হার্ট ল্যাম্প: নারীর যন্ত্রণাকাব্য, ট্র্যাজেডির ট্র্যাক্টর
এই সংকলনের প্রতিটি গল্প একেকটা স্টেথোস্কোপ। আপনি পড়লে শুনতে পাবেন কোনও এক মহিলার বুকের ভেতরের শব্দ—'স্বামী মারছে', 'মা বলছে সহ্য কর', 'মসজিদে জায়গা নেই', 'বংশের মান'—এইসব সংলাপ, যা খুব হাল্কা কাগজে
বানু মুশতাকের Heart Lamp—একটা বই নয়, যেন ১২টা সিগন্যাল ল্যাম্পের সারি। কেউ একজন—সম্ভবত সমাজের ড্রাইভার সেজে বসে থাকা কোন রেটিনলেস পিতৃতন্ত্র—তার আলো দেখে না, শুধু ধোঁয়া দেখে। আর সে ধোঁয়ার উৎস? বহু আগুনের জমাট ব্যথা, জ্বলার আওয়াজ হয় না, শুধুই তাপ।
শুরু করি বানুর পরিচয় দিয়ে। বয়স ৭৬, আইনজীবী, সমাজকর্মী, বিদ্রোহী লেখক। সংক্ষেপে বলতে গেলে, তিনি এমন একজন যিনি 'ইসলামে নারীবাদ' শব্দবন্ধটা লিখে তার নিচে নিজের নাম সই করে সাহিত্যে আত্মঘাতী হয়েছেন বহুবার। দীপা বাস্থির করা অনুবাদে এই বই International Booker Prize 2025 জিতে নিয়েছে—অর্থাৎ যাদের কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে গেলে বুকার লাগে, তারা এখন বানুর ধর্মতত্ত্বে বসে পড়ে হুঁকো টানছে। বানু মুশতাক—এই নামটি উচ্চারণ করলেই, মনে হয় যেন কোনও আপোস না করা আদর্শ পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে; অর্ধেক অ্যাক্টিভিস্ট, অর্ধেক অ্যাংলো-আরব্য উপন্যাসের সন্ত্রস্ত সন্ন্যাসিনী। তিনি নিজেকে বলেন ‘ফাইটার’। কিন্তু এই ‘ফাইটার’ শব্দটা উর্দু সিনেমার নায়কদের মতো পেশি ফুলিয়ে নয়, বরং তালাকের কাগজ হাতে নিয়ে দাঁড়ানো একজন মুসলিম নারীর স্বরে বলা—‘আমি এখনো হারিনি’।
লেখিকা এবং অ্যাক্টিভিস্ট—এই দুই পরিচয় নিয়ে বানু মুশতাক এমনভাবে চলাফেরা করেন, যেন তারা রুমমেট। সকালের নাশতা ভাগ করে খান, রাতে একই বিছানায় দুঃস্বপ্ন দেখেন, এবং প্রবন্ধ আর প্রতিবাদে পালা করে পরস্পরের খাতা খুঁটিয়ে পড়েন। কে কার কাছ থেকে বেশি ধার করেন, বলা মুশকিল।
