সালমান রুশদি: ভাষার বিস্ময়
যিনি শব্দ দিয়ে রচনা করেন বিদ্রোহ, বাক্যে বাঁধেন সমাজের দ্বন্দ্ব, এবং সাহিত্যের পরতে পরতে প্রতিষ্ঠিত করেন আধুনিকতার নির্মম সত্য।
সালমান রুশদি নিয়ে আর নতুন করে বলার কী থাকতে পারে? সত্যের ফেরিওয়ালা, বিশ্বাসের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সাহিত্যিক, সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ এক তলোয়ারধারী। তিনি এমন এক লেখক, যিনি শব্দ দিয়ে রচনা করেন বিদ্রোহ, বাক্যে বাঁধেন সমাজের দ্বন্দ্ব, এবং সাহিত্যের পরতে পরতে প্রতিষ্ঠিত করেন আধুনিকতার নির্মম সত্য।
রুশদির গদ্যের ভেতর একটা শয়তানি আছে—তার লেখার ভাষা এমন যে তা আপনাকে প্রথমে মোহিত করবে, তারপর ধাক্কা দেবে, এবং শেষে ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখে বলবে, "এই তো বাস্তবতা, এখন সামলাও!" তার ভাষা শুধু পলাতক রূপকের খেলা নয়, সেখানে ইতিহাসের তলপেটে প্রবেশ করার প্রবণতা রয়েছে, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে এক অবিচল অবস্থান রয়েছে, আর রয়েছে স্মৃতির সঙ্গে নির্মম পরীক্ষানিরীক্ষার ধারা।
তিনটি প্রশ্ন যখন রুশদির বাক্যের গাঁথুনি বুঝতে চান
কোনো বাক্য কি শুধুই বাক্য? নাকি সেটি নিজেই এক সুগভীর রাজনীতি, ভাবনার কারাগার থেকে পালানোর একটি পথ? যখন আপনি রুশদির লেখার গঠন বিশ্লেষণ করবেন, তখন এই তিনটি প্রশ্ন আপনাকে সাহায্য করবে:
১. বাক্যের গঠন কেমন, এবং কেন সেটি কাজ করছে?২. কোন সাহিত্যিক বা অলঙ্কারিক কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে, এবং তা বাক্যের প্রভাবকে কীভাবে বাড়িয়ে তুলেছে?৩. বাক্যটি কীভাবে আবেগ তৈরি করছে, এবং কোন কৌশলে সেই আবেগ পাঠকের মনে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে?
এবার কিছু উদাহরণ দেখা যাক—রুশদির তিনটি বাক্য, যা শুধু চর্চার জন্য নয়, বরং বুঝতে হবে কেন তিনি আজও সাহিত্যের মহাবিশ্বে এক বিস্ফোরক উপাদান।
বাক্য #১
"Language is courage: the ability to conceive a thought, to speak it, and by doing so make it true."(The Satanic Verses)
এই বাক্যটি সহজ, কিন্তু এর প্রভাব বিধ্বংসী। তিনি ভাষাকে কেবল ভাব প্রকাশের মাধ্যম বলেননি, বরং সেটিকে সত্য গঠনের হাতিয়ার বানিয়েছেন। ভাবুন তো, ভাষা কি সত্যকে ধারণ করে, নাকি ভাষার মধ্যেই সত্যের জন্ম হয়?
আপনি চাইলে এই কাঠামো ব্যবহার করে নিজের বাক্য তৈরি করতে পারেন:
"_____ is ______: the ability to _______, to _______, and by doing so ______."
উদাহরণ:"সাহস হল স্বাধীনতা: অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা, প্রতিবাদ করবার শক্তি, আর তা করেই ইতিহাসকে বদলে দেওয়া।"
বাক্য #২
"I am the sum total of everything that went before me, of all I have been seen done, of everything done-to-me."(Midnight’s Children)
এই বাক্যে আত্মপরিচয়ের ধারণাকে একেবারে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন রুশদি। ব্যক্তি কি শুধুই তার কাজের সমষ্টি, নাকি তার উপর যে ইতিহাস আর পরিপার্শ্বের চাপ এসে পড়েছে, সেটাও তার অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করে?
এই কাঠামো ব্যবহার করে আপনার বাক্য তৈরি করুন:
_"I am ______, of ______, of _____."
