নেটি জোন্সের Fish Tales
উপন্যাসের সূচনা হয় মাত্র বারো বছর বয়সী লুইসের সাথে এক কুৎসিত কিশোরের অবৈধ মেলামেশার বর্ণনায়। কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যেই লুইস ঘোষণা করে, সে তার গর্ভস্থ ভ্রূণটিকে ‘হ্যাঙ্গার’ দিয়ে অপসারণ করেছে।
১৯৮৩ সালে প্রকাশিত Fish Tales ছিল এমন এক উপন্যাস, যা প্রচলিত সাহিত্যিক সৌন্দর্যবোধ ও নৈতিকতার ছক ভেঙে নির্মিত। এটি রচিত হয়েছে টুকরো-টুকরো উজ্জ্বল ভিনিয়েটসের (vignettes) মাধ্যমে—জীবনের বিচ্ছিন্ন অথচ সংহত দৃশ্যপট রূপে। উপন্যাসের কেন্দ্রে থাকা লুইস নামের কিশোরীর বেড়ে ওঠার গল্প, ষাটের দশকের গোড়ার দিকের ডেট্রয়েট শহরের এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার পটভূমিতে। সময়টি এমন, যেখানে নারীজন্ম নিজেই একপ্রকার অপরাধ। শিক্ষকদের দ্বারা ছাত্রীর প্রতি যৌন সহিংসতা ছিল প্রচ্ছন্ন, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ছিল বহিষ্কারের কারণ, এবং গোপন গর্ভপাত ছিল সম্মান বাঁচানোর একমাত্র রাস্তা।
উপন্যাসের সূচনা হয় মাত্র বারো বছর বয়সী লুইসের সাথে এক কুৎসিত কিশোরের অবৈধ মেলামেশার বর্ণনায়। কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যেই লুইস ঘোষণা করে, সে তার গর্ভস্থ ভ্রূণটিকে ‘হ্যাঙ্গার’ দিয়ে অপসারণ করেছে। এই ভয়ঙ্কর ট্রমার বর্ণনায় কোনো আবেগের আবরণ নেই—ট্রমা এখানে নিছক এক অনুলিখন, কোনো নামকরণ নয়, কোনো কাঁদন নয়। লুইস এগিয়ে যায়, যেন বেঁচে থাকার এক অনিবার্য কৌশল হিসেবেই।
লুইস এরপর পিটার ব্রাউন নামের তার সামাজিক শিক্ষা শিক্ষকের প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। প্রায় এক দশক ধরে চলা এই অনৈতিক সম্পর্ক যখন শিক্ষক তার বয়সসঙ্গী নারীকে বিয়ে করেন, তখন লুইস ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তার কণ্ঠে ফুটে ওঠে নির্মম অভিযোগ:
“Desecrator, rapist, slimy child molester…”
এরপর একের পর এক প্রেমিকের খোঁজে, একের পর এক বিষাদে লুইস পতিত হয়—উডি নামক বন্ধুকে বিয়ে করে, সম্পর্কের পরাধীনতা থেকে পালাতে ক্রিসমাসে একাকী হোটেল রুমে ‘ডায়াল ইয়োর ডিজায়ার’ নাম্বারে ফোন করে, এবং অবশেষে নাচ-গানের উন্মত্ততায় নিজের অস্তিত্ব ভুলে থাকার চেষ্টায় মগ্ন হয়। সমস্ত সময়জুড়ে ভাসমান এক আত্মপরিচয়ের সংকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে—যেন লুইসের অস্তিত্ব নিজেই এক দ্বন্দ্বময়, ছিন্নভিন্ন ভূখণ্ড।
শেষ পর্যন্ত ব্রুক নামে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী, বিকলাঙ্গ পুরুষের প্রেমে পড়ে লুইস। এই প্রেম যেন লুইসের কাছে প্রথমবারের মতো নির্ভরতাজনিত আত্মসমর্পণের শিক্ষা নিয়ে আসে। কিন্তু এখানেও প্রতিদ্বন্দ্বী নারীদের ভিড়ে লুইসের আত্মবিশ্বাস চুর্ণ হয়। এক নারী তাকে বলেন:
“You seem to have forgotten yours. Love yourself, sister.”
