এক বালতি বরফজল
Lower than the Angels বইটির আসল সৌন্দর্য, সোজাসাপ্টা বললে, গন্ডারের চামড়ার মতো মোটা একগাদা ধর্মীয় দ্বিচারিতাকে একসঙ্গে এক চড় মেরে ফাঁস করে দেওয়া। আর এই চড় এতই কড়া যে, হাজার বছরের পুরু প্রলেপও হয
এক বালতি বরফজল
ফড়িংয়ের ডানার নিচে পিঁপড়ে হলে যা হয়!
Lower than the Angels বইটির আসল সৌন্দর্য, সোজাসাপ্টা বললে, গন্ডারের চামড়ার মতো মোটা একগাদা ধর্মীয় দ্বিচারিতাকে একসঙ্গে এক চড় মেরে ফাঁস করে দেওয়া। আর এই চড় এতই কড়া যে, হাজার বছরের পুরু প্রলেপও হয়তো টেকার ক্ষমতা রাখবে না।
খ্রিস্টীয় নৈতিকতার প্রভুত্ব কীভাবে মানুষের যৌনতা নিয়ে এমন এক মহাভারতীয় জটিলতা সৃষ্টি করল, সেটার একটা সুনিপুণ ব্যাখ্যা আছে এখানে। ভাবুন, পঞ্চম শতকের এক নির্জন সন্ন্যাসী, যে নিজের কামনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে পকেট-স্নেককে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করল। কারণ, তখনকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে আত্মনিয়ন্ত্রণের নামে শারীরিক অত্যাচার করাটাই ছিল ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ। এই আত্মনিয়ন্ত্রণের আদর্শই পরে রাশিয়ান স্কোপসি সম্প্রদায়কে নিয়ে গেল আত্মবিচ্ছেদের চূড়ান্ত পর্যায়ে—গোটা পুরুষাঙ্গটাই বাদ দিয়ে ফেলা।
ম্যাককালক খুব ধৈর্য ধরে ব্যাখ্যা করেন, বাইবেলকে যারা যৌন নৈতিকতার একমাত্র সংজ্ঞা বলে দাবি করে, তারা ভুল করছে। কারণ, বাইবেল একক কোনো বই নয়, বরং একটা বিরাট লাইব্রেরি, যেখানে পরস্পরবিরোধী গল্প আর নিয়মকানুনের ছড়াছড়ি। যেমন, সমকামিতার বিরুদ্ধে যে প্রসিদ্ধ লেভিটিকাল নিষেধাজ্ঞা, সেটাও মূলত বিবাহিত পুরুষদের জন্য ছিল—ধর্মীয় বিবাহের চৌহদ্দিতে যৌনতা ধরে রাখার জন্য। কিন্তু সেই একই বাইবেলে ডেভিড-জনাথনের গভীর ভালোবাসার কাহিনি আছে, যা অনুবাদকেরা যুগে যুগে এমনভাবে পেঁচিয়ে দিয়েছেন যেন সেটা কেবল ‘ভাই-ভাই’ বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
যৌনতার বিরুদ্ধে খ্রিস্টধর্মের এই ক্রমবর্ধমান যুদ্ধের কারণ একটাই—ক্ষমতা। মানুষ যদি প্রেম-ভালোবাসায় ডুবে থাকে, তাহলে তারা ধর্মীয় শৃঙ্খলার প্রতি অতটা মাথা ঘামাবে না। তাই প্রেমকে দমন করতে হবে, কামনাকে জয় করতে হবে, আর সাধুদের কামজয়ের গল্পগুলোকে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে হবে। এই প্রচারেরই এক কমেডিক ফল হল সেই আইরিশ ভদ্রলোক, যিনি তাঁর সাধুতার প্রমাণ দিতে ‘দুই সুডৌল স্তনবিশিষ্ট’ কুমারীর সঙ্গে একই বিছানায় রাত কাটালেন। এবং যখন ব্রেন্ডান সন্দেহ করলেন, তখন কুমারীরা অলৌকিকভাবে গরম কয়লা হাতে তুলে নিল, যা কোনোভাবেই তাদের পোশাক পোড়ালো না—একটি বাইবেলীয় অলংকার মাত্র।
যীশু কিন্তু যৌনতা নিয়ে বিশেষ কিছু বলেননি। এই তথ্য মধ্যযুগীয় সমকামিতা বিরোধী আইনপ্রণেতাদের বেশ হতাশ করেছিল। তাই তারা চটজলদি একটা ‘চমৎকার’ গল্প বানিয়ে দিল—যীশুর জন্মের সময় সমস্ত সমকামী মারা গিয়েছিল! কারণ, এমন পাপী পৃথিবীতে খ্রিস্টের আবির্ভাব হতে পারে না। ফ্রান্সিসকান ও ডোমিনিকান ধর্মগুরুরা এই মিথটা প্রচার করলেন, জন মির্কের মতো মধ্যযুগীয় ধর্মপ্রচারকেরা সেটা কনফার্ম করলেন।
নারীদের বিষয়ে চার্চের অবস্থান আরও সাংঘাতিক। প্রাথমিকভাবে খ্রিস্টধর্ম নারীদের ক্ষমতায়ন করেছিল, কিন্তু পরে পুরুষতান্ত্রিক গোঁড়ামি সব ছিনিয়ে নিল। ব্যস, নাম পাল্টে দিয়ে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হল জুনিয়াকে, যিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ধর্মপ্রচারক। বিধবাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য তৃতীয় শতকের সিরীয় শাস্ত্র নির্দেশ দিল—বিধবারা যেন ঘরে বসে থাকে, বেশি নড়াচড়া না করে, কারণ “ঈশ্বরের বেদি তো আর এদিক-ওদিক ঘোরে না”!