বানু নিজেই একেবারে পাদপ্রদীপের নিচে দাঁড়ানো বিদ্রোহ। তাঁর লেখায় একবার তো ফতোয়াও জারি হয়েছিল। কেউ ছুরি নিয়ে এসেছিল তাঁর দিকে। কারণ তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ধর্মকে ব্যবহার করে পুরুষেরা কীভাবে নারীদের পণ্য বানায়। হ্যাঁ, তিনি ধর্মেরও সমালোচনা করেন, কিন্তু কোনও ক্যালভিনিস্ট বা বিবেকহীন ইউটিউব-অ্যাংরি-আথেইস্টদের মতো চিৎকার করে নয়—বরং ভিতর থেকে, একরকম ভাঙা কণ্ঠে, ভাঙা মসজিদের পাশ থেকে।এই সংকলনের প্রতিটি গল্প একেকটা স্টেথোস্কোপ। আপনি পড়লে শুনতে পাবেন কোনও এক মহিলার বুকের ভেতরের শব্দ—'স্বামী মারছে', 'মা বলছে সহ্য কর', 'মসজিদে জায়গা নেই', 'বংশের মান'—এইসব সংলাপ, যা খুব হাল্কা কাগজে ছাপা, কিন্তু বড্ড ভারী।
তাঁর গল্পগুলো মফস্বলের মসজিদ গলি, ডিভোর্সের শুনানির দিন, কিংবা কোনও নারীর গর্ভপাতের আগের রাতে জন্ম নেয়। বানু বলেন—“আমি সেই জগৎ নিয়েই লিখি, যেটার গন্ধ আমি চিনি, যা আমাকে রোজ আঘাত করে আর গোপনে ভালবাসে।” আর এই জগৎটা কেমন? ওখানে ধর্মের টুপি পরে পুরুষেরা নারীদের মুখ চাপা দেয়, ইমাম সাহেবদের মুখে ‘অধিকার’ শব্দটা নেই, কিন্তু কোরআনের ব্যাখ্যায় তারা পিএইচডি। ওদিকে রাস্তায় দাঁড়ানো এক গৃহবধূ জানেন না—তিনি প্রথমে নাগরিক, নাকি শুধুই ‘বেগম’।
গল্পের মধ্যে একটার নাম Taste of Heaven, যেখানে এক শিশু-বিধবা পেপসিতে লিপস্টিকের বদলে স্বামীর সাথে পুনর্মিলনের স্বপ্ন মাখে। আরেকটা গল্প The Red Lungi—এখানে সদ্য সদ্য সংবেদনশীল পুরুষরা হয়তো ‘ওফ! চমৎকার প্রতীকী গল্প!’ বলে হ্যাশট্যাগ দিতে গিয়েই পড়ে যাবে, কারণ গল্পের শেষে শারীরিক এবং সামাজিক কেটে-ফেলার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না।
Be a Woman Once, Oh Lord গল্পে তো এক মহিলা ঈশ্বরকে বলেন, “একবার মহিলা হয়ে জন্মাও বাবা, তারপর বুঝবে ছুটির দিনে রান্না করা কী জিনিস!”… চিঠিটা পোস্ট না হলেও স্বর্গের পিওন নাকি কান্না করে ফেলেছে।
গল্পে বানুর নারীরা সব সময় হার মানেন না, আবার জয়ও পায় না। তারা ‘টিকে থাকেন’। যেটা একরকম বিপ্লবই, যেখানে মৃত্যু নয়, বেঁচে থাকাটাই যুদ্ধ। কেউ নিজের গর্ভের মালিকানা দাবি করেন, কেউ স্বামীর ঘর ছেড়ে নিজের ঘরের দেয়াল রং করেন। সেই সব গল্পে একটা শব্দ ঘোরাফেরা করে—"নিয়ন্ত্রণ"। অর্থাৎ, নারীরা কী খাবে, কী পরবে, কখন যৌনমিলনে রাজি হবে—এসবের চাবিকাঠি কে রাখবে?
