বুক রিভিউ: নাইফ - সালমান রুশদি
Knife বইটি একদিকে সাহিত্যিক রচনা, আবার অন্যদিকে দার্শনিক চিন্তাধারা এবং মানবীয় অভিজ্ঞতার অনন্য মিশ্রণ।
সালমান রুশদির "Knife" (২০২৪) নিছক আত্মজীবনী নয়; এটি এক ভয়ংকর হত্যাচেষ্টার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে আসার কাহিনি। বইটি শুধু রক্তাক্ত ঘটনাগুলোর বর্ণনায় আটকে থাকে না, বরং শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক ক্ষতগুলোর গভীরে গিয়ে পরিচয়, মতাদর্শ এবং গল্প বলার শক্তির অনুসন্ধান করে।
রুশদি এখানে কেবল একজন বেঁচে থাকা মানুষ হিসেবে কথা বলেন না, বরং একজন লেখক হিসেবে নিজের অস্তিত্বকে নতুনভাবে চেনার চেষ্টা করেন। সাহস, পুনর্জন্ম, এবং মানব আত্মার স্থিতিস্থাপকতা—এই তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে "Knife" পাঠককে এক হৃদয়বিদারক কিন্তু অনুপ্রেরণামূলক যাত্রায় নিয়ে যায়। এটি সেই গল্প, যেখানে মৃত্যু খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে গেলেও, কথার শক্তি জীবনকে ফিরিয়ে আনে।
সালমান রুশদি এক বিশিষ্ট ব্রিটিশ-ভারতীয় ঔপন্যাসিক, যিনি তাঁর উদ্ভাবনী বর্ণনাশৈলী এবং ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে জাদুবাস্তবতাকে মিশিয়ে গল্প বলার অনন্য দক্ষতার জন্য সুপরিচিত। তাঁর লেখা শুধু কল্পনার খেলা নয়; বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিগত পরিচয়ের জটিলতা নিয়ে এক সূক্ষ্ম নিরীক্ষা।
"Midnight’s Children" (১৯৮১) তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। শুধু বুকার পুরস্কারই নয়, বরং এটি 'বেস্ট অব বুকার' স্বীকৃতি লাভ করে এবং আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী উপন্যাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিক ঘটনাকে ব্যক্তিগত কাহিনির মাধ্যমে তুলে ধরার অসাধারণ ক্ষমতা এই বইকে অনন্য করেছে।
তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে আছে "Shalimar the Clown", যা প্রেম, প্রতিশোধ এবং রাজনীতির টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে লেখা এক হৃদয়বিদারক উপন্যাস। আর "The Satanic Verses"—একটি সাহিত্যকর্ম, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয় এবং বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসে।
রুশদির সাহিত্য সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ব্যক্তিগত পরিচয়ের সংঘর্ষকে বিশ্লেষণ করার এক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন অন্বেষণ। সাহিত্যের জগতে তাঁর স্থান শুধু একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে নয়, বরং একজন সাহিত্যসৈনিক হিসেবে, যিনি বাকস্বাধীনতার পক্ষে আপসহীনভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছেন।
সালমান রুশদিকে হত্যাচেষ্টার খবর আমার কাছে এক গভীর আঘাতের মতো লেগেছিল। ইরানের শাসক যখন তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়াজারি করেছিলেন, তখন থেকে তিন দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এত বছর পরেও, সেই সহিংসতার ছায়া যে এতটা দীর্ঘ হতে পারে, তা যেন কল্পনাতীত ছিল।
কিন্তু দীর্ঘ অপেক্ষার পরও, এক চব্বিশ বছর বয়সী যুবক প্রকাশ্যে তাঁর উপর নৃশংস হামলা চালায়—একটি ঘটনা, যা শুধু একজন লেখকের বিরুদ্ধে নয়, বরং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সহিংস চরমপন্থার স্থায়ীত্বকেই নির্মমভাবে উন্মোচিত করে।
এ যেন প্রমাণ করে দেয়, চেতনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। একদিকে মুক্তচিন্তার সাহসী উচ্চারণ, অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সহিংসতার অবিরাম ঢেউ—এই দ্বন্দ্বের কোনো শেষ নেই। রুশদি সেই দ্বন্দ্বের প্রতীক হয়ে উঠেছেন, আর তাঁর লড়াই শুধু তাঁর একার নয়, গোটা মুক্তচিন্তার জগতের।
এই নৃশংস আক্রমণের অভিঘাতে সালমান রুশদি এক ডজনেরও বেশি ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হন, এবং আক্রমণকারীকে প্রতিহত করার আগেই মারাত্মক আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁর চিকিৎসকরাও বিস্মিত হয়েছিলেন—এমন ভয়াবহ হামলার পরেও তিনি কীভাবে বেঁচে গেলেন?
