জেমস জয়েসের ইউলিসিস এখনও মগজ গলিয়ে দেয় — গলাক! ভেঙে ফেলুক! মগজ তো একটা পুরোনো টাইপরাইটার, তাতে পিঁপড়ে ঢুকেছে!
জেমস জয়েস ছিলেন একজন আইরিশ আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিক—যাঁর কলমে বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে ঘটে যায় এক মৌলিক বিপ্লব। A Portrait of the Artist as a Young Man থেকে ইউলিসিস—সবখানেই তিনি ভাষাকে করেছেন পরীক্ষার উ









ইউলিসিস (১৯২২) এক গ্রীষ্মদিনের ডাবলিনকে ঘিরে রচিত এক আধুনিকতাবাদী মহাকাব্য। ১৯০৪ সালের ১৬ জুন—একটিমাত্র দিনের, কিন্তু এক অনন্ত যাত্রার দিন—যেখানে দুই যুবক শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, আর তাদের পথে আসে বিচিত্র চরিত্র ও অভিজ্ঞতার ধারা। জেমস জয়েস তাঁর বুননশৈলীতে এমন এক জটিলতা তৈরি করেন, যেখানে পরিচয়, চেতনা ও মানুষের অভ্যন্তরীন জীবনযাপনের টানাপোড়েন যেন নীরবে বয়ে চলে—প্রতিটি বাক্যে, প্রতিটি স্তবকে।
জেমস জয়েস ছিলেন একজন আইরিশ আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিক—যাঁর কলমে বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে ঘটে যায় এক মৌলিক বিপ্লব। A Portrait of the Artist as a Young Man থেকে ইউলিসিস—সবখানেই তিনি ভাষাকে করেছেন পরীক্ষার উপকরণ, চিন্তাকে বানিয়েছেন কাব্যের ছন্দ। পরবর্তীকালে উত্তর-আধুনিক সাহিত্যের বহু প্রবণতা তাঁর সৃষ্ট শিকড় থেকেই পুষ্ট হয়েছে।
বিশ্বসাহিত্যে এমন কিছু গ্রন্থ আছে—যা একদিকে কালজয়ী, আর অন্যদিকে পাঠকের কাছে ভয়াবহ দুর্বোধ্য। জেমস জয়েসের ইউলিসিস নিঃসন্দেহে সেই বিরল শ্রেণির সদস্য। একে 'ক্লাসিক' বলা হয়, কারণ এই গ্রন্থ আমাদের সাহিত্যভাষাকে আমূল বদলে দিয়েছে—যেন আধুনিক মানুষের মনোজগৎ, সংশয় আর ব্যক্তিগত জটিলতা প্রথমবারের মতো সাহিত্যে সত্যিকার স্বরে কথা বলতে পেরেছে।
এই উপন্যাসে শৈলীর দিক থেকে এক ধরনের বিপথগামী সৌন্দর্য আছে—প্রতিটি অধ্যায় যেন একেকটি ভিন্ন সাহিত্যরীতি, আর চেতনাপ্রবাহের মাধ্যমে মানুষের অন্তর্জগৎ এমন নিরাভরণভাবে উন্মোচিত হয়েছে যা পূর্বে কল্পনাও করা যেত না। ইউলিসিস আধুনিকতাবাদী সাহিত্যযুগের উন্মেষে সহায়তা করেছে, আর তার অনুরণন আমরা উত্তর-আধুনিক লেখকদের কাছেও পাই। কিন্তু এইসব গুণই একে করেছে দুরূহ—এমন একটি বই, যা পাঠকের ধৈর্য ও মনঃসংযোগ উভয়ের পরীক্ষাকেন্দ্র। এই প্রবন্ধে আমরা চেষ্টা করব সেই দুর্ভেদ্য রচনাটিকে সরলভাবে খুলে বলার—যাতে আপনি বুঝতে পারেন, এই বই আসলে কোথা থেকে আসে এবং তার কী প্রস্তাব আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।
ইউলিসিস-এর অসংখ্য স্তর ও সূক্ষ্ম বুনন নিয়ে আলোচনা শুরু করাটাই অনেকের কাছে এক দুঃসাহসিক যাত্রার মতো মনে হতে পারে। এবং সত্যিই তা। তাই চলুন শুরুটা করি একেবারে শুরু থেকে—শিরোনাম দিয়ে। 'ইউলিসিস' আসলে এক পুরনো সাহিত্যকীর্তির প্রতি ইঙ্গিত—হোমারের The Odyssey, যার ছায়া জয়েসের এই আধুনিক মহাকাব্যে গভীরভাবে প্রোথিত।
দ্য ওডেসি
১৯২১ সালে জয়েস তাঁর আন্ট জোসেফিনকে একটি চিঠিতে উপদেশ দিয়েছিলেন— "যদি ইউলিসিস পড়তে চাও, তবে আগে লাইব্রেরি থেকে হোমারের ওডিসির গদ্য অনুবাদটা এনে পড়ে ফেলো।" কথাটা কেবল জোসেফিনের জন্য নয়— আমাদের সকলের জন্যও। আমাদের মধ্যে অনেকেই স্কুলজীবনে হোমারের Odyssey পড়েছি (বা পড়তে বাধ্য হয়েছি)। তবু ‘ইউলিসিস’-এ হাত রাখার আগে, সেই পুরনো পথঘাট একবার নতুন করে হেঁটে নেওয়া ভাল— যেমন নদীর চেনা বাঁকেও মাঝেমধ্যে হঠাৎ নতুন আলোর খেলা দেখা যায়।
জয়েস তাঁর মহাকাব্যের অধ্যায়গুলোর নাম রেখেছেন ‘ওডিসি’র চরিত্রদের নামে— যেন সে এক ছায়াপথের মানচিত্র, হোমারের রচনার ছায়ায় আঁকা। ‘ইউলিসিস’-এর আখ্যান হোমারের পথে হাঁটলেও, তা এক দশকের কাহিনি নয়— কেবলমাত্র আঠারো ঘণ্টার গোপন জলছবি। আর সর্বত্র ছড়ানো বিদ্রুপের রেখা— যেমন পেনেলোপে তাঁর স্বামীর প্রত্যাবর্তনের আশায় বছরের পর বছর কাটিয়েছেন নিষ্ঠায়, আর তাঁর ছায়া চরিত্র মলি ব্লুম, সে তো আজ বিকেলেই ব্লেজেস বয়লানের সঙ্গে শুয়ে ফেলেছে, স্বামী ব্লুমের প্রতি অবিশ্বাসের এক নিঃশব্দ জয়ঘোষ। এইভাবেই জয়েস হোমারের ছায়ার তলে আধুনিক জীবনের রূঢ় বাস্তবতা আঁকেন।
Odyssey-র সূচনা সেই বিষণ্ণ দৃশ্য দিয়ে—যেখানে টেলিম্যাকাস, সদ্য কৈশোর পেরোনো ওডিসিউস-পুত্র, বসে আছে নিজেরই ঘরের এক কোণে, অপারগ, নির্বাক। পেনেলোপের প্রেম ও রাজ্য দখলের আশায় দুর্বৃত্ত প্রণয়প্রার্থীরা তার বাড়ি ঘিরে রেখেছে। তারা অনায়াসে খাচ্ছে ঘরের ভান্ডার, ঢালছে মদের পেয়ালা, আর টেলিম্যাকাস, যেন এক নির্বাক সাক্ষী, তার পিতার অভাব আর মাতার অবরুদ্ধ যাপনের মাঝখানে স্থবির হয়ে আছে।
তবে এই গল্প একা টেলিম্যাকাসের নয়—এই অনুপস্থিতি, এই দীর্ঘ প্রতীক্ষা ওডিসিউসেরও। ট্রয় যুদ্ধ শেষে, ট্রয়ান হর্সের চাতুর্য দিয়ে শত্রুকে হারিয়ে বিজয় অর্জনের পর, সে আর ফেরেনি। সাগরের অতলে সে কি হারিয়ে গেছে? মৃত্যু কি তাকে গ্রাস করেছে? কেউ নিশ্চিত জানে না। শুধু অনুপস্থিতির ভিতর ভেসে বেড়াচ্ছে এক অমীমাংসিত শূন্যতা।
