উদার বিশ্বব্যবস্থার ভাঙন: চীন, পুঁজিবাদ, ও ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস
১৯৪১ সালের আটলান্টিক সনদের মাধ্যমে যে-‘উদার বিশ্বব্যবস্থা’র দৃষ্টিভঙ্গি গঠিত হয়েছিল, তার শিকড়ে ছিল গণতন্ত্র, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, আগ্রাসী শক্তির নিরস্ত্রীকরণ এবং মুক্ত বাণিজ্যের প্রতিশ্রুতি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে গঠিত হয়েছিল এক বহুজাতিক, উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা—যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক ধরনের নৈতিক আধিপত্য। এই ব্যবস্থার ভিত গড়ে দিয়েছিল আটলান্টিক সনদ, ব্রেটন উডস ব্যবস্থাপনা, এবং জাতিসংঘের মতো সংস্থার উদ্ভব। পুঁজির অবাধ প্রবাহ, মুক্ত বাণিজ্য, এবং গণতন্ত্রের কথিত প্রসার—এসব ছিল তার মুখ্য স্তম্ভ। কিন্তু বিংশ শতকের শেষভাগে এবং একবিংশ শতকের সূচনায়, চীনের উত্থান, হাইপার-গ্লোবালাইজেশন, উৎপাদনশীলতার স্থানান্তর, এবং ব্যক্তিনির্ভর রাজনীতির জাগরণ—এইসব উপাদান উদার বিশ্বতন্ত্রের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। সেই বিশ্বব্যবস্থা আজ বহুধ্রুবীয় বাস্তবতায় রূপান্তরিত হচ্ছে, যেখানে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির একাধিপত্য ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে, আর তার শূন্যস্থান দখল করছে একাধিক বিকল্প কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গি।
১৯৪১ সালের আটলান্টিক সনদের মাধ্যমে যে-‘উদার বিশ্বব্যবস্থা’র দৃষ্টিভঙ্গি গঠিত হয়েছিল, তার শিকড়ে ছিল গণতন্ত্র, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, আগ্রাসী শক্তির নিরস্ত্রীকরণ এবং মুক্ত বাণিজ্যের প্রতিশ্রুতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এই দর্শনকে টিকিয়ে রাখার জন্য গঠিত হয় রাষ্ট্রপুঞ্জ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের মতো কাঠামোগত সংস্থাবলী—যারা বিশ্বপুঁজির ‘নৈতিক আধিপত্য’-কে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। সেই পুঁজিবাদ-নিয়ন্ত্রিত যুগে, অন্তত কয়েক দশক ধরে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এই ব্যবস্থাই পশ্চিমা অর্থনৈতিক আধিপত্যের ভিত মজবুত করেছে। কিন্তু শীতল যুদ্ধ এসে বিশ্বকে দ্বিধাভাজন করে ফেলে—গণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শিবিরে বিভক্ত করে দেয় তাকে—যেখানে পশ্চিমা অর্থনীতি ‘প্রগতির’ একমাত্র পরিভাষা হয়ে দাঁড়ায়। এই একমেরু ব্যবস্থা ভাঙতে শুরু করে তখনই, যখন চীন—পুঁজির নতুন ভূ-রাজনৈতিক শরীর হয়ে—বিশ্ব অর্থনৈতিক কেন্দ্রচ্যুতি ঘটাতে শুরু করে, এবং তার হাত ধরেই ক্ষমতার ছকের পুরোনো মানচিত্র ক্রমশ খসে পড়ে।
চীনের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) প্রবেশকে একসময় উদারনৈতিক বিশ্বতন্ত্রের বিজয় হিসেবে উদ্যাপন করা হয়েছিল। পশ্চিমা কূটনীতি আশা করেছিল যে অর্থনৈতিক উদারীকরণের হাত ধরে চীনে রাজনৈতিক সংস্কার আসবে—এই ছিল তাদের ‘টেলিপ্যাথিক ভবিষ্যদ্বাণী’। অথচ বাস্তবে যা ঘটেছে, তা এই বিশ্বাসের বিপরীত এক ইতিহাস: চীনের অর্থনীতি বিস্ফোরণমূলক হারে বৃদ্ধি পেলেও, রাষ্ট্রক্ষমতার রূপান্তর হয়নি—বরং কর্তৃত্ববাদের ভিত আরও পোক্ত হয়েছে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সংযুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব শিল্পায়নের যে ধাক্কা সৃষ্টি হয়, তা শুধু জিডিপি-র ভৌগোলিক মানচিত্র বদলেই শেষ হয়নি; তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক একাধিপত্যকেও কার্যত চ্যালেঞ্জ করেছে। এই পুনর্বিন্যাস প্রমাণ করে যে সমৃদ্ধি মানেই গণতন্ত্র নয়—এবং মুক্ত বাণিজ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদারনৈতিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেবে, এই ধারণাও আজ এক রাজনৈতিক কল্পচিত্র মাত্র।
