্তু গল্প এখানেই থামেনি। পুঁজিবাদ তো সুযোগ হাতছাড়া করতে জানে না—২০১৬-র প্যারিস ফ্যাশন উইকের র্যাম্পে হাজির হলো ডিওরের সাদা টি-শার্ট, বুকে বড় বড় হরফে লেখা—We Should All Be Feminists—দাম? মাত্র ৯২০ ডলার! নারীবাদ তো হলো, তবে কে কার জন্য?
একদিকে আদিচি ভবিষ্যতের বীজ বুনছেন—এক নতুন প্রজন্মকে তৈরি করার রূপরেখা আঁকছেন, অন্যদিকে দেখাচ্ছেন, জীবন যখন ভেঙে পড়ে, তখন ভাষা কীভাবে অসহায় হয়ে পড়ে, অসাড় হয়ে যায়। একদিকে নবজন্মের দীক্ষা, অন্যদিকে শিকড় হারানোর হাহাকার। তার কলম যেন একই সঙ্গে জন্ম ও মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে—এক হাতে ভবিষ্যতের দিকে ইশারা করছে, আর অন্য হাতে আঁকড়ে ধরেছে অতীতের শূন্যতা।
আগে আদিচি বলতেন, নন-ফিকশন লেখার সময় তিনি ছিলেন সাবধানী, সংযত—প্রতিটি শব্দ মেপে চলতেন, যেন কোনো রাজনীতিবিদের ভাষণ—পরিমিত, হিসেবি, ঝুঁকিহীন। যেন প্রতিটি বাক্যের আগে নিজেকে প্রশ্ন করতেন—"এটা কি যথেষ্ট শৃঙ্খলিত?"
কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর সেই শৃঙ্খলা কোথায় উধাও হয়ে গেল। প্রথমবারের মতো তিনি লিখলেন নিছক অনুভূতির তাড়নায়, শব্দ নিয়ে কোনো হিসাব-নিকাশ না করে। যেন বাঁধ ভেঙে গেলে নদী নিজের পথ নিজেই খুঁজে নেয়—তার লেখাও গড়িয়ে পড়ল, সব ছাপোষা সংযমের বেড়াজাল ভেঙে। কাদা-মাটি মেশানো সেই লেখায় ছিল ভাষাহীন শোক, হাহাকারের অসম্পূর্ণতা, আর এমন এক নির্মম সত্য, যা সম্পাদনার টেবিলে বসে কেটে-ছেঁটে তৈরি হয় না—জন্মায় বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা একরোখা যন্ত্রণার ভিতর থেকে।
এরপর, মাত্র নয় মাস কাটতে না কাটতেই, তার মা-ও চলে গেলেন। শোক এবার আর নিছক বেদনার স্তরে আটকে থাকল না—এটা পরিণত হলো এক বিধ্বংসী জলোচ্ছ্বাসে, যা তার অস্তিত্বকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। "এ যেন ভেতর থেকে শেকড় উপড়ে ফেলার যন্ত্রণা, মাটির গভীর খোঁড়াখুঁড়ি," বললেন তিনি। যেন শরীর আছে, কিন্তু ভিতরের কাঠামো ধসে পড়েছে, অনুভূতির সব রং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে—শুধু এক শূন্য কঙ্কাল পড়ে আছে, বেঁচে থাকার জন্য একটা অবয়ব মাত্র, যার ভেতরে প্রাণ নেই, রক্ত-মাংসহীন এক অস্তিত্ব।
এবার তিনি আশ্রয় নিলেন কল্পকাহিনীতে। যখন বাস্তবের ভাষা যথেষ্ট হয় না, যখন সত্য এতটাই নির্মম যে তাকে ধরে রাখা যায় না, তখন একমাত্র পথ হয়ে ওঠে কল্পনার আশ্রয়। তখন মিথ্যার ছদ্মবেশই হয়ে ওঠে সবচেয়ে খাঁটি সত্য—কারণ সরাসরি ধরা যায় না যে বাস্তব, তাকে কল্পনার ছাঁকনিতে ফিল্টার করতে হয়, ভেঙেচুরে এমন একটা রূপ দিতে হয়, যা চোখে না দেখা গেলেও মনে অনুভব করা যায়।
আদিচির নতুন উপন্যাস সেই শোকের ভাষা, যা মুখে উচ্চারণ করা সম্ভব নয়—তাই তাকে গল্পের ছলে বলা জরুরি।
