লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: কথাসাহিত্যের শিল্প এবং অস্তিত্বের অনুসন্ধান
২০২৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন লাসলো ক্রাসনাহোরকাই।
রিটন খান
আমার এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় প্রতিধ্বনি পত্রিকায়।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই (László Krasznahorkai) ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত শাসনের অধীনে থাকা হাঙ্গেরির ছোট প্রাদেশিক শহর গিউলায় (Gyula) জন্মেছিলেন। এটি সেই স্থান, যা পরবর্তীতে তাঁর উপন্যাসগুলির অন্ধকার ও বিপন্ন জগতের মানচিত্রে পরিণত হয়। আধুনিক কথাসাহিত্যের পরিসরে তিনি এক অনন্য উপস্থিতি—যাঁর লেখায় অস্তিত্বের গভীর অস্বস্তি, দার্শনিক জিজ্ঞাসা এবং এক মহাকাব্যিক বুনন একাকার হয়ে গেছে। তাঁর বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে Satantango (১৯৮৫), The Melancholy of Resistance (১৯৮৯), War and War (১৯৯৯) এবং Baron Wenckheim’s Homecoming (২০১৬)। তাঁর বাক্যরীতি দীর্ঘ, সঙ্কুল, এবং ঢেউয়ের মতো ধীর ছন্দে চলমান—যেন প্রতিটি বাক্য চরিত্রের অন্তর্জগতে নিমজ্জিত একটি নদী। বৌদ্ধ শাস্ত্রের ধ্যানমগ্নতা এবং ইউরোপীয় চিন্তার সূক্ষ্ম বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকার তাঁর ভাষায় একত্রে প্রবাহিত। তাঁর চরিত্ররা নিতান্তই অস্থির, আবেশগ্রস্ত, এবং বৃষ্টিস্নাত মলিন প্রান্তরে হারিয়ে থাকা ভাসমান সত্তা—যেন এক অদৃশ্য আলোর অনুসন্ধানে তাদের যাত্রা অনন্ত। অনেকেই তাঁর গদ্যকে উত্তর-আধুনিক আত্মম্ভরিতার প্রকাশ বলে ভুল করেন, অথচ তার গভীরে রয়েছে এক অনবদ্য সংযম, নিঃশব্দ লাবণ্য, এবং এমন এক মৃদু রসিকতা, যা প্রতিটি বাক্যকে ধ্যানের গভীর নীরবতায় পরিণত করে।
যদিও লাসলো বর্তমানে বার্লিনে বসবাস করেন, তবুও হাঙ্গেরির প্রদেশে তাঁর একটি বাড়ি এখনো রয়ে গেছে, যেখানে তাঁর বহু উপন্যাসের ভাবনা প্রথম অঙ্কুরিত হয়েছিল। তাঁর ইংরেজি উচ্চারণে রয়েছে মধ্য ইউরোপীয় ঐতিহ্যের এক মোহময় ছোঁয়া—সেই ‘মিটলইউরোপীয়’ টান, যেখানে জার্মান উচ্চারণের গাম্ভীর্য আর হাঙ্গেরীয় ধ্বনির সুর মিশে গেছে সূক্ষ্মভাবে। কখনো কখনো তাতে শোনা যায় আমেরিকান টানও—সেটি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন নব্বইয়ের দশকে, যখন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের নিউ ইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টে দীর্ঘদিন ছিলেন। সেই সময়ের সাংস্কৃতিক মিশ্রণ, ভাষার বুনন, আর শিল্পচিন্তার স্বাধীনতা তাঁর উচ্চারণের মতোই তাঁর লেখার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে: এক স্থানে ইউরোপের নির্জনতা, অন্য স্থানে আমেরিকার উন্মুক্ত শহুরে সুর।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখকজীবনের সূচনা হয়েছিল এক গভীর দার্শনিক অনুভব থেকে—যে “প্রকৃত জীবন, সত্য জীবন অন্য কোথাও ছিল।” এই ধারণাই ছিল তাঁর সাহিত্যিক পথচলার প্রেরণা, এক ধরনের আত্ম-উদ্ধারের অনুসন্ধান। ষাটের দশকের শেষভাগ থেকে সত্তরের দশকের শুরুতে তাঁর আধ্যাত্মিক ও বৌদ্ধিক আশ্রয় ছিল দুটি গ্রন্থে—ফ্রাঞ্জ কাফকার The Castle এবং ম্যালকম লরির Under the Volcano। এই দুই বই তাঁর কাছে ছিল যেন বাইবেল, মানবজীবনের অস্তিত্বগত বিভ্রান্তি ও আত্ম-সংঘর্ষের প্রতীক।