এই জড়তায় হঠাৎ নেমে আসে অ্যাথেনা—দেবতাদের অলিম্পাস থেকে—যেন আত্মবিশ্বাসের এক ঝলক। সে টেলিম্যাকাসকে আহ্বান জানায়, পূর্ণবয়স্ক হয়ে উঠতে, দাঁড়াতে। টেলিম্যাকাস সম্মেলন ডাকে, অভিজাত পাত্রদের সামনে উচ্চারণ করে প্রতিরোধের ভাষা—‘এই ঘর ছাড়ো’। তারা যায় না। কিন্তু এবার সে নিজেই যাত্রা শুরু করে—তার পিতার সন্ধানে, তার পরিচয়ের খোঁজে। প্রথমে যায় নেস্টরের কাছে, তারপর মেনেলাওসের—পিতার পুরনো সঙ্গীরা, যাঁরা একদিন যুদ্ধের ধুলায় ওডিসিউসের পাশে ছিলেন।
নেস্টর—বয়সে প্রাজ্ঞ, কিন্তু তথ্যের দিক থেকে নিরুপায়—টেলিম্যাকাসকে পাঠিয়ে দেন স্পার্টার রাজা মেনেলাওসের দরবারে। মেনেলাওস জানান, সমুদ্রের আকার বদলাতে পারা বৃদ্ধ প্রোটিউসের কাছ থেকে তিনি জেনেছেন—ওডিসিউস বেঁচে আছে, কিন্তু বন্দি ক্যালিপসোর দ্বীপে, দেবী-নিম্ফের ভালোবাসায় আবদ্ধ।
এবার কাহিনি পট পরিবর্তন করে সরাসরি ওডিসিউসের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা শুরু হয়। সে তখন ক্যালিপসোর দ্বীপে বন্দি—সমুদ্রের নিস্তরঙ্গ পাড়ে বন্দিত্বের দীর্ঘশ্বাস। জিউস, অলিম্পাসের চূড়া থেকে, হের্মিসকে পাঠান তার মুক্তির আদেশ নিয়ে। ক্যালিপসো, অনিচ্ছাসত্ত্বেও, তাকে যেতে দেয়। কিন্তু ভাগ্য সহজ নয়—সমুদ্রে পড়তেই, পসেইডনের রোষে পড়ে জাহাজডুবি হয়, এবং ক্লান্ত, রিক্ত, প্রায় নগ্ন অবস্থায় ওডিসিউস ভেসে ওঠে ফিয়াশিয়ানদের দেশে। রাজকুমারী নাওসিকা তাকে উদ্ধার করে, পরিচর্যা করে, শুশ্রূষায় ফিরিয়ে আনে তার মানবিক মর্যাদা।
ফিয়াশিয়ানদের রাজসভায় বসে, ওডিসিউস নিজের দীর্ঘ, বিচিত্র যাত্রাপথ বর্ণনা করে—ট্রয় থেকে শুরু করে বর্তমান অবধি। কাহিনিগুলো যেন একেকটা রূপকথা—যেখানে সে ধাঁধা দিয়ে হার মানায় দানবাকৃতি সাইক্লোপসকে, এক বছর কাটায় চতুরিনী জাদুকরী সার্সির সঙ্গে, নেমে যায় পাতালের দরজায়, ফিরিয়ে আনে তার সঙ্গীদের লোটাসভূমির তন্দ্রা থেকে, পাড়ি দেয় লেস্ট্রিগনীয় মানুষেরখেকো জাতির দেশ, এড়িয়ে চলে স্কিল্লা ও ক্যারিবডিস নামক দু'জন জলদানবের মাঝে সূক্ষ্ম পথ, আর টিকে থাকে সিরেনদের মোহময় গান থেকে।
অবশেষে, এক ছদ্মবেশে সে ফিরে আসে নিজের রাজ্য ইথাকায়—যেখানে এখনো দখলদার প্রেমিকদের পদচারণায় প্রাসাদ গুমরে মরছে। সে মিলিত হয় এখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠা পুত্র টেলিম্যাকাসের সঙ্গে, বিশ্বস্ত শূকরপালক ইউমাইয়াসের কাছে নিজের পরিচয় প্রকাশ করে। একত্রে তারা দাঁড়ায়, তরবারি তোলে, এবং এক এক করে নির্মূল করে সেই অনধিকারপ্রবেশকারীদের—পুনরুদ্ধার করে রাজ্য, পুনরায় ফিরে পায় পেনেলোপে নামের সেই অপেক্ষার প্রতিমূর্তিকে।
হ্যামলেট
Odyssey'র পর, জেমস জয়েসের Ulysses সবচেয়ে গভীর ও ধারাবাহিক প্রতিসংলগ্নতা খুঁজে পায় শেক্সপিয়ারের Hamlet-এ। তাই এই ক্লাসিক নাটকের প্রেক্ষাপট ও মূল সুরের একটি সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর পাঠ উপকারী হয়ে ওঠে।
গল্পের সূচনা ডেনমার্কের এলসিনোর রাজপ্রাসাদের প্রাচীরে, রাতের নিস্তব্ধতা ছেঁড়ে উঠে আসে এক গুজব—মৃত রাজা হ্যামলেটের প্রেতাত্মা দেখা দিয়েছে, তাও একবার নয়, দু’বার। হোরাশিও, রাজপুত্র হ্যামলেটের বিশ্বস্ত বন্ধু, অবিশ্বাস ও কৌতূহলের দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে, আসে এই অলৌকিকতার সত্যতা যাচাই করতে। প্রেতাত্মাটি আবারও আসে, নীরব থাকে, আর হোরাশিও স্থির করেন—এই কথা হ্যামলেটকে জানাতেই হবে।
যা রয়ে গেছে সাহিত্য ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্রুপদী পঙ্ক্তিগুলোর একটি—"Something is rotten in the state of Denmark"—তা এখানে নিছক রূপক নয়, বরং এক রাজনৈতিক ও নৈতিক পচনের আলামত। হঠাৎ করেই প্রাক্তন রাজা মৃত্যুবরণ করেছেন, আর সিংহাসন স্বাভাবিক উত্তরাধিকার সূত্রে পুত্র হ্যামলেটের কাছে না গিয়ে পৌঁছেছে তাঁর কাকা ক্লডিয়াসের হাতে—যিনি আবার রাজার বিধবা স্ত্রী গারট্রুডকে বিয়েও করে ফেলেছেন। একবাক্যে, ক্লডিয়াস কেবল একজন আত্মীয় নন, এক দখলদারও বটে—একজন রাজা নয়, যিনি রাজত্ব দখল করেছেন ছায়ার পথ ধরে।
প্রিন্স হ্যামলেট তখন সদ্য ফিরে এসেছেন উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে—পিঠে বইয়ের গন্ধ, মনে শোকের ছায়া। পিতার হঠাৎ মৃত্যু আর মাতার এমন তাড়াহুড়ো করে এক ‘নিম্নমানের’ পুরুষকে বিয়ে করে ফেলা—এই দুটো যন্ত্রণাই যেন মিলেমিশে হয়ে উঠেছে এক নিঃশব্দ, অথচ অবর্ণনীয় হাহাকার। ক্লডিয়াস ও গারট্রুড—দুজনেই হ্যামলেটকে বোঝাতে চায়, শোক পুষে রাখার কিছু নেই, রাজনীতি ও বাস্তবতা যেন নৈতিকতার প্রতিস্থাপক।
কিন্তু হ্যামলেট, কেবল এক পাণ্ডিত্যবান যুবক নন, তিনি এক তীক্ষ্ণ বিদ্রুপে মোড়া বিষাদগ্রস্ত আত্মা—যার প্রতিটি বাক্য যেন একই সাথে রসিকতা ও অভিশাপ। তিনি প্রেমেও পড়েছেন—ওফেলিয়া, পোলোনিয়াসের কন্যা এবং লার্টিসের বোন। কিন্তু এই দুই পুরুষ অভিভাবক ওফেলিয়াকে উপদেশ দেয়—রাজপুত্রের প্রেম থেকে দূরে থাকতে, যেন ভালোবাসাও এক ধরনের বিপজ্জনক রাজনীতি।
