পিঞ্জরে বসিয়া শুককথা—কমলকুমার মজুমদারকে পড়া মানেই নিজেকে প্রশ্নের পাঁকে ডুবিয়ে দেওয়া, আর সেই পাঁক থেকে খালি গায়ে উঠে আসার অভিনয়।
কমলকুমার তো লেখকের লেখক নন, পাঠকের পাঠকও নন—তিনি সাহিত্যের নির্মম সাধক। তাঁর উপন্যাস মানে আগুনে ঝাঁপ।
কমলকুমার মজুমদার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কেউ যদি ভাবেন, তিনি কেবল “জটিল বাক্যের রামগরুড়” কিংবা “ভাষার অ্যাসিড হাউজ ডান্সার”—তাহলে ভাবুন, কারণ আপনি এখনও কেবল গুগলের চতুর্থ পাতায় রয়েছেন। তিনি সাহিত্য রচনার সময় যে রকম বাক্য রচনা করতেন, তাতে দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য বোঝা দায়। পিঞ্জরে বসিয়া শুককথা পড়া মানে শুধুই একখানা উপন্যাস পড়া নয়; একখানা ঘূর্ণায়মান ভাষা-মহাসাগরের মধ্যে সাঁতার শেখা, যেখানে প্রতিটা তরঙ্গ-ফেনা ফেটে উঠে বলে— “তুই তো বেসিক ডিকশনারি নিয়েই বসিসনি!”
আমি এখন একজন পাঠক। না না, রিডারস ডাইজেস্ট কিংবা ফ্রি বুক ফেয়ার থেকে পাওয়া “প্রেম ও প্রেতাত্মার পুনর্মিলন” জাতীয় পাঠক না। আমি এমন পাঠক, যার পাঠগ্রহণে আর পাঠচ্যুতিতে কোনও গণ্ডগোল নেই। বহুদিন ধরে বই পড়ে যাচ্ছি—কোনও সাপ্তাহিক চুল-ছাঁটার মতো সাময়িক অ্যাডভেঞ্চার নয়। এ এক দীর্ঘমেয়াদি বিবাহবন্ধনের মতো—প্রথম দিকে রোমাঞ্চ, পরে দায়িত্ব, তারপর সহ্য করা, তারপর আবার খুঁজে পাওয়া।
বই বড় হোক বা গভীর, ভয় পাই না এখন আর। হ্যাঁ, “বুক” মানে বুকের উপর বই রেখে ঘুমিয়ে পড়া নয়, বরং সেই বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় নিজেকে খুঁজে ফেরার চেষ্টা। বন্ধুরা বলে, ‘তুই শুধু বই পড়িস, মজা পাস কোথায়?’—ওরা বোঝে না, আমি মজা খুঁজি না, আমি জীবন খুঁজি।
আর এইখানেই আমার সঙ্গে ভরদুপুরের রোদের ফারাক—রোদ ছায়া খুঁজে বেড়ায়, আমি অর্থ খুঁজে বেড়াই। আর এই খোঁজ কোনো হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ডে পাওয়া যায় না। এটা দীর্ঘ অনুশীলনের ফল, যার মধ্যে আছে ঘুমের সময় বইয়ের পাতায় গাল ফেলে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস, আছে সেই রাতে ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিট্যুড’ পড়তে গিয়ে মাথা ঘুরে চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়া, আর আছে সেই সময়টুকু, যখন পাশের বাড়িতে বিয়ে হচ্ছিল, আর আমি তখন Dostoevsky’র সঙ্গে আত্মহত্যা নিয়ে বিতর্কে মত্ত ছিলাম।
কেউ কেউ বলে—‘তুই এত পড়িস কেন?’ আমি বলি, ‘কারণ এটা ছাড়া আর কিছু জানি না।’ মানে বেঁচে থাকার এই একটা কারণ জানি—এটা ছাড়া আত্মজৈবনিক কোনও ‘প্যাশন’, ‘ভিশন’, ‘লাইফ গোল’ বলে কিছু নেই।
