শৈশবের লেটার গেম
আমরা লাইব্রেরির দিকে রওনা দিতাম। লাইব্রেরির বিশাল তাকগুলো যেন একেকটা রহস্যের দরজা। আমরা সেই অক্ষরের নামে শুরু হওয়া একটি বই খুঁজে বের করতাম।
অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করে, "তুমি এত বই পড়লে কীভাবে? এত বইয়ের প্রতি ভালোবাসা কীভাবে জন্মালো?" এই প্রশ্নের উত্তর আসলে আমার শৈশবের এক সাধারণ কিন্তু মজার অভ্যাসে লুকিয়ে আছে। একটা ছোট্ট খেলা, যা আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলতাম, সেটাই আমাকে বইয়ের জগতে ডুবিয়ে দিয়েছিল। সেই অভ্যাসই বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা এবং নতুন কিছু জানার কৌতূহল তৈরি করেছে। আজ সেই ছোট্ট খেলার গল্প শেয়ার করি।
যখন আমি ছোট, স্কুল বন্ধ হলে জীবন যেন থমকে যেত। সেই সময়গুলোতে একঘেয়েমি আমাকে গ্রাস করত, এবং আমি খুব অস্থির বোধ করতাম। তখন আমারা একটা মজার খেলা খেলতাম—ফোন তুলে বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করতাম,
"তোর হাতে একটু সময় আছে? বাইরে দেখা কর দশ মিনিটের মধ্যে।"
আমার কথা শুনে বন্ধুরা কিছুটা অবাক হয়ে যেত, কিন্তু কেউ না কেউ সাড়া দিতোই। দেখা করার পর তাদের বলতাম,
"একটা অক্ষর বল তো।"
বন্ধুরা বেশিরভাগ সময়েই দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলত,
"মানে কী? কী অক্ষর?"
"কোনো একটা অক্ষর বেছে নে। যেকোনো অক্ষর।"
তারা হয়তো একটু বিরক্ত হয়ে, কৌতূহল নিয়ে বলত,
"আচ্ছা... ধর ‘ফ’।"
আর এরপরই শুরু হতো আমাদের ছোট্ট অ্যাডভেঞ্চার।
আমরা লাইব্রেরির দিকে রওনা দিতাম। লাইব্রেরির বিশাল তাকগুলো যেন একেকটা রহস্যের দরজা। আমরা সেই অক্ষরের নামে শুরু হওয়া একটি বই খুঁজে বের করতাম। তারপর সেই বইয়ের কোনো একটি অধ্যায় যা আবার সেই একই অক্ষর দিয়ে শুরু নিয়ে পড়া শুরু করতাম। কী পড়ব, কী শিখব—সবটাই নির্ভর করত আমাদের মুড আর কৌতূহলের ওপর। মজার বিষয় হলো, এতে শুধু বইয়ের নতুন অধ্যায় বা গল্পের সাথে পরিচিত হতাম না, বরং বন্ধুদের সম্পর্কেও নতুন কিছু শিখতাম। এই সাদামাটা খেলাটি আমাদের ছোট জীবনকে রঙিন করে তুলতো।
এই খেলা আমাকে শিখিয়েছে যে জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে বৈচিত্র্যই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। বৈচিত্র্য মানে নতুন কিছু করা, অপ্রত্যাশিত কিছু চেষ্টা করা। আমি অনুভব করেছি, জীবন যখন থমকে যায়, তখন সামান্য পরিবর্তনও বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন, চায়ের বদলে কফি একধরনের বৈচিত্র্য হতে পারে, কিন্তু আমার এই 'লেটার গেম' ছিল এক ধাপ বড়—একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আবিষ্কারের সুযোগ।
এটি শুধু মজার জন্য ছিল না; এটি ছিল শেখার, অনুভব করার, এবং নিজেকে ও অন্যকে নতুন করে চিনে নেওয়ার একটি মাধ্যম। প্রতিটি বইয়ের পৃষ্ঠা যেন একেকটি জানালা খুলে দিত, যা আমাদের মনের স্থবিরতাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে তুলত।
সবচেয়ে ভালো লাগত বন্ধুর সাথে সময় কাটানো। তাদের পছন্দ, অভ্যাস, আর চিন্তার ধারা এতটা গভীরভাবে বুঝতে পারতাম, যা অন্য কোনো পরিস্থিতিতে সম্ভব হতো না। যখন তারা অক্ষর বেছে নিত, আমি তাদের সেই পছন্দের মধ্যেই একটা গল্প খুঁজে পেতাম। হয়তো আমরা একই বইয়ের ভিন্ন অধ্যায়ে আটকে যেতাম, কিংবা একেবারেই ভিন্ন কিছু খুঁজে বের করতাম।
যখন কেউ অক্ষর 'ক্ষ' বা 'ঙ’ বেছে নিত, তখন বেশ খানিকটা সময় লাইব্রেরির তাক ঘাঁটতে হতো। সেই সময়টা যতটা বিরক্তিকর মনে হতো, ততটাই স্মরণীয় হয়ে থাকত। আমরা দুজনেই হাসতে হাসতে সেই 'অভিযান' চালাতাম, যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো গুপ্তধন খুঁজছি।
আজ এত বছর পর, আমি যখন এই অভিজ্ঞতার কথা ভাবি, বুঝতে পারি এটি শুধু আমার শৈশবের কোন খেলা ছিল না। এটি ছিল জীবনের এক ঘোরানো আয়না, যা আমাকে শিখিয়েছে কৌতূহলী হতে। এটি আমাকে শিখিয়েছে যে একঘেয়েমি কাটানোর জন্য বড় কোনো পরিবর্তনের দরকার নেই। জীবনের সাদামাটা মুহূর্তগুলোকে কেবল একটু নতুন করে দেখা প্রয়োজন।
তাই যখন কোনো দিন একঘেয়েমি বা অস্থিরতায় ভুগি, আমি নিজেকে মনে করাই—একটি অক্ষর বেছে নিতে। কারণ জীবনের সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার কখনো কখনো সবচেয়ে ছোট খেলার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে।