আমার জীবনদর্শন কী?
কিছুদিন আগে একজন মেসেজ করে জিজ্ঞেস করেছিল—“তোমার জীবনদর্শন কী?” আমি লিখেছি, ‘বেঁচে থাকা’। এই কথা সোজাসাপ্টা, প্রায় লজ্জার মতো। কিন্তু সত্যটা হল—এই দুই শব্দের ভেতরই আমার নীতি লুকিয়ে আছে।
সাবস্ট্যাক (riton.us) আমার ল্যাবরেটরি আর আমার উন্মুক্ত নোটবুক—নো-ফিল্টার, নো-শো, শুধু মুহূর্ত-ভালোবাসা। অফিসের ব্রেক, মিটিং-এর বোরিং বানান, বা ট্রাফিক লাইটে দাঁড়িয়ে থাকা—এইসব ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ফাঁকেই আমার বাক্য জন্মায়; তাদের মধ্যে নেই কোনো ‘জীবনদর্শন’-এর ভাণ্ডার। যে লেখাগুলো পড়লে তুমি জানবে আমি কোথায় দাঁড়িয়েছি। না, সেটাই আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার গোপন উদ্দেশ্য একটু সোজা: মানুষকে আবার পড়ায় অভ্যস্ত করা। পাঠকরা যদি এক কাপ কফির আঠালো গন্ধে, কিংবা পথে যেতে যেতে আমার লেখায় আটকে যায়—তাহলে আমার দিনটা সফল।
কিছুদিন আগে একজন মেসেজ করে জিজ্ঞেস করেছিল—“তোমার জীবনদর্শন কী?” আমি লিখেছি, ‘বেঁচে থাকা’। এই কথা সোজাসাপ্টা, প্রায় লজ্জার মতো। কিন্তু সত্যটা হল—এই দুই শব্দের ভেতরই আমার নীতি লুকিয়ে আছে। বেঁচে থাকা মানে শুধু শারীরিক অস্তিত্ব নয়; মানে নিজেকে ধার্য করা, ভুল করা, ঘুমোতে পারা, ছোট ছোট আনন্দ নিতে পারা, আর মানুষের সঙ্গে সহমর্মিতা রাখা—এইসব মিশে গেলেই দাঁড়ায় একটা জীবন-চর্চা। আর তাই, আমার কথায় যদি কোনো উচ্চশিক্ষিত জীবনদর্শন খুঁজে না পাও, তা হলে তুমি ঠিক পড়েছ—এগুলো আমার নিজস্ব অনুভূতি; হ্যাঁ, কিন্তু অনুভূতিগুলোই আমার মধ্যে ধীরে ধীরে নীতিতে রূপ নেয়। আমার লেখাগুলোই আমার ধ্যান-ধ্যান; সাবস্ট্যাকের প্রতিটি নোট—একটা ধীরে ধীরে গঠিত অভ্যাস: পাঠককে ফিরিয়ে আনা, তাদের পড়ায় অভ্যস্ত করা, আর তারা যদি ফিরে আসে, তাহলে বুঝি বেঁচে আছি।
জীবনদর্শন—এ নামটা শুনলেই মনে হয় কোনো মোটা বইয়ের সূচনা-প্যারাগ্রাফ, অথচ বাস্তবে এটা সোজা-সরল ও অবিশ্বাস্যভাবে জটিল এক ব্যাপার। প্রত্যেক সচেতন মানুষেরই মাথায় এক পাকা খসড়া থাকে—এইভাবেই জীবন কাটাবো, এইগুলোই আমার নীতিমালা—কিন্তু দৈনন্দিন জ্বালায়, সুযোগে, আকস্মিক প্রলয়-প্লেব্যাকেই সেই আদর্শ ভাঙতে পারে।
সৎ ও অসৎ—এই শব্দদ্বয়ের ভেতরেই আমরা ভুল করে সবকিছু স্থির ধরে নিই। কিন্তু বাস্তবতা এত সরল নয়। সৎ মানুষ মাঝেমধ্যেই ভুল করে, ক্ষতি করে কিংবা স্বার্থসিদ্ধির অনুকরণে ভ্রষ্টে পড়ে; আর অসৎ বোধকে আমরা একরকম স্থির কালো বাক্সে বন্দি করলে ভুল হবে—অনেক সময়ই অসৎ মনে করা কেউই হঠাৎ করে অতি সহানুভূতিশীল কাজ করে, আর ভাল লোকও কখনো অচেতনভাবে ক্ষতি করে ফেলে। সুতরাং ‘কে আসলে সৎ, কে অসৎ’—এ প্রশ্নটা প্রায়শই প্রাসঙ্গিকতার বদলে ধারাবাহিকতায় পড়ে না।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, ক্ষুদ্র-স্বার্থকে আলোর সামনে আনা, আর অন্যদের কষ্ট হলে পাশে দাঁড়ানোর সামান্য সাহস। অনেকেই বলবে, তাই তো—কিন্তু মাত্রা এবং মনের সততা বজায় রাখাই কঠিন। আরেকটু এগোলে—জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রশ্ন আমার কাছে এটা: কীভাবে মনের শান্তি ও আনন্দ অর্জন করা যায়? শান্তি আসে যখন অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা কমে, যখন আমরা নিজের সঙ্গে ছলনা করতে ভুলে যাই, যখন অপরের কষ্টে আমাদের নীরবতা ভাঙে। শান্তি আসে আত্মপর্যবেক্ষণ, নিয়মিত সতর্কতা এবং দায়বদ্ধতার মধ্য দিয়েই—নিজেকে প্রশ্ন করা, নিজের ভুল মেনে নেওয়া, এবং অপরকে ক্ষমা করার ক্ষমতা।
তবু কেন কিছু মানুষ শান্তি পায় আর অনেকেই অস্থির থাকে? কারণ শান্তি কেবল ইতস্তত কোনো ভালো মুহূর্ত নয়; এটা এক ধরনের সততার ফল। সততা মানে সরলতা নয়—এটা মনকে প্রশস্ত করে, অপরের সঙ্গে সম্পর্ককে স্থিতিশীল করে, এবং ক্রমে এমন একটা অভ্যাস গড়ে তোলে যে বাইরের উচ্ছৃঙ্খল আনন্দ-ভোগে যাকে শান্তি বলে আমরা বিভ্রান্ত হই, সেটি আর টেকসই হয় না। শান্তি অর্জনের পথেও কিছু ব্যবহারিক ধাপ আছে—দৈনন্দিন অনুশীলন (স্মৃতি-চর্চা, ধ্যান বা প্রাত্যহিক আত্মসমালোচনা), ন্যায্য পরিশ্রম, এবং সম্পর্কের মধ্যে স্বচ্ছতা—এসবই বড় ভূমিকা রাখে।
আমার সহজ জীবনদর্শনটা বড় হলেও এর মর্ম জটিল: শান্তি ও অর্থ খোঁজো, সেটা কেবল আনন্দ-অন্বেষণে মেলে না, বরং ধারাবাহিক নৈতিক জীবনচর্চায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে—শান্তি হচ্ছে ঘর-বাড়ির কর্কশ গোলমালকে সরিয়ে নিজের সঙ্গে একটা চুপচাপ কথা বলা, এবং সেই কথার উত্তরেই আমাদের জীবনের সর্বোত্তম সুর নিহিত।
#notabene