এমন এক সংকটে, হ্যামলেট এক রাতের নির্জনে মুখোমুখি হন সেই প্রেতাত্মার, যিনি আর কেউ নন—তার পিতা। মৃত রাজা জানান, তাঁর মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, বরং খুন—ক্লডিয়াসের হাতে। এই মুহূর্তে নাটক আর বাস্তবতা এক সরু দড়িতে হাঁটে—হ্যামলেটকে পিতার আত্মা শপথ করান, প্রতিশোধের, রক্তের দায় মেটানোর।
এখান থেকেই শুরু হয় সেই চিরকালীন জিজ্ঞাসা—হ্যামলেট কি সত্যিই পাগল, না কি কেবল অভিনয় করছে? সে কি সত্যিই স্নায়ুবিক ভেঙে পড়েছে, না কি তার প্রতিপক্ষদের ধোঁকা দিতে নিজের হুঁশ হারানোর অভিনয় করছে? এই প্রশ্নের উত্তর কখনোই চূড়ান্ত হয় না—এটাই Hamlet-এর সবচেয়ে আধুনিক দোলাচল।
এমন সময় প্রাসাদে এসে পৌঁছায় এক যাযাবর নাটকের দল। হ্যামলেট যেন নিজের ছায়া খুঁজে পায় এই শিল্পীদের মধ্যে—তাদের দিয়ে সে এক নাটক মঞ্চস্থ করায়, যার কাহিনি রাজা হ্যামলেটের হত্যাকাণ্ডের প্রতিরূপ: একজন রাজাকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিষ ঢেলে মেরে ফেলা হয়—কানের ভিতর দিয়ে বিষ ঢেলে দেয় ঘাতক। হ্যামলেটের উদ্দেশ্য পরিষ্কার—মঞ্চে এই দৃশ্য দেখে ক্লডিয়াসের মুখে যদি ভয়, গ্লানি বা অস্থিরতার ছাপ পড়ে, তবে প্রমাণ হবে সত্যি তার কাকাই পিতার খুনি।
এবং ঠিক তাই ঘটে—নাটকের মাঝপথেই ক্লডিয়াস উঠে পড়ে, আতঙ্কে ভেঙে পড়ে। একে দেখে হ্যামলেট নিশ্চিত হন—প্রতিশোধের পথ ন্যায্য। কিন্তু যখন তিনি প্রাসাদের গির্জাঘরে ক্লডিয়াসকে একা পান, তখন ঘটে আরেক মোচড়। ক্লডিয়াস তখন প্রার্থনায় রত, নিজের অপরাধ স্বীকার করছে ঈশ্বরের সামনে। হ্যামলেট মনে করে—এমন অবস্থায় তাকে মারলে, সে সরাসরি স্বর্গে চলে যাবে। এ যেন এক ধরনের ‘ন্যায়বোধ’ কিংবা, হতে পারে, নিজের প্রতিশোধ-সংকল্পে বারবার পিছিয়ে পড়ার ‘ভীরুতা’।
এরপর হ্যামলেট মুখোমুখি হয় মায়ের—গারট্রুডের। তীব্র বাক্যবাণে তিনি মাকে তুলোধোনা করতে থাকেন, দাম্পত্য এবং বিশ্বাসঘাতকতার প্রশ্নে। এমন সময়, পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পোলোনিয়াসের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। হ্যামলেট মনে করেন ক্লডিয়াস লুকিয়ে আছে, এবং কোনো চিন্তা না করেই তরবারি চালিয়ে দেন—পোলোনিয়াস নিহত হন। এরপরও তিনি বাক্যবাণ চালিয়ে যান, কিন্তু তখন আবার হাজির হয় পিতার প্রেতাত্মা—যিনি বলেন, ‘মাকে আঘাত দিও না’। গারট্রুড কিছুই দেখতে পান না, ভাবেন হ্যামলেট পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। তবু, মায়ের মুখে এক প্রতিজ্ঞা উঠে আসে—তিনি আর ক্লডিয়াসের শয্যাসঙ্গিনী হবেন না।
এই অবস্থাতেই ক্লডিয়াস ছলনার আশ্রয় নেন—হ্যামলেটকে ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দেন রোজেনক্রান্টজ ও গিল্ডেনস্টার্নের সঙ্গে, যাদের হাতে আছে এক গোপন চিঠি: হ্যামলেট যেন ইংল্যান্ডে পৌঁছেই হত্যা করা হয়। এদিকে ডেনমার্কে ফিরে আসেন লার্টিস—পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে আগুনে জ্বলন্ত এক যুবক। এই লার্টিস যেন হ্যামলেটের বিপরীত প্রতিবিম্ব—যিনি নিজের পিতার হত্যার বদলা এখনও নিতে পারেননি। ক্লডিয়াস লার্টিসকে বলে দেন, ‘তোমার পিতাকে হ্যামলেটই মেরেছে’। আর ওফেলিয়া? ভালোবাসা, শোক ও বিচারে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে, সে পাগল হয়ে যায়—আর একদিন নিঃশব্দে ডুবে যায় জলের অতলে।
হ্যামলেট শেষমেশ পালিয়ে যায় মৃত্যুর মুখ থেকে—একদল জলদস্যুর সহায়তায়, যেন ঈশ্বরের ইচ্ছায় নেমে আসে এক অলৌকিক মোচড়। আমরা একে deus ex machina বলি, কিন্তু ক্ষমা করে দিই, কারণ ট্র্যাজেডির পথ এমনই—হঠাৎ মোড়, হঠাৎ মুক্তি, হঠাৎ পতন। ডেনমার্কে ফেরার পথে সে দাঁড়ায় এক কবরখানায়—আর হাতে তুলে নেয় এক পুরনো বন্ধু, যোরিকের খুলি। সেখানে সে প্রশ্ন তোলে—জীবন আসলে কী? মৃত্যু কোথায় আমাদের নিয়ে যায়? হাসির যে মুখ একদিন তাকে আনন্দ দিত, আজ তা নিছক হাড়ের গহ্বরে পরিণত—এ দৃশ্য যেন গোটা নাটকের আত্মা।
ওফেলিয়ার কবর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় লার্টিস হ্যামলেটকে দেখে ফেলে—অভিমানে, শোকে, প্রতিহিংসায় উন্মত্ত হয়ে পড়ে। তারা দুজন একে অপরকে ধাক্কা দেয়, কবরের ভেতরে গড়িয়ে পড়ে, যেন জীবিত দুই আত্মা জীবনের শেষ সীমারেখা ছুঁয়ে দেখছে। তবে তাদের পৃথক করে ফেলা হয়, এবং ক্লডিয়াস ঠিক করেন—তাদের মধ্যে হবে এক আনুষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব, তলোয়ার চালনা।
দ্বন্দ্বের আগে হ্যামলেট লার্টিসের কাছে ক্ষমা চান। কিন্তু এর মধ্যেই ছলনার খেলা চলছে গভীরতর স্তরে—ক্লডিয়াস এক পেয়ালায় বিষ মিশিয়ে রাখেন হ্যামলেটের জন্য, এবং লার্টিসের তরবারির ডগাতেও মাখানো থাকে বিষ। কিন্তু ছক বিঘ্নিত হয়—যে পেয়ালা হ্যামলেটের জন্য নির্ধারিত ছিল, তা ভুল করে গারট্রুড পান করেন। মঞ্চে নেমে আসে মৃত্যু।
