হান কাং: আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার।
২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হান কাং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকার, যা ৬ ডিসেম্বর ২০২৩-এ সুইডেনের স্টকহোমে নোবেল সপ্তাহের সময় ধারণ করা হয়।
সাক্ষাৎকার: হান কাং-এর সঙ্গে কথোপকথন
প্রশ্ন: আপনার পরিবারের প্রভাব আপনার লেখালেখির প্রতি আগ্রহ তৈরিতে কীভাবে কাজ করেছে?
হান কাং: আমার বাবা একজন লেখক ছিলেন, তবে আমার লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত সরাসরি তাঁর থেকে আসেনি। আমাদের বাড়ি ছিল বইয়ে ভরা—একটা ছোটখাটো গ্রন্থাগার বলা চলে। আসবাবপত্র তেমন কিছু ছিল না, কিন্তু বই ছিল সবখানে। এই পরিবেশ আমাকে বইয়ের জগতে অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দিয়েছিল।
প্রশ্ন: শৈশবে বই আপনার জন্য কী অর্থ বহন করত?
হান কাং: শৈশবে আমি প্রায়ই স্কুল বদলাতাম। নতুন স্কুলে গেলে বন্ধু তৈরি করতে সময় লাগত, প্রায় এক মাস। সেই সময়ে বই-ই ছিল আমার আশ্রয়। তারা ছিল আমার বন্ধু, কিন্তু আলাদা আলাদা বই নয়—সব বই মিলেই যেন এক বিশাল বন্ধুত্বের জগৎ তৈরি করেছিল।
প্রশ্ন: লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলেন?
হান কাং: আমি ছোটবেলা থেকেই পড়তে ভালোবাসতাম, তবে একদিন ১৪ বছর বয়সে একটি ছোটগল্প পড়তে পড়তে মনে হলো, আমি যেন গল্পের এক অংশ হয়ে গেছি। সেখানে এক তরুণ কাঠের চুল্লিতে কাঠের গুঁড়ো ছুঁড়ছিল, আগুনের আলো তার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল। আমি যেন সেই উজ্জ্বলতা আমার ত্বকে অনুভব করছিলাম। তখনই সিদ্ধান্ত নিই—আমি লিখতে চাই।
প্রশ্ন: আপনার প্রতিদিনের লেখালেখির রুটিন কেমন?
হান কাং: আমি খুব ভোরে, ৫:৩০ নাগাদ ঘুম থেকে উঠি। আমার মাথা তখন সবচেয়ে স্বচ্ছ থাকে, তাই লেখার জন্য এটি আদর্শ সময়। চা খাই, হাঁটতে যাই, আবার লিখতে বসি। বাইরে থেকে দেখতে এটা হয়তো একঘেয়ে জীবন, কিন্তু আমার মনে ভেতরে একটা সমৃদ্ধ জগত আছে। আমি ধূমপান করি না, পার্টিতে যাই না, বরং এই সরল জীবনই আমার জন্য আনন্দদায়ক।
প্রশ্ন: আপনি লেখার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পান?
হান কাং: আমি অনুপ্রেরণা খুঁজতে যাই না। আমি কেবল হাঁটি, মানুষের সঙ্গে কথা বলি, বই পড়ি, আর সম্পূর্ণভাবে জীবনকে গ্রহণ করি। হয়তো এটাই আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা।
প্রশ্ন: রাটার্স ব্লক নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
হান কাং: আমার চতুর্থ উপন্যাস লেখার সময় এক বছর ধরে আমি একরকম বিপর্যয়ের মধ্যে ছিলাম। শুধু লেখাই নয়, তখন আমি কোনও কথাসাহিত্য পড়তেও পারতাম না, এমনকি চলচ্চিত্রও। শুধু ডকুমেন্টারি দেখতাম, বিজ্ঞানের বই, বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়তাম। একদিন, এক বছর পর, সাইকেল চালানোর সময় হঠাৎ আমার উপন্যাসের কথা মনে পড়ল, মনে হলো, আমি ওটাকে মিস করি। তারপরই ঘরে ফিরে আবার লেখা শুরু করলাম। হয়তো আমার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন ছিল।
প্রশ্ন: কল্পনাশক্তি কি চর্চা করা যায়?
হান কাং: অবশ্যই। কল্পনা মানুষের অন্যতম আশ্চর্য ক্ষমতা। আমি হাঁটতে হাঁটতে অনেক কিছু কল্পনা করি। এটি জীবনের এক অনন্য সৌন্দর্য।
প্রশ্ন: লেখালেখি আপনার জীবনকে কীভাবে বদলেছে?
হান কাং: প্রতিটি বই লেখার সময় আমি কিছু নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করি। লেখার প্রক্রিয়া আমাকে বদলে দেয়। প্রতিটি উপন্যাস শেষ করার পর আমি বুঝতে পারি, আমি আর আগের মানুষটি নেই—একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। তাই লেখালেখির মাধ্যমে আমি ক্রমাগত নিজেকে খুঁজে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: কীভাবে শিশুদের বই পড়তে অনুপ্রাণিত করা যায়?
হান কাং: সাহিত্য পড়া মানে অন্য কারও গভীরে প্রবেশ করা, তাদের অনুভূতি ও জীবন বোঝা। এতে আমাদের আত্মসীমার প্রাচীর কিছুটা নরম হয়, আমরা আরও উন্মুক্ত ও সংবেদনশীল হই। তাই আমি মনে করি, শিশুদের বই পড়তে উৎসাহিত করার জন্য তাদের সাহিত্যিক জগতে প্রবেশ করানো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: নোবেল পুরস্কারের জন্য যে এত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছেন, তা কেমন অনুভব হচ্ছে?
হান কাং: আমি আসলে এই মনোযোগ থেকে দূরে থাকতে চাই। লেখার জন্য আমার মানসিক শান্তি দরকার, তাই আমি চেষ্টা করি এসব আমাকে প্রভাবিত না করতে।
প্রশ্ন: মানুষ কীভাবে পৃথিবীতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে?
হান কাং: আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান ক্ষমতা হল অন্যকে অনুভব করতে পারা—তাদের যন্ত্রণা, তাদের আনন্দ। আমরা যদি সত্যিকারের সংযোগ স্থাপন করতে পারি, তবে এই পৃথিবীকে আরও মানবিক করে তুলতে পারব।