কিন্তু বেঁচে যাওয়াই ছিল লড়াইয়ের শেষ নয়; বরং শুরু। সুস্থ হওয়ার পথে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এই ঘটনা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়—তাঁকে এর মুখোমুখি হতেই হবে।
সেই অভিজ্ঞতারই নিবিড় অনুসন্ধান "Knife"—একটি ব্যক্তিগত অথচ তথ্যনির্ভর আত্মজীবনী, যেখানে রুশদি তুলে ধরেছেন কী হারিয়েছেন, কী ধরনের শারীরিক ও মানসিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে, এবং এই নতুন করে পাওয়া জীবনের সুযোগ তিনি কীভাবে কাজে লাগাতে চান।
এই বই নিছক এক আক্রমণের বিবরণ নয়—এটি সাহস, বেদনা, এবং পুনর্জন্মের এক অসামান্য দলিল, যেখানে একজন লেখক অস্ত্র দিয়ে নয়, শব্দের শক্তিতে প্রতিঘাত করেছেন।
২০২২ সালের ১২ আগস্ট, সালমান রুশদি নিউ ইয়র্কের চোটাকোয়া ইনস্টিটিউশনে একটি আলোচনায় বক্তব্য দিতে যাচ্ছিলেন, যার বিষয় ছিল—"আমেরিকায় অন্যান্য দেশের লেখকদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরির প্রয়োজনীয়তা।" বিষয়টি তাঁর জন্য কেবল বক্তৃতার বিষয় ছিল না; বরং এক গভীর ব্যক্তিগত সত্য। কারণ তিনি নিজেও একসময় শৈশবে ভারত থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসিতহয়েছিলেন, আর ১৯৮৮ সালে "The Satanic Verses" প্রকাশের পর থেকেই এক স্থায়ী হুমকির ছায়ায় বেঁচে আছেন।
এই উপন্যাসটি ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির চোখে ধর্মনিন্দার শামিল বলে বিবেচিত হয়। পরিণতিতে তিনি রুশদির মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে এক ফতোয়া জারি করেন—একটি সিদ্ধান্ত, যা শুধু একজন লেখকের জীবন বদলে দেয়নি, বরং বিশ্বজুড়ে সাহিত্য, ধর্ম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে এক দীর্ঘ বিতর্কের জন্ম দেয়।
চোটাকোয়ার সেই মঞ্চে রুশদি যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার কথা বলতে উঠছিলেন, তখনই সহিংস উগ্রবাদের সেই পুরনো ছায়া বাস্তবের রক্তাক্ত রূপ নিয়ে তাঁর সামনে হাজির হয়।
লেখকদের জন্য নিরাপদ স্থান তৈরির প্রসঙ্গ সালমান রুশদির জন্য এক নির্মম বিদ্রুপে পরিণত হয়, কারণ তিনি সেই বক্তৃতাটি আর দিতে পারেননি। মঞ্চে বসে থাকার সময়ই এক ছুরি-ধারী আক্রমণকারী আচমকা তাঁর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
রুশদি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, প্রতিরোধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মাত্র সাতাশ সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি একের পর এক ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হন। মুহূর্তের মধ্যে রক্তে ভেসে যাওয়া মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন—মৃত্যুর মুখোমুখি একজন লেখক, যিনি চিরকাল মুক্তচিন্তার জন্য লড়াই করেছেন।
প্রায় পনেরোবার ছুরিকাঘাত করা হয় তাঁকে—ছুরিটি তাঁর বাঁ হাতে প্রবেশ করে, তলপেটে, গলায়, এবং ডান চোখে গভীরভাবে বিদ্ধ হয়। এই হামলা শুধু শারীরিক আঘাত নয়, এটি ছিল এক চিন্তার ওপর চালানো আক্রমণ, বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে সহিংসতার আরেকটি রক্তাক্ত স্বাক্ষর।
এই ভয়াবহ ঘটনাকে যেন আরও রহস্যময় করে তোলে রুশদির কয়েক দিন আগেই দেখা এক অস্বাভাবিক পূর্বাভাস—এক অজানা আশঙ্কা, যা তাঁর মনে দানা বাঁধছিল। হয়তো তিনিও জানতেন না, এই আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নেবে, কিংবা হয়তো কোথাও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মুক্তচিন্তার জন্য লড়াই মানেই বিপদের সঙ্গে বসবাস করা।