আমি পড়ি যাতে এই একটা জীবন দিয়ে অনেকগুলো জীবন বাঁচা যায়। কারণ, শ্রীযুক্ত অ্যালবার্ট কাকু… না, না, অ্যালবার্ট ক্যামু, বলেছিলেন—“জীবন একটা অর্থহীনতা, আর সাহিত্য সেই অর্থহীনতার প্রতিশোধ।” তাই আমি পড়ি। কারণ আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। বাস্তবের ওপর, ভবিষ্যতের ওপর, আর সবচেয়ে বড় কথা, নিজের সীমাবদ্ধতার ওপর। আমি পড়ি যেন মহুয়া পড়তে পারি, আবার পিয়েরে বোর্দিও পড়েও ঘুম না ভাঙে। আমি পড়ি যেন আমার ভেতরের ভয়গুলো মুখ দেখাতে পারে, আর নিজের ভাঙা আয়নাটায় অন্য মানুষের গল্প দেখতে পারি। এটা গর্ব না, অভ্যেস। গীতশাস্ত্র না, গদ্যশাস্ত্র। এটাই আমার প্রার্থনা, আমার প্রমাণ, আমার প্রতিরোধ।
একটা উপন্যাস পড়ে এতটা হাঁসফাঁস ক’জন করে? “পিঞ্জরে বসিয়া শুক” পড়তে পড়তে আপনি কেবল বাক্য বোঝার চেষ্টায় নন—আপনি ক্রমাগত নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে ব্যাকরণচ্যুত, অলীক, প্রায় রত্নাকর সমুদ্রে ফেলছেন। নানারকম যন্ত্রপাতি নিয়ে যখন আমরা সাহিত্য বুঝতে বসি, তখন কমলকুমার ওই যন্ত্রগুলো ঠাণ্ডা করে দেন। উনি চান আপনি শুধু পাঠক না থাকুন, আপনি হন গন্ধবিহীন, স্বপ্নপোকা, গিরগিটি পাঠক—যার পাঠ মানে চামড়া বদল, লেজ ফেলে রাখা আর প্রলেপে প্রলেপে এক নতুন সংবেদ তৈরির প্রক্রিয়া।
যেমন নাম, তেমন চালচলন। ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’—এটা কি বাক্য? প্রশ্ন? ক্রিয়া-নির্বাকতা? এক ধাঁধা। শুকপাখিটা পিঞ্জরে বসে আদৌ কিছু করে কি? নাকি তার কীর্তির মধ্যে লুকিয়ে আছে ভাষার সমস্ত ব্যাকরণগত কুড়ুল? কমল এই উপন্যাসের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের পাখির খাঁচায় একটা হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ ছেড়ে দেন। পাঠকের গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমরা গন্ধ পাই, শব্দ টের পাই, কিন্তু বাক্যটার কী অর্থ, তা বোধহয় স্পষ্ট হবার আগেই হারিয়ে যায়। মায়ার মতো, হাত বাড়ালেই আর নেই।
এই উপন্যাসের প্রথম লাইনটা তো যেন বাংলা সাহিত্যের সিন্ধু-স্নান।
“তখনই যে সময়ে সুঘরাই হারাইয়া যায়...”
তখনই—মানে? তখন মানে কখন? আগেই ধরে নিচ্ছেন পাঠক টেলিপ্যাথির ক্লাস করেছে। তারপর আসে বাক্য-ছবির এক নান্দনিক বিস্ফোরণ। পাঠক তখন শব্দে নয়, শব্দের পেছনে লুকিয়ে থাকা ক্লান্তি, উন্মাদনা, কল্পনার গন্ধে ভেসে যায়। বাক্য এখানে রচনার সিঁড়ি নয়, একেকটা থিয়েটার সেট—কখনও রঙিন রূপক, কখনও ধর্মীয় দ্বৈততা, কখনও শ্মশানের ছাই মাখানো প্রজাপতি।
সুঘরাই—বালক, হাড়িয়াল ডোম, প্রান্তিক জীব। সে হারিয়ে যায় শিবমেলায়, খুঁজে ফেরে শুকপাখিকে, আসলে খুঁজে ফেরে নিজের ভেতরের হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে। সে খুঁজে ফেরে ভ্রাতৃত্ব, সে খুঁজে ফেরে স্পর্শ। কিন্তু পেল কি? পেল একটা খাঁচা, এক পাখি, যে তার রক্ত চেটে খায়। এই কি মানবজীবনের প্রেম? এই কি ভগবানের সঙ্গে ছেলেমানুষি অভিমান?