তবু লাসলো নিজেকে কখনো প্রচলিত অর্থে “লেখক” হিসেবে কল্পনা করেননি। তাঁর ইচ্ছা ছিল মাত্র একটি বই লেখা: একটি নিখাদ, সর্বগ্রাসী অভিজ্ঞতার মতো গ্রন্থ—এরপর তিনি নিজেকে নিবেদন করতে চেয়েছিলেন সঙ্গীতে, আর জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন দরিদ্রতম মানুষের পাশে থেকে। তাঁর ধারণায়, সেখানেই লুকিয়ে ছিল “প্রকৃত জীবন”—যেখানে শিল্প ও দারিদ্র্যের ভেতর কোনো বিভাজন থাকে না, যেখানে জীবন নিজেই এক রূপকল্প। এই সময়ে তিনি বসবাস করতেন হাঙ্গেরির প্রত্যন্ত দরিদ্র গ্রামগুলিতে। রাষ্ট্রীয় সামরিক পরিষেবা এড়ানোর জন্য তাঁকে প্রায় তিন-চার মাস অন্তর আশ্রয় বদলাতে হতো। এই ঘন ঘন স্থানান্তর কেবল রাজনৈতিক বাস্তবতার বিষয় নয়—তা এক রকমের আধ্যাত্মিক তপস্যাও ছিল, যেন প্রতিটি অস্থায়ী ঠিকানা তাঁর মানসিক মানচিত্রে একটি নতুন দার্শনিক স্থানাঙ্ক যোগ করছিল।
লাসলো যখন প্রথম ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন, তখনই হাঙ্গেরির পুলিশ তাঁর প্রতি সন্দিহান হয়ে ওঠে। তলব করা হয় তাঁকে, প্রশ্ন করা হয় তাঁর লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই সময় ছিল কমিউনিস্ট শাসনের কঠোরতম পর্যায়, যেখানে সাহিত্য মানে ছিল সন্দেহ, এবং কল্পনা ছিল একপ্রকার বিপ্লব। এই বাস্তবতার মধ্যেই তিনি লেখেন স্যাটানটাঙ্গো (Satantango)। এমন একটি উপন্যাস যা শাসকগোষ্ঠীর কাছে রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক বলে গণ্য হবার কথা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, বইটি প্রকাশিত হয়। লাসলো নিজেও কখনো পুরোপুরি বোঝেননি, কেমন করে এমন এক রাজনৈতিক আবহে তাঁর এই রচনা মুদ্রণের অনুমতি পেয়েছিল। তাঁর অনুমান ছিল, প্রকাশনা সংস্থার তৎকালীন পরিচালক। যিনি একসময় হাঙ্গেরির গোপন পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। সম্ভবত নিজ ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। হয়তো এই প্রকাশনা ছিল একধরনের নীরব বিদ্রোহ, অথবা শাসনের ভেতর থেকেই সাহসিকতার এক অদ্ভুত প্রকাশ। যেভাবেই হোক, সেই অনুমোদনই লাসলোর সাহিত্যিক কিংবদন্তির সূচনা চিহ্নিত করেছিল। একটি বই, যা শাসনের ছায়া ভেদ করে জন্ম দিয়েছিল এক স্থায়ী সাহিত্যিক আলোর।
লাসলো সোভিয়েত শাসনের দিনগুলিকে বর্ণনা করেছেন এক সময়হীন সমাজ-এর অভিজ্ঞতা হিসেবে। একটি স্থবির পৃথিবী, যেখানে সময় যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেখানে মানুষকে শেখানো হতো যে কিছুই পরিবর্তন হবে না, কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এবং বর্তমানই একমাত্র বাস্তবতা। এক স্থায়ী, ক্লান্তিকর হতাশার বৃত্ত। জীবনের সমস্ত গতি ও সম্ভাবনা যেন রাষ্ট্রের অনুমতির ওপর নির্ভরশীল ছিল, আর সেই অনুমতি প্রায়ই অনুপস্থিত। তাঁর পারিবারিক পটভূমিও ছিল এই ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। লাসলোর পরিবার ছিল সামাজিক গণতন্ত্রী আদর্শে বিশ্বাসী: যা সোভিয়েত হাঙ্গেরির রাজনৈতিক রূপরেখায় নিজেই একপ্রকার বিপজ্জনক অবস্থান। তাঁর বাবা, যিনি ইহুদি বংশোদ্ভূত (এই সত্যটি তাঁর কাছ থেকে ১১ বছর বয়স পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছিল), সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষদের নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করতেন, প্রায়ই কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না। এই মানবতাবোধ ও নৈতিক দায়বদ্ধতার ছাপ পরে ছড়িয়ে পড়ে লাসলোর লেখায়—বিশেষত তাঁর চরিত্রগুলোর ভেতরে থাকা করুণা ও অসহায়তার মধ্যে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে তাঁর দাদা নিজের ইহুদি নাম ‘কোরিন’ পরিবর্তন করে ‘ক্রাসনাহোরকাই’ রাখেন। যেন এক অদৃশ্য ছদ্মবেশ, সময়ের অনিবার্য নিষ্ঠুরতা থেকে রক্ষা পাবার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা। নামের এই রূপান্তরই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হয়ে ওঠে পরিচয় ও টিকে থাকার মধ্যবর্তী টানাপোড়েনের প্রতীক। যা লাসলোর সাহিত্যের ভেতর দিয়ে বারবার ফিরে আসে এক দীর্ঘ প্রতিধ্বনির মতো।
তাঁর জীবনের এক পর্বকে লাসলো নিজে আখ্যা দিয়েছেন Wanderjahre—অর্থাৎ ‘ভ্রমণ বছর’। সেই সময়ে তিনি জীবনের নানা অপ্রত্যাশিত পেশায় নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন, যেন তিনি বাস্তবতার প্রতিটি স্তরকে স্পর্শ করতে চান, সরাসরি, অনাবৃতভাবে। তিনি কাজ করেছেন খনিতে—যদিও আসল শ্রমিকেরা তাঁকে সুরক্ষার ছায়ায় রেখেছিল, যেন এই সংবেদনশীল বুদ্ধিজীবী তরুণটি কঠোর পরিশ্রমের বিপজ্জনক যন্ত্রের আঘাতে আহত না হয়। পরবর্তীতে তিনি ছয়টি ছোট গ্রামের সংস্কৃতি কেন্দ্রের পরিচালক হন। এই কাজ যা তাঁকে বুর্জোয়া পারিবারিক জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, এবং তাঁকে দেয় প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে বসবাসের সুযোগ।
তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল ৩০০ গরুর নাইট ওয়াচম্যানের কাজ। সেখানে কোনো গ্রাম বা শহর ছিল না, কেবল নিঃস্তব্ধতা, গরুর শব্দ, আর বিশাল চাঁদের নিচে ছড়িয়ে থাকা তৃণভূমি। সেই নৈঃশব্দ্যের মধ্যে তিনি শোনেন অস্তিত্বের গভীরতম অনুরণন—এক ধরনের ধ্যান, যা পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্যের মূল সুরে পরিণত হয়।
হাঙ্গেরীয় সাহিত্যে এক সময় প্রচলিত ধারণা ছিল যে প্রকৃত প্রতিভা ও উন্মাদনা একে অপরের পরিপূরক—একজন সত্যিকারের কবি বা লেখক সম্পূর্ণ মাতাল না হলে তিনি নাকি যথার্থ সৃজনশীল হতে পারেন না। লাসলোও কোনো এক সময় এই ধারণার অনুগামী ছিলেন—তিনি নিজেকে বলতেন উন্মত্ত মাতাল। কিন্তু যখন দেখলেন সহলেখকরা এটি জীবনের একমাত্র সম্ভাব্য নিয়ম হিসেবে মেনে নিচ্ছেন, তখনই তিনি প্রতিবাদ করেন। এক আলোচনায় ঘোষণা করেন: তিনি এই মিথ ভাঙবেন, এবং বাজি ধরেন শ্যাম্পেন দিয়ে যে তিনি আর কখনো মদ স্পর্শ করবেন না। সেই প্রতিজ্ঞা তিনি পালন করেনও। এই পরিহারের মধ্যে শুধু আত্মনিয়ন্ত্রণ নয়, বরং ছিল এক অস্তিত্ববাদী বিবৃতি—যেন তিনি বলতে চেয়েছিলেন, সৃষ্টিশীলতা মদে নয়, বরং নিঃসঙ্গতা ও সংযমে নিহিত।
লাসলোর জীবনে সামরিক বাহিনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল এক দুঃস্বপ্নের মতো—তাঁর ভাষায়, “প্রায় মৃত্যুর সমান।” মাত্র আঠারো বছর বয়সে, সামরিক জীবনের সূচনা মুহূর্তেই তিনি এমন এক দৃশ্যের সাক্ষী হন যা সারাজীবনের জন্য তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াবে: তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, দরজা খোলার ঠিক সেই মুহূর্তে নিজের বন্দুক ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করে। সেই গুলির শব্দ তাঁর মানসপটে গেঁথে যায় চিরকালের মতো। যেন বাস্তবতা হঠাৎ এক অচেনা, শূন্য প্রতিধ্বনিতে রূপ নিল।