উদাহরণ:"আমি আমার সংগ্রামের ফল, আমার স্বপ্নভঙ্গের উত্তরাধিকার, আমার ইতিহাসের যন্ত্রণার এক চলমান অধ্যায়।"
বাক্য #৩
"But shame is like everything else; live with it for long enough and it becomes part of the furniture."(Shame)
এই বাক্যে রুশদি যেভাবে লজ্জার সঙ্গে বসবাসকে দৈনন্দিনতার অংশ বানিয়ে ফেলেছেন, তা দুর্দান্ত। এটিকে আপনি যে কোনো অনুভূতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারেন।
_"But _____ is like _____; (explain how _____ is like ____)."
উদাহরণ:"কিন্তু ভয় হলো ধোঁয়াটে আয়না; বেশি দিন তাতে তাকিয়ে থাকলে নিজেকেই অপরিচিত লাগে।"
দুইটি রুশদি-স্মরণীয় উক্তি ও লেখার তন্ত্র
উক্তি #১
"Go for broke. Always try and do too much. Dispense with safety nets. Take a deep breath before you begin talking. Aim for the stars. Keep grinning. Be bloody-minded. Argue with the world."
এখানেই রুশদির মূল দর্শন—তিনি মধ্যপন্থী ছিলেন না, আপসের পথ তাকে টানে না। তার কাছে সাহিত্য হল সর্বোচ্চ ঝুঁকির খেলা। সাহিত্যের কাজ মসৃণ করতে নয়, বরং সত্যের ধারালো চেরা দেখাতে।
প্রশ্ন: আপনার লেখায় কবে এমন ‘অতি সাহসী’ ঝুঁকি নিয়েছেন? লিখুন।
উক্তি #২
"I once went to a book reading by the author Joseph Heller, the author of Catch-22. And he said that most of the books he had written had grown out of a single sentence—that he had written a sentence and he immediately saw that that sentence gave him another couple of hundred of sentences."
এটাই সাহিত্যিক যাদু। একটি বাক্যই কখনো কখনো একটি বইয়ের ভিত্তি হতে পারে। প্রশ্ন হলো, কোন বাক্য আপনাকে তাড়া করে ফেরে? কোন বাক্য আপনার মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে?
লেখার অনুশীলন: কোন একটি বাক্য লিখুন, যা আপনাকে প্রতিনিয়ত ভাবায়, এবং সেই বাক্যের প্রসঙ্গে দশ মিনিট অবিরাম লিখুন।
৯/১১-এর পর বিশ্ব যখন ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য হল, তখন রুশদি এক জটিল আলোচনা আনেন। ধর্ম কি সত্যিই যুক্তির পরিপন্থী, নাকি যুক্তির মধ্যে থেকেই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়? রুশদির সাহসী অবস্থান তার লেখার মতোই তীক্ষ্ণ—তিনি বিশ্বাস করেন, ধর্মীয় অনুশাসন যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে জোট বাঁধে, তখনই সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্ম হয়।
এমন বিতর্কিত, বিদ্রূপাত্মক, কিন্তু একেবারে নখদর্পণে থাকা বুদ্ধিমত্তা দিয়ে রুশদি তার সাহিত্য গড়ে তুলেছেন। তার বই পড়া মানেই শুধু গল্প পড়া নয়, বরং এক টেক্সচুয়াল যুদ্ধের মধ্যে প্রবেশ করা। এবং আপনি যখন রুশদি পড়েন, তখন সাহিত্যের শক্তি সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হন।
সালমান রুশদির সাহিত্য আসলে কী? এটি সাহিত্য, এটি ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই, এটি উপনিবেশবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, এটি অভিবাসীদের বেদনার দলিল, এটি ভাষার সীমানা অতিক্রম করা এক বিপজ্জনক খেলা। রুশদির লেখা হল সেই সাহিত্য, যা আপনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে, আপনাকে বিরক্ত করবে, আপনাকে লজ্জা দেবে, এবং আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে—এই কি সাহিত্যের চূড়ান্ত জয় নয়?
Theft: আত্মপরিচয়ের সন্ধান ও বিশ্বাসঘাতকতার অন্বেষণ
ডাকপিয়ন দরজায় আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছিলেন, হাতে বাদামি রঙের একটা পার্সেল, যার গায়ে আমার নাম ছাপানো। খোলার পর দেখি, ভেতরে নোবেলজয়ী আবদুলরাজাক গুরনাহর আসন্ন উপন্যাস Theft-এর এক অপ্রকাশিত খসড়া (১৮ই মার্চ প্রকাশিতব্য)। বুকের ভেতরটা ধকধক করতে শুরু করল—সেই অনুভূতি, যা বহুদিন পর কোনো পুরনো প্রেমিকার হাতের লেখা দেখে মনে হয়, যেন কাগজের ভাঁজে সময় আটকে আছে।