চোটাকোয়ায় রওনা হওয়ার আগের রাতে, সালমান রুশদি এক দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন—এক বিশাল অঙ্গনের মাঝে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, আর এক গ্ল্যাডিয়েটর বারবার তাঁকে জ্যাভেলিন দিয়ে আঘাত করছে।
সেই সময় হয়তো তিনি এই স্বপ্নকে শুধুই এক দুশ্চিন্তার প্রতিচ্ছবি ভেবেছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন, বছরের পর বছর হুমকির ছায়ায় বাস করার ফলে মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা আতঙ্কই স্বপ্ন হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু তখনও তিনি ভাবেননি, এই দুঃস্বপ্ন এত দ্রুত, এত নির্মমভাবে বাস্তব হয়ে উঠবে।
পরের দিনই, চোটাকোয়ার মঞ্চে তিনি যখন বাকস্বাধীনতার পক্ষে কথা বলতে উঠছিলেন, তখনই তাঁর সামনে এক বাস্তব গ্ল্যাডিয়েটর হাজির হয়—হাতে ছুরি নিয়ে, হত্যার সংকল্প নিয়ে। তাঁর স্বপ্নে যে যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা তিনি পেয়েছিলেন, তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর বাস্তব জীবনের রক্তাক্ত সত্য হয়ে দাঁড়ায়।
অডিটোরিয়ামের মেঝেতে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকার সময়, সালমান রুশদির চিন্তাগুলো যেন এক বিচ্ছিন্ন, অবাস্তব ঘোরের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিল। ব্যথা, আতঙ্ক, বিস্ময়—সব মিলেমিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি।
পরে অনেকে বলেছিল, তিনি ব্যথায় চিৎকার করছিলেন, কিন্তু সেই মুহূর্তের কোনো স্মৃতি তাঁর নেই। ব্যথা যেন তাঁর চেতনার বাইরে ছিল—শরীর হয়তো কষ্ট পাচ্ছিল, কিন্তু মন তখন এক অন্য স্তরে প্রবাহিত হচ্ছিল।
তবে তিনি একটা ব্যাপার স্পষ্টভাবে মনে করতে পারেন—এক গভীর, অসহ্য দুঃখের অনুভূতি তাঁকে আচ্ছন্ন করেছিল। তাঁর মনে হয়েছিল, এলিজাকে আর কখনো দেখতে পারবেন না, তাঁর দুই ছেলের মুখ আর কোনোদিন দেখা হবে না।
শরীর তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, কিন্তু তাঁর ভাবনার কেন্দ্র ছিল প্রিয় মানুষগুলো, যাঁদের হয়তো তিনি শেষবারের মতো বিদায় জানাচ্ছিলেন।
তিনি আতঙ্কিত হয়ে দেখছিলেন, লোকেরা তাঁর নতুন Ralph Lauren স্যুট কেটে রক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা করছে—আর সেটাই যেন তাঁকে অদ্ভুতভাবে কষ্ট দিচ্ছিল। ব্যথা অনুভব করছিলেন কি না, মনে নেই; কিন্তু স্যুট নষ্ট হয়ে যাওয়ার এই দৃশ্য তাঁকে এক অস্বাভাবিক যন্ত্রণা দিচ্ছিল।
এমনকি সে মুহূর্তেও, তাঁর মনে হচ্ছিল—চাবি আর মানিব্যাগের কী হবে? কোথায় পড়ল? হারিয়ে গেল না তো? অথচ সেই মুহূর্তে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষের ভাবনার সঙ্গে এমন উদ্বেগের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়।
জনতার সামনে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকা যেন তাঁকে আরও বিব্রত করছিল, যেন মৃত্যুপ্রায় শরীরের চেয়েও এই অনাহূত উন্মোচন বেশি যন্ত্রণাদায়ক।
এই টুকরো টুকরো মানবসুলভ উদ্বেগের মুহূর্তগুলোই ছিল তাঁর স্মৃতির শেষ দাগ—চেতনাজুড়ে তখন কেবল অনিশ্চয়তা, বিভ্রান্তি, এবং এক গভীর অস্বস্তি।
অল্প সময়ের মধ্যেই সালমান রুশদিকে একটি স্ট্রেচারে তুলে দ্রুত অপেক্ষমাণ হেলিকপ্টারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর শরীর তখনও রক্তে ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন—সময় খুব বেশি নেই। হেলিকপ্টারে শুয়ে থাকতে থাকতে তাঁর ভাবনাগুলো একেবারে স্পষ্ট ও বাস্তববাদী হয়ে ওঠে—এটাই হয়তো শেষ। তিনি মারা যাচ্ছেন।
কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর পরিবার, বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী এলিজা, কিছুই জানতেন না। আক্রমণের সময় তিনি মেরিল্যান্ডে পরিবারের সঙ্গে ছিলেন। খবর পেয়েই সবকিছু ফেলে রেখে তড়িঘড়ি করে পেনসিলভানিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন, স্বামীর পাশে থাকার জন্য, যখন জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে দুলছিলেন রুশদি।
এলিজা হাসপাতালে পৌঁছে দেখেন, একাধিক শল্যচিকিৎসক রুশদির চোখ, বুক, গলা ও লিভারের গভীর ক্ষত সারানোর জন্য নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। অস্ত্রোপচার কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এলিজা তখনও জানেন না, তাঁর স্বামী এই রাত পার করতে পারবেন কি না।
প্রাথমিক কিছু বিভ্রান্তিকর খবরে তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছিল নানা তথ্য, কিন্তু বাস্তবে রুশদি তখনও জীবিত ছিলেন—ভীষণভাবে আহত, কিন্তু প্রাণে বেঁচে। তাঁর চারপাশের চিকিৎসকরা জানতেন, বেঁচে যাওয়া আর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার মধ্যে এক বিশাল ব্যবধান আছে। কিন্তু তিনি টিকে গেছেন—এটাই তখনকার সবচেয়ে বড় অলৌকিক ঘটনা।
এদিকে, হামলাকারী—নিউ জার্সির ২৪ বছর বয়সী যুবক—চোটাকোয়া কাউন্টি কারাগারে বিনা জামিনে বন্দি ছিল। মাত্র এক মুহূর্তের নৃশংসতা তার জীবনকে চিরতরে বদলে দিল, কিন্তু পাল্টে গেল সালমান রুশদির অস্তিত্বও—একজন ব্যক্তি, একজন লেখক, এবং একজন চিন্তাবিদ হিসেবে তাঁকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করল তাঁর জীবন, মৃত্যু, এবং লেখকসত্তার দায়বদ্ধতা নিয়ে।
রুশদির সেরে ওঠার পুরো সময় জুড়ে এক অদৃশ্য ছায়ার মতো হামলাকারীর অস্তিত্ব তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়—এক ব্যক্তি, যাকে তিনি শুধুই ‘A’ বলে উল্লেখ করেন—assailant বা would-be assassin হিসেবে।
তিনি হামলার বিষয়ে সংবাদ প্রতিবেদনগুলো খুঁটিয়ে পড়েন এবং New York Post-কে দেওয়া হামলাকারীর এক সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারেন—২৪ বছর বয়সী এই যুবক আয়াতুল্লাহ খোমেনি, ইরানি সরকার এবং শিয়া মুসলিম চরমপন্থীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিল।
তিনি আরও শোনেন, হামলাকারী নিউ জার্সিতে তার মায়ের সঙ্গে একা থাকত, এবং তার মা তাঁকে একদম সাধারণ, ভালো ছেলেবলেই জানতেন। এক ভয়াবহ সহিংসতার নেপথ্যে থাকা এই দুই বাস্তবতা—একদিকে উগ্র মতাদর্শ, অন্যদিকে এক সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা তরুণ—রুশদির মনে এক গভীর প্রশ্নের জন্ম দেয়।
"কে ছিল এই A? কেমন ছিল তার মন? কেমন ছিল তার বেড়ে ওঠা?"
এই প্রশ্নগুলোই "Knife"-এর বুনন তৈরি করে—একজন লেখকের দৃষ্টিতে এক হত্যাচেষ্টার মানসিক, সামাজিক, এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণের এক নির্মম প্রয়াস।
কিন্তু সেই ধারণা বদলে যায়, যখন ১৯ বছর বয়সে সে লেবাননে তার বাবার কাছে যায়—সেখানেই তার চেতনাজগতে এক মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। নতুন পরিবেশ, নতুন মতাদর্শের সংস্পর্শ—সবকিছুই তাকে ধীরে ধীরে বদলে দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এই পরিবর্তনই রুশদির জীবনের জন্য এক ভয়াবহ হুমকিতে রূপ নেয়।
কিন্তু সে কি সত্যিই রুশদির চিন্তাভাবনা বা কাজ সম্পর্কে জানত?
যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় সে সালমান রুশদি সম্পর্কে কতটুকু জানত, তার জবাব ছিল অবিশ্বাস্যভাবে ঠুনকো—সে "The Satanic Verses" এর মাত্র দু’পাতা পড়েছিল এবং রুশদির একটি বক্তৃতার ভিডিও দেখেছিল। আর এতেই তার মনে হয়েছিল, "রুশদি একেবারেই খাঁটি মনে হয় না।"
এই গভীর অজ্ঞতা ও অন্ধ বিশ্বাসের মিশ্রণ রুশদিকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। একজন লেখক হিসেবে, তিনি এই মানসিকতা বুঝতে চেয়েছেন, কারণ সহিংসতার পেছনে কেবল ঘৃণা থাকলে হয় না, থাকতে হয় এক ধরণের আত্মবিশ্বাস—এক বিশ্বাস, যা যুক্তি নয়, বরং অনুভূতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।
এটিই বোঝার জন্য, রুশদি নিজের লেখকসুলভ দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এক কাল্পনিক সংলাপ তৈরি করেন। তিনি এক রাগান্বিত যুবকের চরিত্রে প্রাণ দেন—একজন, যে মনে করে, "শয়তানি ধর্মনিরপেক্ষ মিথ্যাবাদীদের" বিরুদ্ধে সত্য রক্ষার দায়িত্ব তার।
এই কাল্পনিক কথোপকথনে তিনি "A"-এর মনে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন, বোঝার চেষ্টা করেন—কীভাবে একজন তরুণ মৌলবাদী হয়ে ওঠে, কীভাবে বই না পড়েও কারও বিরুদ্ধে মৃত্যুপরোয়ানা কার্যকর করতে উদ্যত হয়।
এই সংলাপ শুধু একজন লেখকের আত্মবিশ্লেষণ নয়, বরং একটি যুগের মনস্তত্ত্ব বুঝতে চাওয়ার এক প্রচেষ্টা—এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন মুক্তচিন্তক কীভাবে সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান, তারই এক ব্যক্তিগত অনুধ্যান।
এই কল্পিত আলাপচারিতায়, রুশদি A-এর যুক্তির মোকাবিলা করতে গিয়ে একের পর এক প্রশ্ন তোলেন—যেমন, সে কি সত্যিই জানে সে যা করছে, তা ন্যায়সংগত? সে কি বোঝে সে কিসের বিরুদ্ধে লড়ছে?
কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সাহস বা ধৈর্য A-এর ছিল না। বিরক্তি আর অস্থিরতায় সে ক্রমশ কুঁকড়ে যেতে থাকে, যেন যুক্তির সামনে দাঁড়ানোর শক্তি তার নেই। সে কি শুধুই রুশদিকে মিথ্যাবাদী বলে দাগিয়ে দিতে চেয়েছিল? নাকি সে নিজের মস্তিষ্কে গেঁথে দেওয়া এক শত্রুকে খুঁজে পেয়েছিল, যার বিনাশই তার লক্ষ্য?
শেষ পর্যন্ত, রুশদি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। A কখনোই তাকে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে দেখার চেষ্টা করেনি—সে শুধু একটি নাম, একটি প্রতীক, একটি শত্রু তৈরি করেছিল—একটি পরিচয়হীন অস্তিত্ব, যার প্রয়োজন ছিল শুধু ঘৃণার পরিসরে টিকে থাকার জন্য।
এই কাল্পনিক সংলাপের অনুশীলন শেষে, রুশদি ফিরে যান দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের এক গভীর পর্যবেক্ষণের দিকে—
"নিষ্ঠুর মানুষ নিষ্ঠুর ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, আর সদয় মানুষ সদয় ঈশ্বরে।"
এই কথাটি যেন পুরো অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ হয়ে ওঠে। তাঁর আক্রমণকারী কেবল ঘৃণার এক নির্মম সংস্কৃতির প্রতিফলন—এক এমন বাস্তবতা, যেখানে সহানুভূতির কোনো স্থান নেই, চিন্তার জন্য কোনো জায়গা নেই, যুক্তি সেখানে মূল্যহীন।
সালমান রুশদির "Knife" মনে করিয়ে দেয় যে আঘাতের পরও লড়াই থামবে না—মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য, গল্প বলার শক্তির পক্ষে, এবং সেই অন্ধ চিন্তার বিরুদ্ধে, যা যুক্তি ও মানবতাকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। এটি শুধু একজন লেখকের ব্যক্তিগত পুনর্জন্মের গল্প নয়, বরং চিন্তার মুক্তির জন্য এক অবিরাম যুদ্ধের দলিল।
সাম্প্রতিকতম তথ্য:
সালমান রুশদির ওপর হামলাকারী হাদি মাতার হত্যাচেষ্টার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তার সর্বোচ্চ ৩২ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।