যুবক লাসলো প্রথমে আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। আংশিকভাবে ফ্রাঞ্জ কাফকার মতো হওয়ার গোপন আকাঙ্ক্ষা থেকেই। কাফকার মতোই তিনি সমাজের গঠন, অপরাধবোধ এবং আইন-শাসনের অন্তর্লীন মানসিক জটিলতা অন্বেষণ করতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে তাঁর আগ্রহ ছিল ফৌজদারি মনোবিজ্ঞানে। যা তৎকালীন হাঙ্গেরিতে রাষ্ট্রের দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছিল।
তবে মাত্র তিন সপ্তাহ পরই তিনি আইন অনুষদ ত্যাগ করে শহরটি ছেড়ে চলে যান, যেন সেই স্থানের শ্বাসরুদ্ধকর বদ্ধ পরিবেশ তাঁর আত্মার জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। সামরিক সেবা এড়ানোর উদ্দেশ্যে তিনি পরবর্তীতে ধর্মতত্ত্ব ও ফিলোলোজি (ভাষাতত্ত্ব) অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। যেখানে ভাষা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক তাঁকে এক নতুন বৌদ্ধিক আশ্রয় দেয়। এই স্থানান্তর কেবল শিক্ষাক্ষেত্রের পরিবর্তন নয়, বরং এক আত্মিক পরিণতি—যেখানে তিনি যুদ্ধ, মৃত্যু ও শাসনের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন ভাষা ও অর্থের বিমূর্ত জগতে।
লাসলো নিজেই বলেছেন, তাঁর উপন্যাসগুলোর এক কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হলো “নিরাপত্তাহীন, দেবদূত-সুলভ চরিত্র”। যারা ভয়াবহ বাস্তবতার মাঝেও এক ধরণের নীরব পবিত্রতা বহন করে। এই চরিত্ররা প্রায়ই নির্দোষ, দুর্বল, অথচ এক রহস্যময় বিশ্বাসে ভরপুর। পৃথিবীর, সমস্ত ভ্রান্তি ও সহিংসতা সত্ত্বেও, শেষ পর্যন্ত সুন্দর। এই ধারণাটি তিনি পেয়েছিলেন তাঁর প্রিয় রুশ লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কির কাছ থেকে। বিশেষ করে White Nights-এর বর্ণনাকারী ও The Idiot-এর প্রিন্স মিশকিন তাঁর কাছে ছিল নায়কতুল্য। তাঁদের অসহায়ত্ব, এবং বিশ্বাস রাখার অকৃত্রিম ক্ষমতা তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল।
এই ছাঁচটি তিনি নিজস্ব লেখাতেও জীবন্ত করে তুলেছেন। যেমন স্যাটানটাঙ্গো-এর এস্তিকে (Estike)—একটি ছোট মেয়ে, যে নির্মমতার কাছে পরাজিত হলেও তার ভিতরে রয়ে যায় এক নিষ্পাপ দৃঢ়তা। অথবা The Melancholy of Resistance-এর ভালুশকা (Valuska)—যে বিশ্বাস করে পৃথিবীর বিশৃঙ্খলার মধ্যেও এক ধরনের সঙ্গতি আছে, যদিও সেই বিশ্বাসই শেষ পর্যন্ত তাকে ধ্বংস করে। লাসলো এইসব চরিত্রের মধ্যে এক ধরনের আধ্যাত্মিক মর্যাদা দেখেন, তবু স্বীকার করেন—এই “বিশ্বের প্রতি বিশ্বাস” আজকের বাস্তবতায় তাঁর কাছে আর সম্ভব নয়।
হাঙ্গেরীয় গদ্য সাহিত্যে লাসলো একমাত্র লেখক হিসেবে গিউলা ক্রুডিকে (Gyula Krúdy) গভীর শ্রদ্ধা করেন। তাঁর মতে, ক্রুডির রচনাগুলি “প্রায় অনুবাদ-অযোগ্য”—কারণ তাঁর বাক্যগুলির ছন্দ ও ভঙ্গি এমন এক মানুষের মতো, যিনি “সামান্য মাতাল, গভীর বিষণ্ণ, জীবনের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছেন, অথচ অদ্ভুতভাবে দৃঢ়।” তবে ক্রুডি তাঁর সাহিত্যিক আদর্শ ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক কিংবদন্তি, যিনি লেখার মধ্যে এক ধরণের আত্মিক শক্তি জাগিয়ে তুলেছিলেন—এক শূন্যতার ভিতরেও সৃষ্টিশীলতার নীরব আগুন।