ফেন্সিং ম্যাচ শুরু হয়, হ্যামলেট এগিয়ে আছেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তরবারি বদলে যায়, আর দুজনেই জখম হন—দুজনেই বিষে আক্রান্ত। গারট্রুড পড়ে যান বিষপান করে, মৃত্যুর মুখে। লার্টিস মৃত্যুর আগে সত্য প্রকাশ করেন—সে এবং ক্লডিয়াস মিলে এই চক্রান্ত করেছিল। তখন হ্যামলেট নিজের শেষ শক্তি সঞ্চয় করে ক্লডিয়াসকে ধরে, আর জোর করে বাকি বিষ মেশানো মদ পান করান—প্রতিশোধ সম্পন্ন হয়।
মৃত্যুর মুহূর্তে হ্যামলেট ও লার্টিস একে অপরকে ক্ষমা করে দেন। হোরাশিও পাশে থাকেন, তাকে ধরা পড়ে শেষ সংলাপের ভার—হ্যামলেট বলেন, ‘বাকি গল্পটা তুমি বলো’। তারপর, সব শেষ হয়ে গেলে, নরওয়ের রাজপুত্র ফোর্টিনব্রাস প্রবেশ করেন—একটি মৃত রাজ্য আর তার রাজপুত্রের অব্যক্ত উত্তরাধিকারের প্রহরায়।
আর তাই, Ulysses’এর সঙ্গে Hamlet'র সংলগ্নতাগুলো—ক্ষমতা দখলের গোপন কাহিনি, পিতৃশোক ও প্রেতের ছায়া, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে উথলে ওঠা বিবেক, প্রতারণা ও বিয়ের ভাঙা প্রতিশ্রুতি—এই সবই মিলে এক নিঃশব্দ সুর বয়ে আনে, যা জয়েসের পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়ায়।
জয়েসের প্রথম উপন্যাস A Portrait of the Artist as a Young Man, ১৯১৪ সালে প্রকাশিত, আমাদের নিয়ে যায় ডাবলিন শহরের ঘন আবহের ভেতর এবং পরিচয় করায় স্টিফেন ডেডালাস নামক এক বালকের সঙ্গে—যে পরবর্তীতে Ulysses-এর দুই মুখ্য চরিত্রের একজন হয়ে ওঠে। এই অর্থে, Portrait যেন Ulysses-এর এক নিঃশব্দ পূর্বসূরি—যেখানে পটভূমি, চরিত্র এবং আত্মসন্ধানের প্রারম্ভিক ছায়াগুলি রচনা হয়ে থাকে।
উপন্যাসটি ক্রমান্বয়ে এগোয় স্টিফেনের শৈশব থেকে কৈশোরে—আর সেই সঙ্গে বদলে যায় এর গদ্যভাষাও। পাঠকের চোখে ধরা পড়ে তার বেড়ে ওঠা—বিশ্বকে বোঝার ক্ষমতা যেমন তীক্ষ্ণ হয়, তেমনি গদ্যের জটিলতাও বাড়ে, চিন্তা-ভাবনার গভীরতাও ঘনীভূত হয়। শুরুর দিকে, ভাষা ও বাক্যগঠন একেবারে শিশুসুলভ—একটি শিশুর বোধ ও মননের আয়নায় প্রতিফলিত:
Once upon a time and a very good time it was there was a moocow coming down along the road and this moocow that was coming down along the road met a nicens little boy named baby tuckoo…
His father told him that story: his father looked at him through a glass: he had a hairy face. (P 3)
এই শব্দগুলো যেন শোনায় না—গড়িয়ে যায়, ঠিক যেমন একটি ছোট ছেলে বাবার গল্প শুনে মুখ হাঁ করে থাকে, গায়ের লোম খাড়া করে দেখে কাচের পেছনে বাবার দাড়িমুখ। এই বর্ণনায় ভাষার সরলতা কেবল কাহিনির বাহন নয়, বরং নিজেই একধরনের মনের মানচিত্র।
জয়েস খুব দ্রুত পাঠককে টেনে নিয়ে যান স্টিফেনের শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের দোরগোড়ায়—এই পর্বে সে পড়ে ক্লঙ্গোউস উড কলেজে, সেখানে ছাত্রজীবনের ছায়াচিত্র আঁকা হয় এক দুর্বল, অনিশ্চিত বালকের দৃষ্টিতে। এখানে স্টিফেন প্রথমবার অনুভব করে ‘মানিয়ে নেওয়ার’ সংকট—বন্ধুদের চোখে নিজেকে অদ্ভুত মনে হওয়া, সমাজের কোথায় সে দাঁড়িয়ে আছে সেই প্রশ্ন, আর সেই সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের তুচ্ছ নির্মমতায় অভিভূত হওয়া।
একদিন সে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে—জ্বর, দুর্বলতা আর আতঙ্ক। তার চশমা ভেঙে যায়, আর শিক্ষক ভুলভাবে তাকে দোষারোপ করেন—জানিয়ে দেন, স্টিফেন ইচ্ছাকৃতভাবে চশমা ভেঙেছে, যেন স্কুলের পড়াশোনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এমন অন্যায় তাকে চুপ করে যেতে শেখায় না—বরং তার ভিতরে জেগে ওঠে এক রকম ক্ষোভ, আত্মসম্মানের দাবি।
তবে সত্যিকারের দোলাচল শুরু হয় বাড়ির ভিতরে। বড়দিনের প্রথমবার সে বসে বড়দের সঙ্গে ডিনার টেবিলে—আর সেই উৎসবপর্ব মুহূর্তেই বিষাক্ত হয়ে ওঠে এক তীব্র রাজনৈতিক বাকবিতণ্ডায়। তার পিতা, সাইমন ডেডালাস, রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে সরব—কারণ তারা আয়ারল্যান্ডের জাতীয় বীর পারনেলকে ধর্মের নামে ধ্বংস করেছে। অন্যদিকে, দান্তে রিওর্ডান—যিনি স্টিফেনদের আয়া, কিন্তু একইসঙ্গে কঠোর নৈতিকতার প্রতিনিধি—তর্ক করেন যে গির্জার দায়িত্বই হলো জনগণকে নৈতিক পথনির্দেশ দেওয়া।
এই একটি টেবিল, এই একটি তর্ক, যেন সমগ্র আইরিশ জাতি, ধর্ম, ও রাজনীতির টানাপোড়েনকে তুলে আনে—আর স্টিফেন, তখনও কিশোর, সে কেবল শুনে, দেখেই যায়—কীভাবে ভাষা, শ্রদ্ধা, রক্তের সম্পর্কও তিক্ত হয়ে ওঠে যখন আদর্শ একে অপরের বিপরীতে দাঁড়ায়।
স্টিফেনের বয়স বাড়ে, আর তার চোখে জীবনের আসল চেহারা স্পষ্ট হতে থাকে। এই পর্বে তার পিতা, একসময় সমাজে যাঁর সামান্য খ্যাতি ও গর্ব ছিল, তিনি ধীরে ধীরে পতিত হন অর্থনৈতিক ও সামাজিক দেউলিয়ায়। এই পতন স্টিফেনকে ঠেলে দেয় এক অসম্ভব দায়িত্বের মুখোমুখি—তার ছোট ভাইবোনদের ভার কাঁধে নিতে চায় সে, একাডেমিক পুরস্কারের টাকায় সংসার চালাতে চায়। কিন্তু খুব শিগগিরই বোঝা যায়, এই উদ্যোগ সফল হবে না—বালকের হাতের মুঠোয় সংসার বড় বেশি ফসকে যায়।
