ইসলাম ও নাৎসি জার্মানির যুদ্ধ
ডেভিড মোটাদেল রচিত "Islam and Nazi Germany's War" বইটি আমাদের ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায়ের দরজা খোলে—নাৎসি জার্মানি কীভাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বকে সামরিক এবং রাজনৈতিক খেলার বোর্ডে টেনে
Islam and Nazi Germany's War
David Motadel
একটি পর্যালোচনা
রিটন খান
ডেভিড মোটাদেল রচিত "Islam and Nazi Germany's War" বইটি আমাদের ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায়ের দরজা খোলে—নাৎসি জার্মানি কীভাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বকে সামরিক এবং রাজনৈতিক খেলার বোর্ডে টেনে আনার চেষ্টা করেছিল। মোটাদেলের গবেষণা আসলে সেইসব প্রচেষ্টার উপর আলোকপাত করে, যা একদিকে ছিল রাজনৈতিক কৌশল, আরেকদিকে ছিল প্রপাগান্ডার অসামান্য উদাহরণ। তবে, তার গবেষণা শেষে যে ছবিটি ফুটে ওঠে, তা এক দীর্ঘমেয়াদী ব্যর্থতার গল্প।
এভাবে, ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে মুসলিমদের একত্রিত করার অপচেষ্টার মধ্যে দিয়ে মোটাদেল দেখান কীভাবে ইসলামকে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের নির্দিষ্ট ঘটনাগুলোর পেছনের উদ্দেশ্য আর বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে যে ফাঁক, সেটাই মোটাদেল তুলে ধরেছেন—একটি এমন ব্যর্থতার চক্র, যা আসলে রাজনৈতিক কৌশলের পতনের গল্প।
বইটির একটি কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ হলো—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তি উভয়ই মুসলিম জনগোষ্ঠীর মন জয় করার জন্য ব্যাপক কৌশলগত প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। মোটাদেল তার বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, এসব প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
মোটাদেল আরও উল্লেখ করেছেন, নাৎসি জার্মানি ইসলামকে ব্যবহার করার যে কৌশল গ্রহণ করেছিল, তা আদর্শিক নয়, বরং পুরোটাই কৌশলগত। এটি মূলত হিটলারের পরিকল্পনার চেয়ে ঔপনিবেশিক জার্মানির পূর্ববর্তী সামরিক অভিযানের কৌশলের ধারাবাহিকতায় অবস্থিত। ইউরোপীয় শত্রুদের দুর্বল করতে জিহাদি যোদ্ধাদের ব্যবহার করার ঐতিহ্যের মধ্যেই এই কৌশলের শিকড়।
মোটাদেল তাঁর বইয়ে দেখিয়েছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই জার্মান গোয়েন্দারা এক বিস্ময়কর কৌশলের পরিকল্পনা করেছিল—ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলিতে, বিশেষত ভারত থেকে মিশর পর্যন্ত, ইসলামিক বিদ্রোহকে উস্কে দেওয়া। এই অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন ম্যাক্স ভন ওপেনহেইম। তাঁর কার্যালয়ে একত্রিত হয়েছিল এক বিশাল কর্মীবাহিনী—একাডেমিক বিশেষজ্ঞ, কূটনীতিক, সামরিক কর্মকর্তা এবং মুসলিম সহযোগী, যাঁরা সকলেই এই ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়নের চেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন।
মোটাদেল এই প্রচেষ্টাকে "একটি ভুল অনুমানের উপর ভিত্তি করে নির্মিত" বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, জার্মানরা ভেবেছিল যে প্যান-ইসলামিক বিদ্রোহের জন্য যথেষ্ট ক্ষেত্র তৈরি আছে, অথচ বাস্তবে তা ছিল না। বরং, এই কৌশলটি জার্মানির রাজনৈতিক স্বার্থকে ঢাকতে ব্যর্থ হয়েছিল। মুসলিম বিশ্ব ছিল অত্যন্ত বিভক্ত, এবং একটি সমন্বিত বিদ্রোহের জন্য তারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না। উপরন্তু, মুসলিমদের কেন্দ্রীয় শক্তিগুলোর কৌশলগত স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টাটি ধর্মীয় চেতনাকে জাগিয়ে তোলার চেয়ে বেশি আত্মস্বার্থে আবদ্ধ ছিল।
হিটলার এবং হিমলারের মতো ব্যক্তিরা এই প্রাচীন কৌশলগুলির পুনরুত্থানে প্রবল আগ্রহী ছিলেন। মোটাদেল তাঁর বইয়ে দেখিয়েছেন, হিটলার প্রায়ই ইসলামকে খ্রিস্টান ধর্মের চেয়ে বেশি শক্তিশালী এবং বাস্তবমুখী বলে অভিহিত করতেন। তাঁর দৃষ্টিতে খ্রিস্টান ধর্ম ছিল দুর্বল, নরম, এবং আত্মত্যাগের একটি অবাস্তব আদর্শ।
