দেহ, দেবতা ও দাউদাউ দহন
আমি যখন বইটা পড়ছিলাম, তখন আমাদের বাস্তব পৃথিবী তার থেকেও নিষ্ঠুর নাটক মঞ্চস্থ করছিল। টেক্সাসে বন্যায় শতাধিক মানুষ মারা গেল। গুয়াডালুপ নদীর ধারে খ্রিস্টান স্লিপওয়ে ক্যাম্পে শিশুরা ডুবে গেল।
দেহ, দেবতা ও দাউদাউ দহন
জন রেমন্ডের God and Sex পড়ে প্রথমেই মনে হলো—অদ্ভুতুড়ে প্রেম-দর্শন-দুর্যোগের মিক্সার চালানো উপন্যাস। নায়ক আর্থার—একজন চিরবিস্মৃত, মলিন খাতার দাগের মতো লেখক। আগে বই লিখেছিল আলো নিয়ে শতাব্দীর কাহিনি, শুনেই মনে হচ্ছে যে বই পড়তে গিয়ে মানুষ অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল। নতুন বই লিখছে গাছ নিয়ে। আর সেই বইয়ের নাম God and Sex। নামটা শোনামাত্রই মনে হয়, এ আবার কেমন ভ্রান্তি! দেবতা আর দেহজ কামনা—দুই বিপরীত মেরু, আর নায়ক? পেটানো, টাক, শুকনো কাগজের মতো মানুষ। কিন্তু রেমন্ডের খেল এখানেই।
প্রথম অধ্যায়ের শেষে আর্থার চেয়ে দেখে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়ানো এক নারীকে—সারা, তার বন্ধু ফিলের স্ত্রী। তারপর হুড়মুড় করে বই ঢুকে পড়ে গোপন রোমাঞ্চে। খোলা মাঠে, খালি ক্লাসরুমে, বসার ঘরের মেঝেতে—তাদের সম্পর্ক এমন যেন কলেজ জীবনের শেষ বেঞ্চে রাখা হুইস্কি ফ্লাস্ক। পাঠক জানে, এই প্রেম অবৈধ; চরিত্ররা জানে, তাতে কিছু আসে যায় না। রেমন্ড এইসব দৃশ্যে নোংরামো না লিখে, একধরনের কাঁচা বিদ্যুতের ঝিলিক ছড়িয়েছেন।
তারপর হঠাৎ গল্পে ঢুকে পড়ে ‘God’। সারা চলে যায় মাউন্ট হুডের রিট্রিটে, আর সেখানেই লেগে যায় বনভূমির আগুন। রেমন্ডের ভাষা তখন বদলে যায়—চোখ জ্বালিয়ে দেওয়া ধোঁয়া, গাছের ভেতর থেকে শোনা ভয়ংকর ক্র্যাকিং, শিখার রঙ নীল-হলুদ-কমলার মিশ্রণে নাচছে। যেন প্রকৃতি নিজেই দাঁড়িয়ে আছে রাগী জ্যাজ কনসার্টে। সারার খোঁজে আর্থারের ছুটে যাওয়া আসলে এক ধাক্কায় জীবনের সমস্ত অর্থহীনতার মুখোমুখি হওয়া। কে জানে, হয়তো যাকে আমরা ঈশ্বর বলি, তিনি আসলে এই বিশৃঙ্খল, নির্বোধ, অথচ অদ্ভুত সুন্দর বিশাল শক্তি।
আমি যখন বইটা পড়ছিলাম, তখন আমাদের বাস্তব পৃথিবী তার থেকেও নিষ্ঠুর নাটক মঞ্চস্থ করছিল। টেক্সাসে বন্যায় শতাধিক মানুষ মারা গেল। গুয়াডালুপ নদীর ধারে খ্রিস্টান স্লিপওয়ে ক্যাম্পে শিশুরা ডুবে গেল। সেই খবরের সাথে বইয়ের কাল্পনিক আগুন যেন জুড়ে গিয়ে এক মোবিয়াস স্ট্রিপে পরিণত হলো। একদিকে সাহিত্যের বিপর্যয়, অন্যদিকে বাস্তবের মৃত্যুর ক্রন্দন।
বই পড়তে পড়তে হঠাৎ নিজের ছেলের কথা মনে হলো—সেও স্কুলের ক্যাম্পে স্মোকি মাউন্টেনে। সে নিরাপদে দূরের ক্যাম্পে আছে। আর টেক্সাসে সেই বাবা-মায়েরা, যাদের বাচ্চা আর ফিরবে না। যদি দুর্যোগ এসে আমার সন্তানকে দাবী করত, আমি কি কোনো ঈশ্বরের সাথে চুক্তি করার চেষ্টা করতাম? যদি সত্যিই সেই চুক্তি কাজ করত?
রেমন্ডের উপন্যাসে এক জায়গায় আর্থারের মা তার বোনের মানসিক ভাঙনের কথা মনে করিয়ে দেয়—ডাক্তার নাকি বলেছিল, নারীদের জন্য ভাঙন সবসময় দেহ নিয়ে, আর পুরুষদের জন্য ঈশ্বর নিয়ে। অর্থাৎ, শরীর আর ঈশ্বর—সেখানেই মানুষের সমস্ত সীমা, সমস্ত ভাঙন। উপন্যাসের নাম তাই অকারণ নয়।
এই সরু, পাতলা বইয়ের ভেতর আছে বহু পুরনো, মৌলিক প্রশ্ন—বিশ্বাস, কামনা, মৃত্যুভয়, এবং প্রকৃতির ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠা। যে প্রশ্নগুলো আজকাল আগুন আর জলের প্রতিটা ঋতুর সঙ্গে আরও ভারী হয়ে উঠছে।
রেমন্ডের ভাষা নিঃশব্দে বলে দেয়—সাহিত্য আসলে জীবনকে ফাঁকি দেওয়ার জায়গা নয়, বরং সেই জ্বলন্ত প্রশ্নগুলোর সামনে দাঁড়ানোর শেষ সুযোগ। God and Sex শেষ করার পরও সেই আগুন নিভলো না, বরং বুকের ভেতর আরো ঝলসে উঠল।
GOD AND SEX | By Jon Raymond | Simon & Schuster | 243 pp. | $26.99