বন্ধুদের মাঝেও সে যেন বহিরাগত—তার স্বভাবিক দূরত্ব, সাহিত্যিক চিন্তা, আর আত্মদর্শনের খোঁজ তাকে আলাদা করে রাখে। এক পর্যায়ে সে বাবার সঙ্গে কর্ক শহরে যায়—সাইমনের জন্মভূমি, যেখানে তারা পারিবারিক সম্পত্তি বিক্রি করতে এসেছে। এই সফরে স্টিফেন পিতার ভঙ্গুরতা, অতীত-নির্ভর স্মৃতিমুগ্ধতা এবং নিজের ভেতরের বিচ্ছিন্নতাকে স্পষ্টভাবে অনুভব করে।
স্কুলের এক ধর্মীয় রিট্রিটে স্টিফেন শুনে একটি জাহান্নামের উপরে উপদেশ—যেখানে পাপ, ব্যথা ও অনন্তকালীন শাস্তির ছবি এমনভাবে আঁকা হয় যে, সদ্য কৈশোর পেরোনো স্টিফেন বিবর্ণ হয়ে ওঠে অপরাধবোধে। কেননা, তারই কিছুদিন আগে, মাত্র পনেরো বছর বয়সে, সে প্রথমবারের মতো একটি যৌনপল্লিতে গিয়েছিল। এই অনুতপ্ত সময়ে সে খুঁজে পায় ঈশ্বরের দিকে ফিরে যাওয়ার রাস্তা—তার একনিষ্ঠ ধর্মীয় জীবন শুরু হয়, এমনকি পুরোহিত হওয়ার ভাবনাও তাকে গ্রাস করে।
তবু শেষ পর্যন্ত সে এক ভিন্ন পথ বেছে নেয়। সে বুঝতে পারে, ধর্ম বা জাতীয়তাবোধ, বন্ধুতা বা পরিবার—কোনো কিছুই তার শিল্পীসত্তাকে ধারণ করতে পারে না। সে বেছে নেয় মুক্তির পথ, আত্মপ্রকাশের পথ। পুরোহিতের নির্দিষ্ট পোশাক নয়, সে গ্রহণ করে শিল্পীর অনির্ধারিত নির্জনতা।
বিশ বছর বয়সে, সে নিজেকে নির্বাসনে পাঠায়—ডাবলিন থেকে প্যারিসের পথে যাত্রা করে, ঘোষণা করে সেই বিখ্যাত বাক্য যা তার আত্মজীবনীর চূড়ান্ত উচ্চারণ:
"to forge in the smithy of [his] soul the uncreated conscience of [his] race." (“নিজ আত্মার কামারশালায় গড়ে তুলতে হবে জাতির অদৃষ্ট বিবেক।”)
এটি কেবল একটি স্বপ্ন নয়, এটি আত্মার এক দীর্ঘ কামারশালায় তৈরির প্রতিজ্ঞা—যেখানে একজন মানুষ নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়ার জন্য সবকিছু ছেড়ে দেয়।
ইউলিসিস মূল আলোচনা
ইউলিসিস নামটি লাতিন—হোমারের মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র Odysseus-এর রূপান্তর। তবে সাদৃশ্য শুধু নামেই সীমাবদ্ধ নয়। উপন্যাসের দুই মুখ্য চরিত্র—লিওপোল্ড ব্লুম ও স্টিফেন ডেডালাস—মূলত The Odyssey-এর দুই চরিত্রের আধুনিক ছায়া। ব্লুম যেন এক নাগরিক ওডিসিয়ুস, আর স্টিফেন তার পুত্র টেলিম্যাকাসের অনুরণন। উপন্যাসটি তিন ভাগে বিভক্ত, একেকটি অধ্যায় হোমারের মহাকাব্যের নির্দিষ্ট পর্বের ছায়ায় গঠিত। জয়েস প্রতিটি অধ্যায়ে এমনভাবে গেঁথেছেন প্রতীক, কাহিনির গঠন ও ভঙ্গিমা—যাতে প্রাচীন পুরাণ ও আধুনিক জীবনের মধ্যকার অদ্ভুত সেতুবন্ধটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
উদাহরণস্বরূপ, উভয় গ্রন্থেই আমরা দেখি প্রধান চরিত্রেরা পাতালভূমিতে অবতরণ করে, মোহিনী নারীদের মুখোমুখি হয়, প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়, গুরুদের সান্নিধ্যে আসে এবং সমুদ্রযাত্রার ভেতর দিয়ে পরীক্ষিত হয়। কিন্তু এসব সাদৃশ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে তীব্র বৈপরীত্য। The Odyssey হল ট্রয় যুদ্ধ-পরবর্তী দীর্ঘ এক দশকের যাত্রাকাহিনি—আর ইউলিসিস? সে কেবল একটি দিন, ১৯০৪ সালের ডাবলিনের এক স্বাভাবিক, শ্লথ, ধূসর দিন। এই আধুনিক মহাকাব্য গড়ে উঠেছে নগরায়নের ক্লান্তি, ঔপনিবেশিক টানাপোড়েন, আর মনস্তাত্ত্বিক উদ্বেগের ভিতরে দাঁড়িয়ে। ওডিসিয়ুস যেখানে এক মহাকাব্যিক যোদ্ধা, ব্লুম সেখানে সাধারণ মানুষের প্রতিভূ—বিনয়ী, বিষণ্ন, প্রায় অদৃশ্য। হোমারের অলৌকিক দেবতা ও পৌরাণিক জাদুবাস্তবতা এখানে অনুপস্থিত; বরং প্রতিটি ঘটনা নেমে এসেছে মানবিক দুর্বলতা ও শহুরে যন্ত্রনার বাস্তবতায়।
জয়েস এখানে বেছে নিয়েছেন পৌরাণিক মহিমার পরিবর্তে এক নির্মম বাস্তবতা। যেখানে গ্রিক মহাকাব্য গৌরব, সম্মান ও বীরসৌন্দর্যের উদযাপন, সেখানে ইউলিসিস—একান্তই মানবিক, প্রায় নিষ্ঠুরভাবে সৎ। ওডিসিয়ুস স্মরণীয় বুদ্ধি, ধৈর্য আর অভিযানের জন্য; কিন্তু ব্লুমের যাত্রা ঘিরে আছে দৈনন্দিন ক্লান্তি, সামাজিক ট্যাবু, আর মনোজাগতিক কুয়াশা। সবচেয়ে বড় পার্থক্য, The Odyssey-তে আছে একরৈখিক, পরিচিত কাহিনিবিন্যাস। ইউলিসিস তার বিপরীতে—চরিত্র ও সময়ের মধ্য দিয়ে চলমান এক ছিন্নভিন্ন বহুধারা, যেখানে প্রতিটি টুকরো স্মৃতি, চিন্তা ও অনুভূতির স্তরে স্তরে তৈরি হয় এক জটিল পাঠাভিজ্ঞতা।
মূলত, জয়েস যা করছেন, তা-ই আধুনিকতাবাদী সাহিত্যের পথরেখা। হোমারের মহাকাব্যিক কাঠামো ও পর্বগুলোকে তিনি গ্রহণ করেন ঠিকই, কিন্তু সেগুলিকে উল্টে দেন—নায়কের জায়গায় আনেন এক অ্যান্টি-হিরো, পৌরাণিক কাহিনির জায়গায় রাখেন সাধারণ জীবনের ক্লান্ত বাস্তবতা। এভাবেই এক মহাকাব্য হয়ে ওঠে আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতা, উদ্বেগ ও অস্তিত্বসংকটের এক পরীক্ষাগার। আর এই রূপান্তর সম্ভব হয় তার ভাষাশৈলীর বিপ্লবী রূপান্তরের মাধ্যমে—চেতনাপ্রবাহ, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সহাবস্থান, আর ভাষার গঠনে নিরন্তর নতুনত্বই গড়ে তোলে এই অনন্য সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা।