তবে ভাষাগতভাবে লাসলোর কাছে আরও তাৎপর্যপূর্ণ ছিলেন কবি জানোস পিলিনস্কি (János Pilinszky)। পিলিনস্কির ভাষা ধীর, ভারী, প্রায় ধর্মীয় মন্ত্রের মতো—প্রতিটি শব্দের শেষ অক্ষর যেন প্রতিধ্বনিত হয় কোনো ভূগর্ভস্থ ক্যাটাকম্বের প্রাচীরে। সেই ভাষা একই সঙ্গে হতাশ ও আশাবাদী। যেন এক পুরোহিত, যিনি ঈশ্বরের নীরবতাতেও আলো খুঁজে পান। লাসলোর নিজের গদ্যেও এই ধীর, ছায়াময় ছন্দ ও সুনির্মিত শব্দবিন্যাসের অনুরণন স্পষ্ট। যেখানে প্রতিটি বাক্য প্রার্থনার মতো দীর্ঘ ও অনিশ্চিত, কিন্তু অনিবার্যভাবে সুন্দর।
লাসলোর দৃষ্টিতে মানুষ কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নয়, বরং প্রকৃতির এক ক্ষণস্থায়ী অংশমাত্র। তাঁর ভাষায়, “আমরা কেবল সেই প্রাণী যারা বিজয়ী”—একটি সাময়িক বিজয়, যা প্রকৃতির মহাবৃত্তের সামনে তুচ্ছ। তিনি এই পৃথিবীকে এক ভীষণ মানবকেন্দ্রিক (anthropomorphic) মায়ার জগৎ হিসেবে দেখেন—যেখানে মানুষ বিশ্বাস করে প্রাণী, উদ্ভিদ, পাথর বা নদীরও নির্দিষ্ট স্থান ও ভূমিকা আছে, অথচ বাস্তবে প্রকৃতি আমাদের কোনো বিশেষ মর্যাদা দেয়নি। আমরা কেবল নিজেদের গুরুত্ব আরোপ করেছি এক অহংকারে ভরা কল্পিত মহাবিশ্বে।
তাঁর কাছে, সাহিত্যও এই প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতার অংশ এবং তাঁর বিশ্বাস, কিছু কাল্পনিক চরিত্র বাস্তবের চেয়েও বেশি বাস্তব। দস্তয়েভস্কির মিশকিনের (Myshkin) মতো চরিত্র, তাঁর মতে, অস্তিত্ব রাখে এক ধরনের “স্বর্গীয় স্থানে”—যেখানে মানুষের কল্পনা ও মহাজাগতিক সত্য এক হয়ে যায়। লাসলো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, এই “চিরন্তন কল্পনার চরিত্র” আসলে সাধারণ মানুষদের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে; সেখান থেকেই তারা উঠে আসে, এক রহস্যময় ও গোপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
এই ধারণার একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা তাঁর নিজের জীবনেই ঘটেছিল। স্যাটানটাঙ্গো লেখার পর একদিন তিনি হঠাৎ এক বারে বসে দেখেন—তাঁর উপন্যাসের চরিত্র হালিস (Halics) যেন বাস্তব রূপে তাঁর সামনে উপস্থিত। সেই মুহূর্তে তিনি গভীরভাবে বিচলিত হন, যেন তাঁর কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে থাকা সীমানা একদম বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে লেখক হিসেবে সতর্ক করে তোলে। পরে, War and War-এর প্রথম খসড়া লেখার সময় তিনি চরিত্র কোরিনকে আত্মবিধ্বংসের দিকে যেতে দেখে ভয় পান। যেন কোরিন যদি বাস্তবে আবির্ভূত হয়, তবে তিনি তাকে রক্ষা করতে পারবেন না। তাই তিনি উপন্যাসটির কাঠামোই বদলে দেন। লেখা ও বাস্তবতার সীমারেখা যেন একে অপরকে ধ্বংস না করে। এই ভয় এবং বিশ্বাসের দ্বন্দ্বই লাসলোর সাহিত্যকে অনন্য করে তুলেছে। যেখানে চরিত্ররা লেখকের কাছ থেকে স্বাধীনতা দাবি করে, আর লেখক নিজেই কখনো নিশ্চিত হতে পারেন না, ঠিক কে কাকে সৃষ্টি করছে।
লাসলোর উপন্যাসের কাঠামো যতই জটিল ও মানবকেন্দ্রিক হোক না কেন, তিনি নিজে এক গভীর অস্তিত্ববাদী দ্বন্দ্বের মধ্যে অবস্থান করেন। তাঁর স্বীকারোক্তি: যদি তাঁকে একদিন বেছে নিতে হয় ‘কাঠামোবিহীন মহাবিশ্ব’ ও ‘কাঠামোবদ্ধ মানবজাতি’-র মধ্যে, তবে তিনি নিঃসন্দেহে মানবজাতিকেই বেছে নেবেন। কারণ তাঁর কাছে মানুষই একমাত্র সত্তা, যে বিশৃঙ্খলার মাঝেও অর্থ তৈরি করতে চায়, ভাষা ও চিন্তার মাধ্যমে মহাবিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করে।