সুঘরাইয়ের সঙ্গে যাঁরা মেলায় হাঁটেন, তাঁরা কেউই আসলে মনুষ্যত্বে পরিপূর্ণ নন। মেলায় মিলেমিশে যায় হিজড়ে, পুরোহিত, সার্কাসওয়ালা, মনিব, পত্নী, দোকানদার—সবাই যেন এক ছায়ায় গজিয়ে ওঠা প্রজাতন্ত্র, যেখানেও বর্ণভেদ আর আরাধনার মধ্যে মিশে যায় এক অদ্ভুত দ্বৈরথ। খাঁচার ভিতরের পাখি আর খাঁচার বাইরে থাকা দুনিয়া—দু’টোই সমান তীব্র, সমান নির্লিপ্ত, সমান করুণ।
কমলকুমার এখানে রবীন্দ্রনাথ-সনাতনের মায়া ও আত্মা টেনে এনে শিব-রামকৃষ্ণ-লোকায়তের মিশেল দেন, এমনভাবে, যে পাঠক কনফিউজড হওয়াটাই স্বাভাবিক। “ধর্মে আছি, ধর্মে থাকবো”—এই সার্টিফিকেটকে উনি ছিঁড়ে ফেলেন, সেগুলোকে দিয়ে পাখির জন্য নতুন পালক বানান।
পাঠ করার সময় মনে হয়, এই কি লেখালিখির পরিণতি? ভাষাকে এইভাবে অস্থির করে তোলার সাহস ক’জন রাখেন? বাক্যের মধ্যে বাক্য ঢুকে পড়ে, শব্দের মধ্যেই দাঁড়িয়ে যায় নতুন চেতনা, আর আমরা, নিছক পাঠক, বসে থাকি চুপ করে। শুয়োর আর বাঘ যদি কুয়োয় পড়ে গিয়ে সহাবস্থানে অভ্যস্ত হতে পারে, তবে পাঠক কেন নয়?
আর এই “জটিলতা” শব্দটাকে একটা জাতীয় ধাঁধার মতো ব্যবহার করে যাঁরা বলেন, “উনি বোঝা যায় না”—তাঁদের জন্য উত্তর হ’ল: আরে ভাই, আপনি তো নিজেই বোঝার জন্য তৈরি নন। আপনি শুধু চেয়েছেন “সোজাসুজি বলো”, অথচ উনি “অবচেতনেও জায়গা বানাতে চান”, বুঝলেন?
কমলকুমার তো লেখকের লেখক নন, পাঠকের পাঠকও নন—তিনি সাহিত্যের নির্মম সাধক। তাঁর উপন্যাস মানে আগুনে ঝাঁপ। সেটা কে পড়বে, কে বুঝবে, কে বুক ঠুকে বলবে “আমি পড়েছি”—তা তাঁর পরোয়া নেই। তিনি খাঁচার ভিতর থেকেও আকাশ দেখাতে পারেন। আর আকাশ তো বাঁধা যায় না, তাই “পিঞ্জরে বসিয়া শুক” পড়া মানে নিজের মগজে এক-একটা নতুন জানালা বসানো।
আমরা বলতেই পারি, এই উপন্যাস মহাভারতের শুক না, রামকৃষ্ণের শুক, না, কিন্ডল-এর শুক, বরং কমলকুমারের নিজের এক রূপকথার শুক, যে জানে কথা বলা মানে খালি বাচন নয়, গলা ফাটিয়ে অস্তিত্বের জন্ম দেওয়া।
এটুকু পড়েই যদি আপনার মনে হয়—“আরে ভাই, এটা তো অনেক কঠিন”—তাহলে আপনার জন্য উপন্যাসটা নয়। আপনি পড়ুন পাখির কথা, ব্যাকরণ না বুঝে গান গাইতে পারা কাকেদের কথা। কমল তো চান, আপনারও কিচিরমিচির হোক, কিন্তু তার আগে নিজেকে একটু হারান, নিজের শুকটাকে একটু বসান, একটা খাঁচায়।
তাহলেই হয়তো আপনি বুঝতে পারবেন—শুক বসে আছে, কিন্তু পিঞ্জর আসলে আমাদের ভেতরের, বাইরের নয়।