এই উপন্যাস প্রচলিত কাহিনিকাঠামোকে ভেঙে দিয়ে তুলে ধরে আধুনিক জীবনের জটিল অভিজ্ঞতা—যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত অর্থহীনও হতে পারে, আবার অভাবনীয় অর্থে পূর্ণও। এই কারণেই ইউলিসিস পড়া এক দুঃসাধ্য সাধনা, আবার এই কারণেই এটি এত অনন্য—যেন এক সাহসী রচনার গঠনশৈলী, যা সাহিত্যকে টেনে আনে আধুনিক যুগের দোরগোড়ায়। এবার আমরা আরও গভীরভাবে দেখব উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ এবং জয়েস কীভাবে নানান সাহিত্যরীতিকে ব্যবহার করেছেন—যাতে আধুনিক মানুষের উদ্বেগ, বিচ্ছিন্নতা ও প্রশ্নমালার ভেতর থেকে নির্যাস তুলে আনা যায়।
ইউলিসিস-এ আমরা প্রচলিত অর্থে ‘কাহিনি’ বা ‘প্লট’ খুঁজে পাই না। বরং, কিছু চরিত্রের দৈনন্দিন গতিবিধির মধ্যে দিয়ে আমাদের সামনে খুলে যায় এক উদ্বেগে ভরা, স্নায়ুচাপগ্রস্ত শহুরে জীবনের প্রতিচ্ছবি। তবু উপন্যাসটি বিন্যাসহীন নয়—এর আছে এক নির্দিষ্ট গঠন: আঠারোটি অধ্যায়, তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম তিনটি অধ্যায়ে আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করি তিনটি ভিন্ন চরিত্রের মনোজগতে—তাদের অভ্যন্তরের শব্দ, নিরবতা ও সংশয় ধরা দেয় পাঠকের সামনে।
প্রথম অধ্যায়ের নাম Telemachus, দ্বিতীয়টি Nestor, আর তৃতীয়টি Proteus—তিনটি নামেই হোমারের The Odyssey-এর ছায়া। এই অংশে আমরা পরিচিত হই স্টিফেন ডেডালাসের সঙ্গে—এক তরুণ শিল্পী ও শিক্ষক, যার অন্তর্জগৎ জর্জরিত পরিচয়-অন্বেষা, ইতিহাসের ভার, পারিবারিক টানাপোড়েন ও বিশ্বাস হারানোর ক্লান্তিতে। সে ভাবে, একটি মানুষ কি সত্যিই মুক্ত হতে পারে? জাতি, পরিবার, ধর্ম—এই তিন বেষ্টনী ছিন্ন করে কি একজন শিল্পী স্বাধীনভাবে নিজেকে নির্মাণ করতে পারে? উপন্যাসের শুরুতেই, এই প্রশ্নগুলোর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে জয়েসের বহুস্তরবিশিষ্ট অভিপ্রায়।
যদিও উপন্যাসটি মূলত স্টিফেন ডেডালাসকে অনুসরণ করে এবং তার জটিল চেতনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে তার মানসিক অবস্থা উন্মোচন করে, তবুও আশপাশের চরিত্রদের অন্তর্দৃষ্টিও মাঝেমধ্যে জেগে ওঠে—দেখিয়ে দেয়, একেকজন মানুষ একেকটি ঘটনার ব্যাখ্যা করে একেবারে আলাদা ভাবে। সময়, উপলব্ধি ও বাস্তবতার প্রবাহমানতা এখানে একসঙ্গে মিশে যায়। উপন্যাসের শুরুতে লিওপোল্ড ব্লুম চরিত্রটি সরাসরি না এলেও, ঠিক যেমন ওডিসিয়ুস The Odyssey-এর শুরুতে অনুপস্থিত, তেমনি এখানে তিনিও ধীরে ধীরে আবির্ভূত হন মধ্যভাগের কাহিনির কেন্দ্রে। পেশায় বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যুক্ত ব্লুম হলেন এক আধুনিক নাগরিক—নিরীহ, আত্মসমালোচনামূলক, আর যেন আমাদের চেনা দৈনন্দিন মানুষের প্রতিরূপ। কিন্তু তাঁর পরিচয়ে আছে দ্বন্দ্ব—তিনি একদিকে আইরিশ, অন্যদিকে ইহুদি-হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত। এই দ্বৈত পরিচয় তাকে টেনে আনে জাতীয়তাবাদ, ধর্ম এবং আত্মপরিচয়ের জটিল প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি।
উপন্যাসের দ্বিতীয় ভাগ—অর্থাৎ চতুর্থ থেকে পঞ্চদশ পর্ব—জুড়ে আমরা দেখি কীভাবে লিওপোল্ড ও স্টিফেনের পথ পরস্পরের পাশে পাশে চলে, কখনো ছেদ করে যায়, আবার কখনো দূরে সরে যায়। এই অংশে লিওপোল্ড ব্লুম হয়ে ওঠেন কেন্দ্রবিন্দু, আর গল্পের ভেতর বোনা হয় বিচ্ছিন্নতা, সংযোগের ক্ষীণ সম্ভাবনা, এবং জীবনের নিষ্প্রভ মুহূর্তগুলোর গূঢ় গুরুত্ব। আমরা প্রবেশ করি ব্লুমের গৃহজীবনে—তার স্ত্রী মলির সঙ্গে জড়িত টানাপোড়েনে, যে সম্পর্কে সে জানে মলি তাকে প্রতারণা করছে। এরপর ব্লুম যোগ দেন এক মদ্যপ বন্ধুর অন্ত্যেষ্টিতে, যেখানে তার মনে ভেসে ওঠে মৃত্যু, অনিত্যতা ও মৃত্যুর পরবর্তী সম্ভাবনা নিয়ে নানা ভাবনা। এখানে শোক ও ক্ষতির অনুভব এতটাই প্রগাঢ় যে, পাঠকও যেন ওই অনুপস্থিতির ভার টের পায়, শব্দের গায়ে গায়ে।
এরপর ঘটনাপ্রবাহ সরে আসে এক সংবাদপত্র অফিসে, যেখানে লিওপোল্ড ও স্টিফেন আলোচনায় জড়ান সাংবাদিকতা, তথ্যপ্রবাহের বিকৃতি এবং জনমতের নির্মাণ নিয়ে। পাঠকের সামনে উঠে আসে কীভাবে সত্যকে রূপান্তর করা যায়, এবং কীভাবে ভাষা নিয়ন্ত্রণ করে দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যদিকে, গ্রন্থাগারে স্টিফেন নিমগ্ন হন শেক্সপিয়ার নিয়ে—শিল্প, সৃজনশীলতা, এবং লেখকের অস্তিত্বসংক্রান্ত দার্শনিক ভাবনায়। এদিকে ব্লুম পা রাখেন বেল্লা কোহেনের যৌনপল্লীতে—পথে পথে নানা চরিত্রের মুখোমুখি হন তিনি। এই পর্বগুলোর বর্ণনায় ধ্বনি ও সুর হয়ে ওঠে ন্যারেটিভের চালিকাশক্তি—এক ধরনের সংগীতময় প্রবাহ, যেখানে শব্দের মোহ থাকে, এবং শ্রুতির মাধুর্যে লুকিয়ে থাকে কামনা। এখান থেকেই উপন্যাস প্রবেশ করে তার দুই কুখ্যাত অধ্যায়ে—পর্ব ১২ ‘Cyclops’ ও পর্ব ১৩ ‘Nausicaa’। Cyclops ঘটে এক স্থানীয় পানশালায়—সেখানে ইহুদি পরিচয়ের কারণে ব্লুম হয়ে ওঠেন জাতীয়তাবাদ, ঘৃণা, এবং সংকীর্ণতা-প্রসূত আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। এই পর্ব যেন জয়েসের পক্ষ থেকে এক সতর্ক সংকেত, কেমন করে বর্ণবাদ ও কূপমণ্ডুকতা মানবিকতার বুকে বিষ ঢেলে দেয়।