তবে এই বিশ্বাসের ভিতরেও তিনি দেখতে পান এক গভীর বিভ্রম। লাসলো মনে করেন মানব সংস্কৃতির মূল শিকড়টি আসলে মিথ্যা—এক মহৎ কিন্তু ভুল ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা নির্মাণ। তাঁর ভাষায়, সংস্কৃতি হলো “ভুল বোঝাবুঝির বিশাল কাঠামো”, যেখানে অর্থের জন্ম ঘটে এক অন্তহীন ভুল পাঠ ও ভুলবোঝার ধারাবাহিকতা থেকে। মানুষ ইতিহাস জুড়ে জ্ঞান, নৈতিকতা ও সত্যের নামে এক বিভ্রান্ত মহল তৈরি করেছে, যেখানে প্রতিটি স্তর আগের ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তবু সেই ভুলই আমাদের সভ্যতার স্থিতি নিশ্চিত করে।
এই দর্শন তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনের কেন্দ্রেও প্রতিফলিত। লাসলো বহুবার বলেছেন, তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল কেবল “একটি বই” লেখা—একটি পূর্ণাঙ্গ, সর্বব্যাপী, এবং চূড়ান্ত গ্রন্থ। কিন্তু প্রথম বই স্যাটানটাঙ্গো শেষ হওয়ার পর তিনি বুঝলেন, সেটি যথেষ্ট নয়। তাই লিখলেন The Melancholy of Resistance, তারপর War and War, এবং অবশেষে Baron Wenckheim’s Homecoming। তাঁর বিশ্বাস, এই চারটি উপন্যাস আসলে একটি বৃহৎ গ্রন্থের পরস্পর সংযুক্ত অধ্যায়—একই আত্মিক ও ন্যারেটিভ অনুসন্ধানের বিভিন্ন রূপ।
এইভাবে, Baron Wenckheim’s Homecoming লাসলোর জন্য কেবল এক উপন্যাস নয়, বরং এক চূড়ান্ত ঘোষণা, যে তিনি সত্যিই তাঁর জীবনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। তিনি শুধু “একটি বই” লিখেছেন, কিন্তু সেই একটিই বই অসংখ্য মহাবিশ্বের প্রতিধ্বনি বহন করে।
লাসলোর দীর্ঘ, ঢেউতোলা বাক্যরীতি কোনো সচেতন কৌশল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়নি। এটি এসেছে অন্যকে বোঝানোর এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে—যেখানে পূর্ণচ্ছেদের চেয়ে জরুরি হয়ে ওঠে শ্বাসের দৈর্ঘ্য, তাল, আর সুর। তাই বাক্যগুলো থেমে না থেকে এগোয়—উপবাক্য থেকে উপবাক্যে, যেন ভেজা রাস্তায় ধীরে চলা ট্রাম—চিহ্ন নয়, ছন্দই যাকে টেনে নেয়।
লেখা, তাঁর বিশ্বাসে, একধরনের শাস্ত্র—ritual। শব্দের পর শব্দ, বাক্যের পর বাক্য পুনরাবৃত্তি করে লেখক এমন এক কাজ করেন যেখানে তাঁকে একসঙ্গে থাকতে হয় দুই জায়গায়: জগতের ভেতরে এবং লেখার প্রক্রিয়ার ভেতরে। এই দ্বৈত অবস্থানই লেখাকে অর্থ দেয়—পাঠক তৈরি হওয়া ফর্ম ও তার অপরিহার্যতা চিনে নেয়; ফলে এই ক্ষুদ্র স্থানটি অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে, যদিও উঁচু কোনো বিমূর্ত স্তর থেকে দেখলে পুরো ব্যাপারটাই পরম মূর্খতা বলে মনে হতে পারে।
সঙ্গীত তাঁর লেখার ভিত। চৌদ্দ থেকে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত তিনি পেশাদার সংগীতজ্ঞ ছিলেন, জ্যাজ ব্যান্ডে পিয়ানো বাজাতেন; থেলোনিয়াস মঙ্ক তাঁর প্রিয় পিয়ানোবাদক। তবু আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল বারোক, বিশেষ করে বাখ—যেখানে স্থাপত্যের মতো টেম্পো আর কাউন্টারপয়েন্ট কাজ করে। তাঁর মনে হয়, রোমান্টিক যুগ পার হওয়ার পর সঙ্গীত ক্রমে অশালীনতার দিকে নেমে গেছে, যা ইতিহাসের এক অবনমনরেখা।