মোটাদেলের বইয়ে হিমলারের ইসলামের প্রতি আকর্ষণ আরও বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। হিমলারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ফেলিক্স কের্স্টেন তাঁর স্মৃতিকথায় একটি পুরো অধ্যায় উৎসর্গ করেছেন হিমলারের ইসলাম ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি আগ্রহ নিয়ে। কের্স্টেনের ভাষ্য অনুযায়ী, রুডলফ হেসই প্রথম হিমলারকে কোরানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এর পর থেকে, হিমলার মাঝে মাঝে কোরান নিজের শয্যাপাশে রেখে পড়তেন।
মোটাদেল দেখিয়েছেন, হিমলারের ইসলাম-বিষয়ক মন্তব্যগুলো মূলত এক ধরনের রাজনৈতিক কারসাজি। এটি ছিল এক মরিয়া কৌশল—বিশেষ করে যুদ্ধের শেষ দিকে, যখন লাল ফৌজের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মুসলিম সৈন্যদের নিয়োগের চেষ্টা চালানো হয়।
মোটাদেল আরও লিখেছেন, নাৎসিদের মুসলিমদের প্রতি মনোভাবের মধ্যে গভীর উপকরণবাদ নিহিত ছিল। এ কারণে, যুদ্ধকালীন সময়ে তারা নিজেদের বর্ণবাদী নীতি পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে, হিটলার তুর্কি, আরব ও ইরানীদের নিকৃষ্ট জাতি বলে মনে করতেন। কিন্তু জনসমক্ষে, সামরিক জোটকে যথাযথ মনে করানোর জন্য তিনি নাৎসি জাতিতত্ত্বের একটি সুবিধাজনক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন।
মোটাদেল তাঁর বইয়ে দেখিয়েছেন, পারস্য ও তুর্কিদের ক্ষেত্রে কিছু জাতিতাত্ত্বিক নীতির ব্যাখ্যা দিয়ে তাদেরকে নাৎসি বর্ণবাদী কাঠামো থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব ছিল। কিন্তু আরবদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল আরও জটিল। কারণ, বেশিরভাগ জাতিবাদী তাত্ত্বিকই আরবদের "সেমেট" গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মনে করতেন।
নাৎসি কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে সামরিকভাবে চ্যালেঞ্জ করার জন্য সেমেটদের প্রতি প্রকাশ্য বিরূপ মনোভাব প্রদর্শন বিপজ্জনক হতে পারে। তাই, ১৯৩৫ সালের গোড়ার দিকে, নাৎসি প্রচার মন্ত্রক সংবাদমাধ্যমকে নির্দেশ দেয় "সেমেট-বিরোধী" এবং "সেমেটিজম-বিরোধী" শব্দগুলো পরিহার করতে এবং তার পরিবর্তে "ইহুদি-বিরোধী" শব্দটি ব্যবহার করতে।
মোটাদেলের বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যুদ্ধকালীন সময়ে মুসলিমদের সাথে নাৎসি জার্মানির সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা আসলে একটি নিষ্ঠুর রাজনৈতিক কৌশল ছিল। এই প্রচেষ্টা ইহুদি-বিদ্বেষী প্রোপাগান্ডার ছায়ায় লালিত, যা শেষমেশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক বেসামরিক মৃত্যু ও দুর্ভোগের জন্ম দেয়।
মোটাদেল তাঁর বইয়ে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, কেন পশ্চিমা কৌশলগুলো প্রায়শই মুসলিম বিশ্বে ব্যর্থ হয়। প্রথমত, এই ব্যর্থতার মূল কারণ পরিকল্পনাকারীদের ইসলামের বৈচিত্র্য সম্পর্কে অজ্ঞতা। তারা ইসলামের অভ্যন্তরীণ বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মের প্রভাবকে একীভূত করে দেখার প্রবণতা পোষণ করে। ফলে, ইসলামের নমনীয়তাকে অযথা বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।
দ্বিতীয়ত, এই ব্যর্থতার শেকড় প্রোথিত ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশ-পরবর্তী পশ্চিমা হস্তক্ষেপের দীর্ঘ ইতিহাসে। ওয়াশিংটন, লন্ডন বা বার্লিন থেকে মুসলিমদের অস্ত্র তুলে নিতে আহ্বান জানানো নতুন কিছু নয়। আগেও বহুবার তারা এমন আহ্বান শুনেছে—কথা দেয়া হয়েছে মুক্তির, কিন্তু শেষমেশ এসেছে প্রতারণা। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সেই দীর্ঘ ইতিহাস আর একের পর এক পশ্চিমা সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত স্মৃতি মুসলিম জনগণের মনে গেঁথে আছে। তাই, যখনই পশ্চিমা শক্তিগুলো নতুন করে জোট বাঁধার ডাক দেয়, তাদের চোখে তা নতুন কোনো চক্রান্তেরই প্রতিধ্বনি।