ভাষার ধরনে কোন অলঙ্কার নেই, ব্যঙ্গের বাজনা বাজে না, শুধু কাচা সত্যের ধূপকাঠি। বানু মুশতাক গল্প লেখেন যেমন কেউ সিঙ্গার সেলাই মেশিনে চোখে জল মাখা সুতোর ওপর দিয়ে কাটা কাপড় টেনে দেয়। দীপা বাস্থি অনুবাদে কান্না রেখে দেন, কিন্তু কাঁদতে বলেন না। কান্না না এলে, পাঠক হয় স্টোন স্ট্যাচু, নয় তো বুকার কমিটির সদস্য।
আর গল্পগুলো? এমনভাবে সাজানো, যেন কেউ বলছে, “দ্যাখ, তুই যদি আমার বোনকে ‘মৌলবাদী সমাজে মিউট চরিত্র’ বলে ভাবিস, তবে তোর ছেলেবেলার প্লাস্টিক গ্লাসে দুধ খাওয়ার স্মৃতিও আমি বদলে দেবো।”
তবে পাঠকবর্গ দুই দলে বিভক্ত। একদল গল্প পড়ে ভাবে, “ওফ, সাহসের গল্প!” আরেক দল ভাবে, “আচ্ছা, এ গল্পটা আগেও পড়িনি?” মানে repetition আছে, যেমন আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিশ্রুতি।
ভারতীয় সংস্করণের কভার ডিজাইনেও নারীবাদ আছে—পেঁপে নয়, ডালিম! হ্যাঁ, বইয়ের কভারে ডালিম। মানে নারীর ভেতরের ভাঙনের প্রতীক, কিংবা ডিএনএ-র অনুচ্ছেদ, যা বলে, “এখানে শুধু সন্তান ধারণ নয়, বিদ্রোহ ধারণ হয়।”
বইটি পড়লে আপনি ‘feminist’ হবেন না। আপনি শুধু কিছুক্ষণের জন্য মানুষ হবেন। এই বইটি যে শুধু নারীর গল্প তা নয়, এটা পুরুষের গল্পও—মানে, কেমন করে তারা প্রতিদিন মন্দিরে পুজো দিয়ে ফিরে এসে স্ত্রীর উপর হাত তোলে। Heart Lamp এক চিমটে ঈশ্বর, দুই চামচ অভিশাপ, আর বাটি ভরা বাস্তব, যা আপনি খেতে না চাইলেও মুখে পুরে দেয়।
তাঁর গল্প শুধু গল্প নয়, একেকটা মামলার কেস ফাইল। একেকটা ‘রিপ্রোডাকটিভ রাইটস’ নিয়ে লেখা চরিত্র। কেউ কিশোরী, কেউ বিধবা, কেউ তালাকপ্রাপ্ত, কেউ অদৃশ্যপ্রায়। তাঁদের শরীর, সিদ্ধান্ত, এবং সন্তানের নাম রাখা—সবই পুরুষেরা ঠিক করে দেয়। বানু সেই গল্পগুলো লেখেন, যা কোনোদিন আদালতের ডায়েরিতে উঠবে না, কিন্তু আদালতের কাঠগড়ায় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকবে।
বানু মুশতাক ‘বান্দা সাহিত্য আন্দোলন’-এর অংশ। এখানে সাহিত্য আর বিদ্রোহ আলাদা নয়। কলমটা যেন এক ধরণের মাইক্রোফোন, যার মধ্যে দিয়ে ভাঙা মহিলারা ‘আমিও আছি’ বলে চিৎকার করেন। তাঁর মতে, ‘নতুন সমাজ’ রচনার আগে ‘পুরনো গল্পগুলো’ শোনা দরকার—কান পেতে, হৃদয় টেনে।
বানু মুশতাক লেখক নন। তিনি সেই বুড়ো জাদুকর, যিনি নিজের শিরদাঁড়া ভেঙে মেয়েদের জন্য কাঁটায় বসে এক একটা গল্প বানান, যেন মসজিদের শীতল পাথরে একটু কোমল গালচে বিছিয়ে দিতে পারেন।
এই বইটা একটা পাঠ নয়। এটা একপ্রকার প্রতিশোধ। কে জানে, হয়তো কোনওদিন 'Heart Lamp'-এর গল্পগুলো স্কুলের পাঠ্যক্রমে ঢুকবে না। তবে একটা মেয়ে হয়তো লুকিয়ে পড়বে। আর কেউ হয়তো হাতের লেখায় পাশে লিখে রাখবে, “আমি শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম। গল্প হয়ে গেলাম।”
😢