এই কারণেই তিনি সাহিত্য আর সঙ্গীতের সাধারণ ভিত্তি খুঁজে পান ছন্দ ও টেম্পোর কাঠামোয়। ছবি বা কাহিনি নয়, তাল থেকেই তিনি শুরু করেন; বাক্য গড়েন নীরব মাত্রা গুনে—যেন নোটেশনের ওপর লেখা, যেখানে অর্থ আসলে সময়ের ভিতরেই তৈরি হয়। লাসলোর কাছে শিল্পীর প্রকৃত কাজ কোনো মহৎ বার্তা দেওয়া নয়, বরং একটি নিরবচ্ছিন্ন শাস্ত্র—এক ritual—যা সম্পূর্ণভাবে pure technique-এর ওপর নির্ভরশীল। তাঁর ভাষায়, একজন শিল্পীর একমাত্র কর্তব্য হলো এই আচারের ধারা বজায় রাখা, যেন সে নিজেকে ভুলে কেবল কৌশলের নিবিড়তায় বিলীন হয়ে যায়।
এই ধারণা বোঝাতে তিনি প্রায়ই বাখের উদাহরণ দেন। বাখ যখন তাঁর cantata লিখতেন, তখন তিনি ভাবতেন না ঈশ্বর, নৈতিকতা বা মহত্ত্ব নিয়ে; তাঁর সমস্ত মনোযোগ থাকত বাদ্যযন্ত্রের প্রশ্নে—কীভাবে ফিউগের গঠন তৈরি হবে, কীভাবে প্রিলিউডের মধ্যে সুরের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কোথায় থেমে কোথায় আবার শুরু হবে। এই নিখাদ কারিগরি মনোযোগই, লাসলোর মতে, এক প্রতিভাবান স্রষ্টার প্রকৃত ধর্ম। প্রতিভা মানে সেই ব্যক্তি, যিনি ভাবের নয়, কৌশলের গভীরে নিমজ্জিত।
তাঁর জন্য ক্ষুদ্রতম বিবরণই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ—এমনকি জীবন ও মৃত্যুর প্রশ্ন পর্যন্ত। একটি বাক্যের মধ্যে যদি ছন্দের সামান্য ভুল থেকে যায়, তা তাঁকে “হত্যা করে ফেলে”—এই শব্দটাই তিনি ব্যবহার করেন। কারণ তাঁর কাছে একটি বাক্যের ভেতরের তাল, বিরাম, শব্দবিন্যাস—সবই এক অদৃশ্য স্থাপত্যের অংশ, যেখানে একটিমাত্র ফাটল গোটা গঠনকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
তিনি বিশ্বাস করেন, সামগ্রিকতা ও সূক্ষ্মতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যেমন সমুদ্র ও তার এক ফোঁটা জলের মধ্যে মৌলিক কোনো বিভেদ নেই—উভয়েই একই সত্তার প্রতিফলন। তাঁর লেখায় এই বিশ্বাসই প্রতিফলিত হয়: প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ যেন সম্পূর্ণ মহাবিশ্বের অনুরণন বহন করে, যেখানে ক্ষুদ্রতম ভুলও এক ধরনের নৈতিক ব্যর্থতা।
লাসলো ‘অসীমতা’ ধারণার তীব্র বিরোধী। তাঁর কাছে এটি এক দার্শনিক ভ্রম। মানুষের তৈরি এক মিথ্যা বিমূর্ততা, যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তিনি প্রায়ই উল্লেখ করেন, বুদ্ধও কখনো “সমগ্রতা” (wholeness) নিয়ে কথা বলার অনুমতি দেননি, কারণ এমন কোনো ধারণা বাস্তবে বিদ্যমান নয়। তাঁর যুক্তি অত্যন্ত সহজ কিন্তু গভীর: যদি সত্যিই বিশ্ব অসীম হতো, তবে এই টেবিলে রাখা এক কাপ চায়ের মতো পরিমাপযোগ্য বস্তুর অস্তিত্বই সম্ভব হতো না। অসীমতার ভেতরে কোনো সীমিত বস্তু টিকে থাকতে পারে না, কারণ সীমা স্বয়ং তখন বিলুপ্ত হয়ে যায়।
তাঁর মতে, বাস্তবতা গঠিত “অগণিত সসীম” থেকে—অর্থাৎ অসীম নয়, বরং অসংখ্য সীমিত সত্তার সম্মিলনে। এটি যেন এমন এক মহাবিশ্ব, যেখানে প্রতিটি বিন্দু পৃথক অথচ পরস্পর সংযুক্ত, অগণন হলেও অনন্ত নয়। এই ধারণার প্রতিফলন দেখা যায় স্যাটানটাঙ্গো-এর গঠনে। উপন্যাসটির শেষে যখন গল্পটি এমনভাবে ঘুরে আসে যে মনে হয় বইটি আবার শুরু হতে চলেছে, পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি এটি এক অসীম চক্র? লাসলো এর উত্তরে বুদ্ধের একটি উক্তি স্মরণ করিয়ে দেন: “যদি আপনি একটি বৃত্ত অনুসরণ করেন, কিছু সময় পরে আপনি বুঝবেন—একটি বৃত্তের অস্তিত্বই নেই।” অর্থাৎ, তাঁর দৃষ্টিতে এই পুনরাবৃত্তি অসীমতার প্রতীক নয়, বরং এর মায়ার অপসারণ। জীবন ও সাহিত্য উভয়ই তাঁর কাছে চক্র নয়, বরং অনন্ত সীমাবদ্ধতার ধারাবাহিকতা—যেখানে ফেরা মানে নতুন করে শুরু, কিন্তু কখনোই পূর্ণতা নয়।