এই পর্ব—Cyclops—একদিকে যেমন কঠোর মতাদর্শের ব্যঙ্গচিত্র, অন্যদিকে তা অন্ধ পক্ষপাতের বিপজ্জনক প্রভাবের এক চিত্রপট। পরবর্তী অধ্যায়—Nausicaa-তে ব্লুম চলে যান সমুদ্রতীরে। সেখানেই ঘটে এক অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত—দূরে বসে থাকা গার্টি ম্যাকডাওয়েল নিজের শরীর আংশিকভাবে উন্মুক্ত করেন, আর ব্লুম অনিচ্ছাকৃতভাবে এক ভয়ারিস্টে পরিণত হন; তারপর, এক নিঃসঙ্গ দৃষ্টিকোণে, সে শুরু করে হস্তমৈথুন। এই অধ্যায়ে আমরা পাশাপাশি দেখি গার্টি ও ব্লুমের ভিন্ন চিন্তাধারা—যেখানে মিশে আছে কামনা, নিষ্পাপতা, নারীত্ব, বিবাহ এবং মানব যৌনতার বহুমাত্রিকতা। উপন্যাসটি যখন যুক্তরাষ্ট্রে অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়েছিল, এই অংশটিই ছিল সেই বিচারপ্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু—যা পরবর্তীতে অব্যাহতির মাধ্যমে শিল্পের স্বাধীনতাকে এক নতুন মাত্রা দেয়। পরবর্তী পর্বে, ব্লুম ও স্টিফেন আবার মিলিত হন—এক প্রসূতি হাসপাতালে, যেখানে তাঁদের পরিচিত মিনা পিয়ারফয় প্রসবের দ্বারপ্রান্তে।
এই পর্বটি—মাতৃত্বকেন্দ্রিক হাসপাতালের প্রেক্ষাপটে—সবচেয়ে পরীক্ষামূলক অংশগুলোর একটি। জন্ম, বিবর্তন, আর জীবনের বিভিন্ন স্তর এখানে ভাষার ভেতরেই প্রতিফলিত—জয়েস শুরু করেন বাইবেলের অনুকরণে, ধীরে ধীরে পৌঁছান ভিক্টোরীয় যুগের অলঙ্কারময় গদ্যে। ভাষা যেন এখানে নিজেই এক বিবর্তনশীল সত্তা। এরপর আসে পঞ্চদশ পর্ব—রাতের ডাবলিন তখন এক অদ্ভুত স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের রূপে পরিণত। ঘটনাপ্রবাহ হয়ে ওঠে আরও বিভ্রান্তিকর, ভৌতিক, প্রায় হ্যালুসিনেশন-সদৃশ। শহরের পতিতাপল্লীর মধ্য দিয়ে ঘুরে বেড়ায় চরিত্রেরা, আর ফিরে আসে সেই পুরনো পরিচিত জায়গা—বেল্লা কোহেনের ব্রথেল। এখানেই ইংরেজ সৈনিকের ঘুষিতে আহত হন স্টিফেন ডেডালাস। এই বিশৃঙ্খল, প্রায় থিয়েট্রিকাল অধ্যায়ের মধ্য দিয়েই শেষ হয় উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ—যেন গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যাওয়া এক মধ্যরাত্রির শহর ও মন।
তৃতীয় ও শেষ অংশ—Nostos—নামে যেমন বোঝায়, এ এক ‘ফেরা’র অধ্যায়। পতিতালয়ে পুলিশের হানা শেষে, লিওপোল্ড ও স্টিফেন আশ্রয় নেন এক সেতুর পাশে ট্যাক্সিচালকদের বিশ্রামঘরে। এই মুহূর্তে উপন্যাসে ভেসে ওঠে সহমর্মিতা, দানশীলতা, আর পারস্পরিক মানবিকতার এক গোপন আলো—দুই ভিন্ন পটভূমির মানুষ হঠাৎই যেন এক ছায়ায় আশ্রয় খোঁজে। এর পরের পর্ব Ithaca—হোমারের শেষ গন্তব্য। এখানেও রচনাশৈলী বদলে যায়। এবার বর্ণনা আসে প্রশ্নোত্তরের কাঠামোয়—শুষ্ক, বৈজ্ঞানিক ধাঁচে, যেন সমস্ত আবেগকে ঠান্ডা আলোয় পরখ করার এক প্রচেষ্টা, অথচ তাতেই ফুটে ওঠে গভীর মানবতা।
লিওপোল্ড ও স্টিফেন শেষপর্যন্ত জড়ান এক নিয়ন্ত্রিত আলাপচারিতায়—যেখানে যুক্তি, কাঠামো ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তারা দিনভর ঘটে যাওয়া বিশৃঙ্খলার মানে খুঁজে নিতে চায়। যেন চেতনার অবিন্যস্ত প্রবাহের বিপরীতে তারা দাঁড় করাতে চায় এক শৃঙ্খলিত দৃষ্টিভঙ্গি। আর তারপর, উপন্যাস পৌঁছায় তার আঠারোতম ও শেষ অধ্যায়ে—লিওপোল্ড ব্লুম ফিরে যান তার ঘরে, তার স্ত্রী মলির কাছে। তিনি জানেন মলির পরকীয়া সম্পর্কে, তবু এই ফিরে আসায় লুকিয়ে থাকে অন্য এক স্তর—কারণ আমরা জানি, এই দম্পতির অতীতেও আছে এক নিঃশব্দ ক্ষতি, এক হারিয়ে যাওয়া শিশুর স্মৃতি, যা তাদের সম্পর্কের গভীরে গেঁথে আছে।
এই পর্বে আলো পড়ে মলি ব্লুমের ওপর। এতক্ষণ লিওপোল্ডের চেতনাজগত ঘুরে দেখার পর, এবার পাঠক প্রবেশ করে মলির ভাবনার গভীরে—এক অপ্রবাহিত স্বগতোক্তির ধারায়। শব্দ আর বিরামচিহ্নের কাঠামো ভেঙে গিয়ে এখানে উঠে আসে স্মৃতি, কামনা, প্রেম, ক্লান্তি আর জীবনের ছায়া-রৌদ্র। উপন্যাস শেষ হয় এক গভীর, ব্যক্তিগত স্বরের মধ্যে দিয়ে—যেখানে নারীত্ব ও মানবিকতা একাকার হয়ে যায়। জয়েস যেন এখানেই পাঠককে ছেড়ে দেন—জীবনের মধ্যেই, শব্দের মধ্যেই, এক দীর্ঘ ‘হ্যাঁ’-এর প্রতিধ্বনিতে।
শেষ করার আগে একটি কথা বলা প্রয়োজন—ইউলিসিস কেবল একটি উপন্যাস নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক ভূমিকম্প, যার প্রতিধ্বনি আজও সাহিত্যে, শিল্পে ও জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে অনুরণিত। একাডেমিয়ায় এর থিম, প্রতীক ও ভাষাশৈলী আজও ব্যুৎপত্তির আলোচনায়, বিতর্কে, পুনর্বীক্ষণে জায়গা করে নিচ্ছে। এই কারণেই এর তাৎপর্য এখনো জীবন্ত। আর শুরুটা করতে হলে, আমাদের চোখ ফেরাতে হবে যেদিকে প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে—সাহিত্যজগতে। ইউলিসিস যেন একটি দরজা খুলে দিয়েছিল, যেখানে ভাষা, চেতনা ও বাস্তবতার অভিজ্ঞতা একযোগে ভাঙচুর করে তৈরি করা যায় এক নতুন সাহিত্যিক বাস্তবতা।