Dream Count-এর প্রথম লাইনটা অনেকদিন ধরে আদিচির মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল—"I have always longed to be known, truly known, by another human being." আমি সারাজীবন ধরে চেয়েছি, কেউ এসে বলুক— “বুঝেছি তোকে পুরোটাই!” এই একটা বাক্যই যেন উপন্যাসের আত্মা। কথাটা শুনলেই বোঝা যায়, এ নিছক গল্প নয়—এ এক গভীর আত্মঅনুসন্ধান, স্বীকৃতির সন্ধান, আর বোঝাপড়ার আকুতি। মানুষ শুধু টিকে থাকতে চায় না, সে চায় অনুভূত হতে। আর সেই অনুভূত হওয়ার জন্যই আদিচির চরিত্ররা লড়ে যায়—কখনো নিঃশব্দে, কখনো বিদ্রোহের দাবানলে।
উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র, আইনজীবী জিকোরা, এসেছে আদিচির বহু বছর আগে লেখা একটি ছোটগল্প থেকে। কিন্তু বাকিরা—একজন ট্রাভেল রাইটার, এক ব্যাংকার, আর এক গৃহপরিচারিকা—ধীরে ধীরে যেন নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে নিয়েছে, দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর একদিন হঠাৎ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের সঠিক ছায়াটা দেখে ফেলেছে। তিনজন নাইজেরিয়ান, আর চতুর্থজন, কাদিয়াতু, এসেছে গিনির বাস্তবতা থেকে।
কাদিয়াতুর চরিত্রটি মূলত অনুপ্রাণিত হয়েছে নাফিসাতু দিয়ালো থেকে—সেই হোটেল কর্মী, যিনি ২০১১ সালে ফরাসি রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদ ডমিনিক স্ত্রস-কান-এর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনেছিলেন। সেই সময়ের বিশ্ব রাজনীতি আর ক্ষমতার কাঠামোয় এই মামলা এক প্রবল ঝড় তুলেছিল—শুধু আইনি লড়াই নয়, বরং উন্মোচিত হয়েছিল এক বৃহত্তর সত্য: যখন ক্ষমতা আর শ্রেণির ব্যবধান নারীর শরীরে এসে ঠেকে, তখন ন্যায়বিচারের পথ কতটা কণ্টকময় হয়ে ওঠে।
এখানেই আদিচির লেখা অনন্য—কারণ, তিনি শুধু গল্প বলেন না, বরং গল্পের গা ঘেঁষে রেখে দেন ন্যায়বিচারের এক চাপা আর্তি, ইতিহাসের প্রতিধ্বনি, আর সেইসব চরিত্রদের যন্ত্রণা, যারা সমাজের করিডোরে নিঃশব্দে হারিয়ে যায়, অথচ তাদের কাহিনি থেকে যায়, ঠিক সাহিত্যের মতো চিরকাল।
"আমার মা, মনে হয়, কাদিয়াতুর চরিত্রটাকে বেশ পছন্দ করতেন," লিখেছেন আদিচি। "আমি কল্পনা করি, তিনি উপন্যাসটা পড়ছেন, তারপর এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছেন, যেন একধরনের নীরব স্বীকৃতি আর মৈত্রীবোধ নিয়ে—Nwanyi ibe m. আমার সহযোদ্ধা, আমার সঙ্গিনী নারী।"
এটাই তো আসল কথা। যিনি সারাজীবন শক্ত হাতে সংসার সামলালেন, সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে তুললেন, তিনিও শেষ পর্যন্ত অন্য নারীদের সঙ্গে এক সুরে মিশে যেতে চাইলেন। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় নাম না থাকুক, অন্তত আরেকজন নারীর চোখের ভাষায় তিনি স্বীকৃত হলেন।
তবে আদিচি কেবল নিজের গল্পের মালিক নন। মা-বাবার প্রতি সেই চিরন্তন কন্যার কর্তব্য পালন করলেন এখানেও—শেষ বাক্যটাও ছেড়ে দিলেন মায়ের জন্য। একথা রবীন্দ্রনাথও জানতেন, জীবনানন্দও। শেষ কথা মা-ই বলেন—হয় সশব্দে, নয়তো নিঃশব্দে।
DREAM COUNT | By Chimamanda Ngozi Adichie | Knopf | 417 pp. | $32