লাসলো তাঁর Baron Wenckheim’s Homecoming উপন্যাসটিকে নিজ জীবনের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে রসাত্মক কাজ বলে মনে করেন। কিন্তু এই উপন্যাসে কোনো অ্যাপোক্যালিপটিক ভবিষ্যদ্বাণী নেই। বরং তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, “অ্যাপোক্যালিপস ইতিমধ্যেই এসে গেছে।” তাঁর কাছে পৃথিবীর পতন কোনো আগত ঘটনা নয়; এটি এখনই ঘটছে—মানবতার উদাসীনতা, প্রযুক্তিগত নৈরাজ্য, এবং নৈতিক ক্লান্তির মাধ্যমে। তাই এই উপন্যাসকে তিনি শেষ ঘোষণা হিসেবে দেখেন। তিনি একাধারে লিখেছেন ছোট আকারের রচনা, যেমন The Manhattan Project (একটি দার্শনিক ভূমিকা), Spadework for a Palace (নিউ ইয়র্ককে কেন্দ্র করে রচিত), এবং হোমারের Odyssey-প্রেরিত একটি সংক্ষিপ্ত নভেলা। এই ক্ষুদ্র রচনাগুলিতে তিনি ফর্মের মুক্তি ও ভাষার ঘনত্বকে আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছেন—যেন প্রতিটি বাক্যই এক ধরণের মন্ত্র, যা পাঠককে বাস্তবতার অন্তরাল স্পর্শ করায়।
লাসলোর বিশ্বাস, ভাষা এবং শব্দই একমাত্র মাধ্যম যা আমাদের “লুকানো বাস্তবতা”-র কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে। বাস্তব ও কল্পনার এই দুই সাম্রাজ্যে তিনি উভয়ের নাগরিক। তাঁর লেখালেখি সাহিত্যিক সমাজে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্য নয়, বরং একান্ত ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের অংশ। তিনি কখনোই কোনো সাহিত্যিক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হতে চাননি, কারণ তাঁর কাছে লেখালেখি সামাজিক নয়—আধ্যাত্মিক অভ্যাস।
রাজনৈতিকভাবে, তিনি দেখেছেন পূর্ব ইউরোপে বুদ্ধিবৃত্তিক পশ্চাৎপদতার এক প্রবল ঢেউ, যাকে তিনি বলেন “আক্রমণাত্মক মূর্খতা।” এই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাঁকে যে মুক্ত চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে, তার প্রতি তিনি গভীর কৃতজ্ঞ। তাই তিনি জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন—রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য নয়, বরং এমন এক সাংস্কৃতিক পরিসরের জন্য, যেখানে চিন্তা এখনো স্বাধীনভাবে শ্বাস নিতে পারে।
অবশেষে, ২০২৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করে লাসলো ক্রাসনাহোরকাই যেন সেই দীর্ঘ আচারটির পূর্ণতা স্পর্শ করলেন, যা তিনি সারা জীবন ধরে একাগ্রতায় পালন করে এসেছেন। তাঁর ভাষা, যা একই সঙ্গে তপস্যা ও সুর, তাঁর বাক্য, যা এক অনন্ত প্রবাহের মতো নিজস্ব মহাবিশ্ব তৈরি করে, আজ স্বীকৃতি পেল সেই নীরব তীব্রতায় যার জন্য তিনি বরাবরই একা ছিলেন। লাসলোর নোবেল যেন কেবল তাঁর ব্যক্তিগত জয় নয়, বরং সেই সমস্ত নিঃশব্দ লেখকদের প্রতি শ্রদ্ধা, যারা শব্দকে এখনো বিশ্বাস করেন, যারা জানেন অন্ধকারের মধ্যেও একটি বাক্যের ছন্দ, একটি সঠিক শব্দ, আমাদের অস্তিত্বকে আলোকিত করে তুলতে পারে। তাঁর এই স্বীকৃতি প্রমাণ করে, সাহিত্যের মহাবিশ্বে এখনো গভীর চিন্তা, ধীর গতি, এবং নিঃসঙ্গ অনুসন্ধানই প্রকৃত প্রতিরোধের ভাষা।
এবছরের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই সম্পর্কে অনেককিছু জানা হলো। বিশদে তাঁর সাহিত্যচিন্তা-আত্মদর্শন নিয়ে লেখার জন্য লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।