এই বই শুধু আধুনিকতাবাদের নয়, উত্তর-আধুনিকতাবাদেরও এক প্রাথমিক ভিত্তি। জয়েস তাঁর ভাষার ব্যবহার, চেতনাপ্রবাহভিত্তিক বর্ণনা, আর গদ্যের গঠনে যে বৈপ্লবিক পরীক্ষা চালান, তা পুরনো কাহিনিকাঠামোর নিয়ম ভেঙে দেয়। আর সেই ভাঙনের মধ্যেই জন্ম নেয় সাহিত্যের নতুন সম্ভাবনা। কল্পনার পরিসর কীভাবে বাড়ানো যায়—ইউলিসিস তারই এক নির্ভীক উত্তর। জয়েসের এই পদ্ধতি তৎকালীন সমসাময়িকদের—যেমন ভার্জিনিয়া উলফ, স্যামুয়েল বেকেট—প্রভাবিত করে। আর অনেক পরে, টমাস পিঞ্চন বা ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের লেখায় আমরা পাই সেই একই নিরীক্ষার ছায়া। ভাষার সীমা ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি, জয়েস ডাবলিনকে যেভাবে অঙ্কন করেন—তাতে স্থান বা শহর কেবল পটভূমি নয়, বরং চরিত্র হয়ে ওঠে। এই শহরচিত্রন নির্মাণ সাহিত্যে এনে দেয় স্থানভিত্তিক অনুভবের এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।
ইউলিসিস পরিণত হয়েছে এক ছাঁচে—যার মধ্যে দিয়ে সাহিত্যিকেরা নগরজীবনের সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক জটিলতাকে আবিষ্কার করেছেন নতুনভাবে। কেবল লেখকেরাই নন, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও ভিজ্যুয়াল শিল্পীরাও জয়েসের ধারা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। চেতনাপ্রবাহ, অরৈখিক গঠন, এবং চরিত্রের অন্তর্জগতে প্রবেশ—এই কৌশলগুলো আধুনিক চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের ন্যারেটিভ গঠনেও প্রভাব ফেলেছে। এমনকি আজও ইউলিসিস-এর উল্লেখ পাওয়া যায় The Simpsons থেকে The Sopranos পর্যন্ত—জনপ্রিয় সংস্কৃতির নানা বাঁকে। প্রখ্যাত সুরকার রিচার্ড স্ট্রাউস পর্যন্ত এই উপন্যাসকে অবলম্বন করে রচনা করেন একই নামে একটি অপেরা। আর আয়ারল্যান্ডে এই ঐতিহ্য জীবন্ত—প্রতি বছর ১৬ জুন, উপন্যাসের ঘটনাদিবস, পালিত হয় Bloomsday হিসেবে—যেন একটি শহর তার সাহিত্যিক ছায়ায় ফিরে তাকায়, নিজের ইতিহাসে।
বিশ্বজুড়ে নানা শহরে প্রতি বছর ইউলিসিস-কে ঘিরে আয়োজিত হয় পাঠসভা, মঞ্চনির্দেশ, আর নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তবে ডাবলিনে এর ধ্বনি সবচেয়ে গভীর—কারণ উপন্যাসে উল্লিখিত মার্টেলো টাওয়ার, স্যান্ডিমাউন্ট স্ট্র্যান্ডের মতো স্থানগুলো আজ পরিণত হয়েছে সাহিত্যের পবিত্র তীর্থস্থানে—যেখানে পাঠকেরা খোঁজেন লিওপোল্ড ব্লুমের পদচিহ্ন। কিন্তু এই উপন্যাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারগুলোর একটি হলো সেন্সরশিপবিরোধী সংগ্রামে এর ভূমিকা। ১৯২২ সালে প্রকাশের পর এর খোলামেলা বিষয়বস্তুর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বইটি নিষিদ্ধ হয়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ১৯৩৩ সালের শেষ দিকে নিউ ইয়র্কে এক ঐতিহাসিক মামলায় ফেডারেল বিচারক রায় দেন যে ইউলিসিস কোনো অশ্লীল রচনা নয়, বরং এটি এক গুরুত্বসম্পন্ন শিল্পকর্ম—যা নিষিদ্ধ করার প্রশ্নই ওঠে না। এই রায় সাহিত্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে এক মাইলফলক হয়ে রয়ে গেছে।
এই মামলার পরিণতিতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্তবয়স্ক বিষয়বস্তু ও যৌনতা নিয়ে রচিত আরও অনেক সাহিত্যকর্ম প্রকাশের সুযোগ পায়—যা মুক্ত চিন্তার পরিসরকে অনেক বিস্তৃত করে। এ কারণেই নয়, আরও অনেক গভীরতর কারণে, ইউলিসিস আজও এক রূপান্তরকারী সাহিত্যকীর্তি—যা সাহিত্যের সীমানা ছাড়িয়ে ছুঁয়ে গেছে শিল্পের নানামুখী অভিব্যক্তি ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানকে। এটি কেবল একটি উপন্যাস নয়, বরং এক শিল্পবিপ্লবের নাম—যা জেমস জয়েসের সৃষ্টিশীল প্রতিভার সাক্ষ্য এবং কাহিনির বিবর্তন ও অভিব্যক্তির নবতর পথে আমাদের গাইড।
ইউলিসিস সাহিত্যে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল—এর বহুরৈখিক ভাষাশৈলী আর নানামাত্রিক ন্যারেটিভ নির্মাণের মাধ্যমে। মাত্র একদিনের—লিওপোল্ড ব্লুম ও স্টিফেন ডেডালাসের জীবনের—ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরতে গিয়ে, জয়েস নির্মাণ করেন শিল্প-অভিব্যক্তির এক সম্পূর্ণ নতুন রূপ। চেতনাপ্রবাহের সেই প্রবল ধারা, যেখানে সমাজের নানা স্তরের মানুষের মনোজগৎ একে একে উন্মোচিত হয়, উপন্যাসটিকে করে তোলে একইসাথে দুঃসাধ্য এবং আশ্চর্যজনকভাবে পুরস্কৃতিস্বরূপ। শুধু গল্প বলার নতুন পথই খুলে যায়নি, বরং প্রাপ্তবয়স্ক বিষয়ে সাহিত্যের প্রকাশনাও যুক্তরাষ্ট্রে সম্ভব হয়েছে এই সাহসী রচনার পথ ধরেই।