দ্য নোবেল গোজ টু লাসলো ক্রাসনাহোরকাই
লিটারেচারের ২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন হাঙ্গেরীয় লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই— “তার মনোমুগ্ধকর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাহিত্যকর্মের জন্য, যা মহাপ্রলয়ের আতঙ্কের মাঝেও শিল্পের ক্ষমতাকে পুনরায় প্রতিষ্
লিটারেচারের ২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন হাঙ্গেরীয় লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। “তার মনোমুগ্ধকর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাহিত্যকর্মের জন্য, যা মহাপ্রলয়ের আতঙ্কের মাঝেও শিল্পের ক্ষমতাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।”
রিটন খান
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই—হাঙ্গেরীয় এক ধ্যানমগ্ন ভবঘুরে, যিনি উপন্যাসের ভেতরে গির্জা বানান, আবার সেই গির্জার ঘণ্টা বাজলেই পৃথিবীটা খানিক কেঁপে ওঠে। তাঁর বই খুললেই বোঝা যায় এক মহাজাগতিক বাক্যের নিঃশেষ প্রতিধ্বনি। ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার ভেতর দিয়ে হাঁটলে মনে হয় আপনি এক অনন্ত বাক্যের জঙ্গলে ঢুকেছেন—যেখানে দাড়ি নেই, শ্বাস নেই, আছে শুধু প্রবাহমান বাক্য। তিনি মনে করেন, বাক্য শেষ করা মানেই চিন্তা শেষ করা। তাই তাঁর গদ্য প্রবাহিত, যেন এক নদী নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে গহ্বর তৈরি করছে। তিনি বলেন, “আমি লেখক নই, আমি লিখিয়ে নেওয়া মানুষ”—ডাউনরাইটার যাকে বলে। বাক্যগুলো তাঁর নয়, বরং তাঁর চরিত্রগুলোর—ইরিমিয়াস, পেট্রিনা, মিসেস হালিচ—যারা অন্য জগত থেকে শব্দ ধার করে এই বাস্তবের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
তাঁর লেখার প্রক্রিয়াও অদ্ভুতরকম পাগলামিতে ভরপুর। পুরো অধ্যায় মাথায় তৈরি করেন, মুখস্থ রাখেন, তারপর লিখে ফেলেন এক নিঃশ্বাসে। তাঁর জন্য শব্দের সুর ও গতি (tempo) এতটাই জরুরি যে তিনি চান, লেখাকে পড়তে হবে উচ্চস্বরে—যেন বাক্যটিও তার ফুসফুস খুঁজে পায়। তবু, আশ্চর্যভাবে, তিনি নিজের প্রতিটি কাজকে ব্যর্থ বলে মনে করেন। Sátántangó লিখে ভেবেছিলেন, এটাই শেষ; পরে আবার সেটাই পড়ে জানলেন—ব্যর্থ। সেই ব্যর্থতার সঙ্গে তাঁর এক অদ্ভুত প্রেম। তিনি বলেন, “আমি লেখার যোগ্য নই, কিন্তু না লিখে থাকতে পারি না।” হয়তো এটাই আধুনিকতার শুদ্ধতম আধ্যাত্মিক সাধনা।
১৯৫৪ সালে জিউলাতে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি প্রথমে আইন পড়েছিলেন, পরে হাঙ্গেরিয়ান লোককাহিনিতে ডিগ্রি। সিনেমাপ্রেমীরা তাঁকে চিনবেন বেলা টারের সহযাত্রী হিসেবে—যেখানে Werckmeister Harmonies বা The Turin Horse দেখে মনে হয়, দস্তয়েভস্কি, কাফকা আর হের্জগ একই টেবিলে বসে স্যুপ খাচ্ছেন।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভাষা কখনো বিষণ্ণ, কখনো ধর্মীয়, আবার কখনো শিশুর মতো চমকপ্রদ। তিনি বিশ্বাস করেন, আমরা এমন এক কৃত্রিম যুগে বাস করছি যেখানে মানুষ প্রাকৃতিক প্রাণী হওয়ার গুণটাই হারাচ্ছে। তাঁর মতে, নরক ও স্বর্গ—দুটোই এই পৃথিবীতেই রয়েছে; পার্থক্য শুধু, কে কোথায় অবস্থান করছে তা আমরা ভুলে গেছি। জীবন তাঁর কাছে “এক আশ্চর্য জাদু”—যেখানে একমাত্র শুদ্ধ অনুভূতি হলো কৃতজ্ঞতা।
রাজনৈতিক ভাবনায় তিনি যুগের শ্বাসরুদ্ধ অন্ধকারে বড় হয়েছেন। কমিউনিজমের ভেতর থাকা দরিদ্রদের জন্য তাঁর সহানুভূতি ছিল আগুনের মতো। এখন তিনি বলেন, তারা দরিদ্র নয়, “দুর্দশাগ্রস্ত”—কারণ সংস্কৃতি হারিয়েছে, টেলিভিশন হয়ে গেছে তাদের একমাত্র ধর্মগ্রন্থ।
নিজেকে “অভিজাত লেখক” বলেন, কিন্তু সেই অভিজাত্য ডন কিহোতের ধাঁচের, যেখানে সৌন্দর্যকে রক্ষা করাই পাগলামি। তাঁর চোখে আজকের যুগে মানসম্পন্ন সংস্কৃতি বিলুপ্ত, হোমার এখন কমিক বই, ভ্যান গগ ফ্রিজ ম্যাগনেটে।
প্রযুক্তি নিয়ে তাঁর উদ্বেগও দার্শনিক। ইন্টারনেট মানুষকে শেখায় না, ভুলিয়ে দেয়। তিনি বলেন, আজকের প্রজন্মের মনোযোগ ৮ সেকেন্ড—একটি গোল্ড ফিসের চেয়েও কম। এআই নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তিত নন, কিন্তু ভয় পান সেই মানুষটিকে, যিনি একে ব্যবহার করবে—কারণ মানুষ বোকা, আর ভয়-নির্ভর। তাঁর মতে, মানুষ এমন কিছু তৈরি করেছে, যেটি ব্যবহারের যোগ্যতা তাদের গড়ে ওঠে নি।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যতটা অন্তর্মুখী, ততটাই জটিল। নিজেকে “tyrannical” বলেন। তাঁর সঙ্গে থাকতে হলে মানতে হবে তাঁর নিয়ম। তাঁর তিন কন্যা—একজন শিল্প ইতিহাসবিদ, একজন অভিনেত্রী, একজন বিপ্লবী।
তিনি মনে করেন এই সভ্যতা টিকে থাকবে না, কিন্তু মানুষ আবার নতুন সভ্যতা গড়বে। লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভাষা তাই কোনো ভাষা নয়, এ এক নৈঃশব্দ্যের সঙ্গীত, যেখানে ব্যর্থতা, একাকিত্ব, আর কৃতজ্ঞতা একসাথে দাঁড়িয়ে আছে—যেন এক অন্ধকার ঘরে বাজছে এক অপূর্ব, অন্তহীন বাক্য।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের উল্লেখযোগ্য বইগুলো:
The Melancholy of Resistance
Satantango
War & War
Seiobo There Below
Baron Wenckheim’s Homecoming
Animalinside