চীনের উত্থান এবং তথাকথিত হাইপার-গ্লোবালাইজেশন—এই যুগল প্রক্রিয়া একদিকে যেমন বিশ্ববাণিজ্যের পরিধিকে বিস্তৃত করেছে, অন্যদিকে তেমনি ধ্বংস করে দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর, বিশেষত আমেরিকার, প্রথাগত উৎপাদন-শিল্পের ভিত। উৎপাদন খাতে বিপুল চাকরিহানি এবং আয়-বৈষম্যের মাধ্যমে এই পরিবর্তন সমাজে এমন এক অসন্তোষের বীজ বুনেছে, যা পরবর্তীতে পুষ্টি পেয়েছে জনতাবাদী (populist) রাজনৈতিক আন্দোলনের হাত ধরে। ব্রেক্সিট কিংবা ট্রাম্পের ক্ষমতায় আরোহন—এইসব ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম নয়; বরং তা উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার তথাকথিত ‘সুবিধা’ যাদের ঘরে পৌঁছায়নি, সেই শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়াশীল জাগরণ। দীর্ঘদিন ধরে প্রচারিত “মুক্ত বাণিজ্য মানেই সমৃদ্ধি” এই বিশ্বাস এখন প্রশ্নের মুখে, কারণ দেখা যাচ্ছে—সমৃদ্ধির সুফল বণ্টিত হচ্ছে প্রবল অসমতায়। এর ফলেই পশ্চিমে উদারনৈতিক মূল্যবোধের প্রতি বিরাগ ও অনাস্থা ক্রমেই বাড়ছে, এবং তার জায়গা নিচ্ছে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব ও অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার নামে রক্ষণশীল অর্থনৈতিক নীতির প্রত্যাবর্তন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিক শান্তি ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য নির্মিত হয়েছিল—যেমন WTO, IMF, ও বিশ্বব্যাংক—তাদের ভিত আজ প্রশ্নবিদ্ধ: কার্যকারিতার সংকট ও নৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব তাদের কার্যত স্থবির করে তুলেছে। সদস্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্য নব্য ঔপনিবেশিক পরিসরে আরও এক গভীর ফাটল তৈরি করেছে। এরই ফাঁকে, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (AIIB) মতো বিকল্প সংস্থা আত্মপ্রকাশ করছে—যা কেবল অর্থনৈতিক বিন্যাস নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের নতুন মঞ্চ। এই পরিক্রমা কেবল পশ্চিমা কর্তৃত্বকেন্দ্রের হ্রাস নয়; বরং এটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার অভিযোজনক্ষমতা ও মধ্যস্থতাকারী ভূমিকারও স্পষ্ট সীমারেখা চিহ্নিত করছে। বিশ্বব্যাপী সমন্বিত অগ্রগতির জন্য বহুস্তরীয় সহযোগিতা অপরিহার্য হলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই সহযোগিতা প্রায় অনুপস্থিত—বিশেষ করে সেইসব ক্ষেত্রে যেখানে সংঘর্ষ ও অসমতা প্রকটতম।
পুনর্বিন্যস্ত বিশ্বক্ষমতার এই চলমান ঢেউ একুশ শতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যে-‘উদার বিশ্বব্যবস্থা’ গঠিত হয়েছিল, তার অস্তিত্বকেই আজ প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘বিশ্বব্যবস্থার দায়িত্ব’ থেকে সরে এসে নিজস্ব স্বার্থকেই নীতিনির্ধারণের একমাত্র মাপকাঠি করে তোলে—এই মোড় পরিবর্তনের মধ্যেই চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য অভূতপূর্বভাবে সম্প্রসারিত হয়। নেতৃত্ব আজ আর কেবল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাহক নয়—বরং ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও ‘ব্যক্তি-পুরস্কারপ্রাপ্ত কর্তৃত্বের’ এক সাংস্কৃতিক পরম্পরা তৈরি করেছে, যা গণতান্ত্রিক অনুশাসনের স্থলে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতাকেই উৎসাহিত করছে। ঐতিহ্যগত অর্থনৈতিক মৈত্রীর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে, এবং মার্কিন ভূমিকাও ক্রমেই অস্পষ্ট—ফলে বৈশ্বিক ক্ষমতার চিত্রপট এক বহুধ্রুবীয় বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, ও সামাজিক কল্যাণ—এই ত্রয়ীর ঐতিহাসিক সমীকরণ আজ পুনঃমূল্যায়নের মুখে। এমন বাস্তবতায় বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাই সংস্কার, অভিযোজন এবং বিশ্ব নেতৃত্বের এক নতুন সংজ্ঞা।
উদার বিশ্বব্যবস্থা, যা একসময় ছিল অটুট ও আত্মবিশ্বাসী, আজ তীব্র চ্যালেঞ্জের মুখে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক, ব্যক্তি-আধিপত্য বনাম প্রতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা, এবং বহুপাক্ষিকতা বনাম জাতীয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব—এসব এখন আর কেবল তাত্ত্বিক বিতর্ক নয়, বরং বাস্তব নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এই জটিল ও গতিশীল যুগে প্রয়োজন একটি নতুন ধরনের কল্পনা—যেখানে কেবল পশ্চিম নয়, বরং গোটা বিশ্বের অভিজ্ঞতা ও পরিপ্রেক্ষিত থেকে আমরা ভবিষ্যতের বিশ্বব্যবস্থা নির্মাণের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।
যদি দ্য আটলান্টিক চার্টার পড়তে চান তাহলে এই লিঙ্কটি দেখুন।