খ্রিস্টধর্মের এই পিউরিটানিক শাসন জারি রাখার পিছনে অন্যতম হাতিয়ার ছিল বিয়ে। তবে, এখানেও চরম বিভ্রান্তি। বিয়ে কী আদৌ ভালো কিছু? জেরোমের মতো কেউ কেউ বললেন, একজন পুরুষ যদি নিজের স্ত্রীকে ‘অতিরিক্ত ভালোবাসে’ তবে সেটাও পরকীয়ার সমান! (omg) ক্যাথলিক চার্চ দ্বাদশ শতকে পুরোহিতদের বিবাহ নিষিদ্ধ করল, আর প্রোটেস্ট্যান্টরা সেটাকে আবার ফিরিয়ে আনল। ম্যাককালক ইঙ্গিত দেন, প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের অন্যতম বড় প্রভাব হয়তো ‘ক্লেরিক্যাল ম্যারেজ’—খ্রিস্টীয় মুক্তির ধারণার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ!
যুদ্ধ শেষে আশার আলোও আছে। ১২ শতকের আবেলার্দ, যিনি স্ত্রীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন, বলপূর্বক নির্বীজিত হওয়া সহ্য করলেন, কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করেছিলেন যে—শরীরের আনন্দকে পাপ হিসেবে দেখা উচিত নয়! এরকম কত প্রেম-ভালোবাসার গল্প, সামন্ততান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা সাধু-সন্ন্যাসীদের গল্প এই বইতে রয়েছে।
কিন্তু, লেখকের পুরুষতান্ত্রিক চশমা মাঝেমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মহিলাদের অভিজ্ঞতা এখানে অগোচর থেকে যায়। গর্ভধারণ, সন্তান জন্মদান—যা মহিলাদের যৌনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ, তার ছিটেফোঁটাও নেই। যেন যৌনতা মানেই শুধুই পুরুষদের ভোগান্তির ইতিহাস।
আর শেষমেশ, খ্রিস্টধর্ম আজ কোথায়? একদা নৈতিকতার উচ্চাসনে বসা এই ধর্ম এখন প্রান্তিক মানুষদের অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। পুতিনের রাশিয়ায় গির্জা ‘TRADITIONAL VALUES’-এর ধ্বজাধারী হয়ে উঠেছে, গৃহহিংসা বৈধ হয়েছে, LGBTQ+ জনগোষ্ঠী নির্যাতিত হচ্ছে। এবং চার্চ ক্রমাগত তার ‘সনাতন মূল্যবোধ’ ধরে রাখার জন্য প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।
ম্যাককালকের মূল বক্তব্য, ধর্মের চিরাচরিত যৌননৈতিকতা আসলে একটা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা মাত্র। কিন্তু মানুষ সেই শৃঙ্খলা মানেনি, নিজেদের মতো করে প্রেমে পড়েছে, যৌনতা উপভোগ করেছে, বিদ্রোহ করেছে। এবং এই প্রতিরোধই হয়তো আগামী হাজার বছরে খ্রিস্টধর্মকে আবার নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে।
কিন্তু সত্যি কি ধর্মকে আবার নতুনভাবে শুরু করা সম্ভব? ম্যাককালকের ব্যঙ্গমিশ্রিত বিশ্লেষণের পর, প্রশ্নটা কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, বরং অস্তিত্বের। হয়তো, উত্তরটা খুঁজতে আমাদের আবার সেই পুরনো বাণীর কাছেই ফিরতে হবে—‘তোমরা কি শাস্ত্রও বোঝ না, ঈশ্বরের শক্তিও বোঝ না?’
Lower than the Angels: A History of Sex and Christianity by Diarmaid MacCulloch.
Allen Lane, 660 pp., £35, September 2024