লুইসের স্ব-অস্তিত্বের খোঁজ, তার নিজের ‘ভালোবাসার কারণ’ পুনরুদ্ধারের এক অন্তিম দাবি হয়ে ওঠে।
টনি মরিসনের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত Fish Tales ছিল সেই যুগের সাহিত্যিক আন্দোলনের অঙ্গ—যেখানে হিউই নিউটন, অ্যাঞ্জেলা ডেভিস, মুহাম্মদ আলী, টনি কেড বামবারা এবং গেল জোনসের মতো ব্যক্তিত্বদের লেখনী এক নতুন কৃষ্ণাঙ্গ সাহিত্যিক চেতনা নির্মাণ করছিল। অথচ Fish Tales ছিল এতটাই অম্ল মেজাজের, এতটাই সরাসরি যৌনতা ও আত্মসংঘাতের ভাষায় রচিত, যে তৎকালীন মূলধারার সাহিত্যিক রুচি তা পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেনি। উপন্যাসটি হারিয়ে যায়, অল্প কিছু প্রচার ছাড়া।
পুনরাবিষ্কারের সূত্রপাত ঘটে মাইকেল গনজালেসের Longreads এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ দিয়ে। পরে ফারার, স্ট্রাউস অ্যান্ড জিরোউ এই উপন্যাসের পুনঃপ্রকাশ ঘটায়। এই পুনঃআবিষ্কার যেন আফ্রো-আমেরিকান নারী সাহিত্যিক ঐতিহ্যের এক ছিন্নভিন্ন শাখাকে পুনরায় সংযুক্ত করার কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
নেটি পার্ল জোন্সের জন্ম ১৯৪১ সালে, জর্জিয়ার ছোট্ট গ্রামে। পাঁচ বছর বয়সে পরিবারসহ ডেট্রয়েটে পাড়ি। সতেরো বছর বয়সে মা হন, পরে ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেন। ইংরেজি ও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষকতা থেকে মন্ট্রিয়ালে পাড়ি, পরে নিউ ইয়র্ক সিটির স্বাধীনচেতা সাহিত্য-জীবনে প্রবেশ।
নেটি বলেছিলেন—তার লেখার প্রেরণা ছিল মূলত ‘insufficient funds’। অর্থনৈতিক সংকটই তাকে সাহিত্যিক হতে বাধ্য করেছিল। Fish Tales রচনার সময় তার পাশে ছিলেন গেল জোনস, যিনি তাকে নারী-শরীরের প্রকাশে নির্লজ্জ সাহস দেখাতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। গর্ভধারণ, যৌনাঙ্গ—সবকিছুর প্রকৃত নাম উচ্চারণ করার সাহস দিয়েছিলেন।
উপন্যাসের শিরোনামে ব্যবহৃত ‘Fish’ কোনো সামুদ্রিক প্রাণী নয়, বরং ব্ল্যাক গে স্ল্যাং—যা বাস্তব নারীত্বের শরীরী অভিজ্ঞতার দিকে ইঙ্গিত করে। আশি দশকের ডিসকো ও ড্রাগ-সংস্কৃতির যুগে রূপান্তরিত যৌনকর্মীরা নিজেদের শরীরে মাছের তেল মাখতো যেন আরও নারীত্বের ‘ঘ্রাণ’ ধারণ করতে পারে। নেটির ভাষায়, মানুষের শরীরের অন্তর্নিহিত বাস্তবতাই ছিল তার গল্পের মূল উপজীব্য।
আধুনিক আফ্রো-আমেরিকান সাহিত্যে, যেখানে নারীর চরিত্রকে প্রায়শই ‘মমতাময়ী’, ‘আধ্যাত্মিক’ বা ‘দেবীমূর্তি’ হিসেবে অঙ্কিত করা হয় (The Turner House, The Vanishing Half, Luster ইত্যাদি), সেখানে Fish Tales ছিল বিরল—এখানে নারী চরিত্র নিজ দোষ, ব্যর্থতা, কামনা, আত্মধ্বংসপ্রবণতা ও প্রেম-আসক্তির সমস্ত নগ্নতা নিয়েই অস্তিত্ব লাভ করে। এ এক সংলগ্ন সাহসিকতা, যার ধারায় ঝরা ফুলের সৌন্দর্যও অস্বীকার করা হয়নি।
আজ, যখন নেটি তার ‘Daisy Society’-র বন্ধুদের সাথে এক কঠিন অথচ উজ্জ্বল জীবন কাটাচ্ছেন, তখন তার সাহিত্যকীর্তি যেন তার সংগ্রামেরই এক নতুন ভাষ্য রচনা করছে। Fish Tales ছিল, এবং আজও রয়ে গেছে, এক মুক্ত মনোবৃত্তির রূপায়ণ—যেখানে নারীদেহ, কামনা, ব্যথা আর অস্তিত্বের টানাপোড়েন একই সাথে প্রবাহিত।
নেটির নিজের কথায়:
“It was a wandering life.”
এই “ভাসমান জীবন”-এর সমান্তরালে, Fish Tales জীবনের প্রতিটি ক্ষতকে এক একটি উজ্জ্বল বিন্দুতে রূপান্তরিত করেছে।