গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলেছিলেন, “Nothing interesting happened to me after the age of eight.” — বাংলা করলে দাঁড়ায়, "আমার জীবনে আট বছর বয়সের পর আর কিছুই ঘটেনি, যেটাকে 'মজার' বলা চলে।"
এখন, যদি কেউ দার্শনিক মুডে না থাকে, তাহলে এই কথাটা শুনে মাথা চুলকে বলতে পারে—“আচ্ছা, উনি তো সাহিত্যের ম্যাজিক রিয়ালিজমের মহারাজ! যাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসে ‘শতবর্ষের নি:সঙ্গতা’! সেই উনি বলছেন জীবনে কিছু ঘটেনি? তাহলে আমরা?
কিন্তু মার্কেজের কথার মধ্যে আছে সেই অদ্ভুত চটচটে গূঢ় সত্য যা শুধু আত্মজৈবনিক নয়, অস্তিত্বজৈবনিকও বটে। আট বছর পর্যন্ত, মানুষের জীবন হল—নিয়ম নেই, কাকুতি-মিনতি নেই, ‘কী হয়ে বড় হবে’ প্রশ্ন নেই। তখন, একটা ফুলকে ফুল বলে টেনে ছিঁড়ে নেওয়ার জন্য পরিবেশবাদীর ধমক খেতে হয় না। একটা মেঘকে বাঘ বা ঘোড়া মনে করে আঁকলে, কেউ বলে না “এটা অ্যানাটমিকালি ইনকরেক্ট”।
আট বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের সমস্ত কল্পনা-চোখে ঘুরে বেড়াত কুসুমকুমারী কবিতার মত ‘আকাশে জ্বলছে তারা, ওটা নিশ্চয় কোনো দেশের ট্রেন’। আট পেরোলেই, আপনাকে বলা হবে, ‘ওটা ওরিয়ন বেল্ট, এবং ট্রেনগুলো আরেকটু কার্বন নিঃসরণ কমালে পৃথিবীটা ভালো থাকে।’ বাচ্চা থাকতেই ভালো ছিলাম, মানে তখন ‘গ্র্যাভিটি’ বলতে বোঝাতাম ‘নিচে পড়ে যাওয়ার ব্যাপার’, এখন বোঝায় ওয়েব সিরিজের স্পয়লার-ভারী আবেগ।
আটের পর মানুষ ‘রুটিন’ নামক এক জৈবপ্রযুক্তিকে আত্মস্থ করে ফেলে। সান্টা ক্লজকে চোর বলার লোকগুলো তখন বলে, “ভালো স্কুলে পড়লে তোমার ভবিষ্যৎ ভালো হবে”—মানে, প্লেটোর রিপাবলিক নয়, জাস্ট গুগলে চাকরি পেলেই আপনা-আপনি হ্যাপিনেস ডিফাইনড। একসময় রেলগাড়ির হুইসেল শুনলেই মনে হতো, পাড়ার বাইরে অন্য গ্রহে যাওয়ার ডাক। আর এখন ওটা মানে ঘুমের ট্রেন মিস হল।
মার্কেজ আসলে একখানা জেল্লাদার দার্শনিক ছুঁড়ে দিয়েছেন, মোড়কটা নির্লিপ্ত। তিনি বললেন না, “I lost my sense of wonder.” তিনি বললেন, কিছু ঘটেনি। অর্থাৎ, যা ঘটেছে, তা হয় রিপোর্টকার্ডে লেখা থাকে, নয়তো সিভিতে। সেইটুকু ঘটেছে, বাকি যা ঘটেনি—সেটাই 'interesting' ছিল।
এই কথাটার পাশে দাঁড়ালে আমরা দেখতে পাই, আমাদের ফেসবুক ‘পোস্ট’ নয়, পোস্টমর্টেম। সেখানে লেখা থাকে, “বাবা মারা গেলেন, তিনি বলতেন, ছোটবেলায়…”—মানে ইন্টারেস্টিং কোনো ঘটনার জন্য কাউকে মরতে হচ্ছে। জীবিতাবস্থায় এমন কিছু ঘটছে না, যা ছেলের স্টেটাস পাওয়ার যোগ্য।
এবং এইখানেই এসে পড়ে মার্কেজীয় আইরনির ম্যাজিক। লেখক হিসেবে যার জীবনে ঘটেছে কাল্পনিক যুদ্ধ, যাদুবাস্তব প্রেম, অলৌকিক মহামারি—তিনি বলেন, “আমার জীবনে কিছু ঘটেনি।” আসলে, মানুষ যখন ‘বড়’ হয়, সে ভাবে সে বড় হচ্ছে। কিন্তু মূলত সে কুঁকড়ে যাচ্ছে, শুঁটকি মাছের মতো। এবং আট বছর পর্যন্ত আমাদের আত্মা যতটা স্পঞ্জ ছিল, তার পর তা হয়ে যায় ফাইল-কাভার—ক্লান্ত, কাঠখোট্টা, কাঠামোয় বাঁধা।
তাই, মার্কেজের কথাটা আসলে একটা অভিশাপ নয়, একটা সরল সতর্কবার্তা। “শোনো ভাই, যতক্ষণ তুমি একটা রঙিন জুতার ফিতেকে ডাইনোসর ভাবতে পারো, ততক্ষণই তুমি interesting. তারপর তুমি শুধু income-tax return ফাইল করা একটা প্রাণী। জীবনের সঙ্গে নয়, এক্সেলের সঙ্গে বসবাস করো।”
তবে একটা আশার কথা আছে—এই গপ্পোটা বললেই বোঝা যায়, কিছু কিছু মানুষ ‘আট বছরের পর’ যা কিছু ঘটেছে, তা আবার নতুন করে ঘটায়। তারা কল্পনার কলমটা ফের তুলে নেয়। তারা আবার মেঘ দেখে গরুর পাল ভাবে, আর রাস্তার ভাঙা ড্রেন দেখে মনে পড়ে যায় মোগলি। সেসব মানুষই লেখে, পড়ে, ভালোবাসে, ভিজে পড়ে বৃষ্টি নামলে, আর একটা বাচ্চা বললে “ও আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে”, তখন বলে, “হ্যাঁ, ও কোনো দেশ নয়, কোনো স্বপ্ন খুঁজছে।”
এবং তারা হয়তো মার্কেজকে বুঝে ফেলে। বুঝে ফেলে, interesting কিছুই ঘটেনি আটের পর—কারণ interesting ব্যাপারগুলো আমরা ঘটানো ছেড়ে দিয়েছি। কারণ আমরা আটটা বাথরুম-ব্লু বেলুনকে আঁধার বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছি।
তবে কেউ কেউ, সেই সাহসটা ফের জোগাড় করে। তারাই হয় মার্কজ। আর বাকিরা তাদের বই পড়ে ভাবে, “ওহো, এমন গল্প তো জীবনে ঘটেনি”—হয়তো ঘটেছিল, কিন্তু আট বছর বয়সেই শেষ।