জেনেছি তাঁকে: বাখতিন ও জীবনের বহুস্বরিক কাব্য
বাখতিন সাহেব কি বলেছিলেন? “জীবনের কোনও পূর্ণ সমাপ্তি নেই”—এই একটা কথায় তো বাংলা ধারাবাহিক লেখকেরাও শান্তি খুঁজে পায়। কিন্তু বাখতিনের এই বহুস্বরিকতা মানে শুধু চরিত্রের মুখে ডবল ডায়লগ না—এ এক অসীম না
এই বইটি পড়তে পড়তে মনে হয়, তপোধীর ভট্টাচার্য যেন বাখতিন নিয়ে কোনও মহাবিশ্বের স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলেছেন আর আমি পাঠ করছি, কোনও ম্যাটিনি শো নয়, বরং এক দীর্ঘ রাত্রির অস্থির উচ্চারণ, যেখানে তাত্ত্বিক গ্রন্থির মধ্যে দাঁড়িয়ে হঠাৎ-ই আপনার সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে যায় জীবন নিজে।
চরিত্র হিসেবে মিখায়েল বাখতিন একটু অদ্ভুত—তিনি মার্ক্সবাদে স্নান করে এলেন, তবু কসম খেয়ে বললেন, ‘মার্ক্স আমার সব না, আমি শব্দেরও এক নাগরিক’। উপন্যাসকে যিনি শুধুই গল্প বলার জন্য নয়, জীবনকে বহুস্বরিক ভয়েসে বাঁধার ল্যাবরেটরি বলেছিলেন—তাঁর চিন্তা যে এতখানি বিপজ্জনক, তা বুঝতে পারলে বাঙালি পাঠক হয়তো আরও আগে খুনসুটিতে পড়ে যেত। কিন্তু আমরা বরাবরই বিপজ্জনক জিনিসকে পুরোহিতদের হাতে তুলে দিয়ে গঙ্গাজলে ছুঁইয়ে নিই—অন্তত এটুকু তো নিরাপদ!
তবে এটুকু বলতেই হয়—বইটি 'তত্ত্ব' শব্দের ঘাড়ে চেপে পড়ে তাকে ডানহাতে মারছে, বাঁহাতে জড়িয়ে ধরছে। একবার বলে 'তত্ত্ব মানে পথিকৃৎের রক্তে লেখা ইতিহাস', আবার পরক্ষণেই বলে ‘বাঙালি বললে রে ভাই, তত্ত্ব মানে কেরানির টেবিল’। মন্দ কী? এভাবেই তো চেতনার অন্তর্বর্তী অঞ্চলে দাঁড়িয়ে তৈরি হয় জীবন-রচনার কোরিওগ্রাফি।
বাখতিন সাহেব কি বলেছিলেন? “জীবনের কোনও পূর্ণ সমাপ্তি নেই”—এই একটা কথায় তো বাংলা ধারাবাহিক লেখকেরাও শান্তি খুঁজে পায়। কিন্তু বাখতিনের এই বহুস্বরিকতা মানে শুধু চরিত্রের মুখে ডবল ডায়লগ না—এ এক অসীম নাচ, যেখানে ‘অপরতা’কে দুধের বাটি দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
আর আমাদের কী দশা? পঁইপঁই করে ফুকো-দারিদা পড়ে এসে, সন্ধ্যেবেলা ধুতি পরে কবিতা আবৃত্তি করি—সেখানেই তত্ত্বের শেষকৃত্য। কিন্তু বাখতিন এসে যখন বলে, ‘প্রত্যুত্তরযোগ্যতা না থাকলে তুমি বাঁচো কীভাবে?’ তখন আমরা থমকে যাই। কারণ আমরা সদাই উত্তর চাই, প্রশ্ন নয়। আমাদের শ্রেণীকক্ষে কেবল ‘উত্তর’ চাই, ভুল করলে গম্ভীর গলা বলে, “কই কই, শোনোনি বাপু, পাশ ফেল...”
চমৎকার এক লাইন—‘প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের সর্বব্যাপ্ত বিয়োগপর্বে বাখতিনের পথ ও পাথেয়কে কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত করা সম্ভব?’—এই প্রশ্নটাই তো যেন বর্তমান বিশ্বশাসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা এক বাঙালি স্নায়ু বিশেষজ্ঞের কণ্ঠস্বর, যিনি ভাবছেন, AI দিয়ে প্রেম চর্চা সম্ভব কিনা।
বাখতিন-চর্চার তুলনায় বাংলা সাহিত্যের পাঠকমাত্রই আজ ফেসবুক-ঘেঁষা। তিনি ভাবেন, ‘আজ একটা পোস্ট না দিলে বোধহয় আমি অস্তিত্ব হারালাম।’ এইখানেই বাখতিনের রিডিং কাজে আসে—দ্বিরালাপ মানে ইনবক্স নয়, আত্মার সঙ্গে অস্তিত্বের সেই চক্রাকার সংলাপ, যার মধ্যে ভেসে আসে বৃষ্টি, বিদ্রোহ আর ভাঙা গান।
তাই এই বই লেখা, এক অর্থে, ‘বাখতিন রচনাবলি’-র পাঠোদ্ধার নয়—বরং এটি ‘জীবন রচনাবলি’-র প্রথম খণ্ড। যেখানে বাখতিন হচ্ছেন সেই দাদু, যিনি সন্ধ্যাবেলায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে গোল করে বসেন, আর বলেন—“তোমরা কার কথা শোনো না, নিজের কথা বলো, তবে অন্যের ভাষায়।”
এবং হ্যাঁ, আমাদের মনে রাখা উচিত, এই বই শুধু বাখতিনের ওপর লেখা নয়। এটি আসলে সেই পাঠকের আত্মজিজ্ঞাসা—“আমি জানি না সে কে, তবু আমি জেনেছি তাঁকে।” যেমন চোর-পুলিশ খেলার মতো, জীবনের মুখোমুখি খেলাটাও একধরনের সৃজন—এই লেখাটাও যেন সেই খেলারই নান্দনিক অথচ ক্ষুরধার প্রতিরূপ।
শেষ কথা? আপনি যদি ভাবেন, এই লেখা শেষ হয়ে গেছে, তাহলে বলি, বাখতিন কিন্তু বলতেন—“শেষ মানে শুরু নয়, নতুন কন্ঠের দায়িত্ব।” আর সেই কণ্ঠ এখন আপনার।
মিখায়েল বাখতিন দ্বিরালাপের নন্দন
তপোধীর ভট্টাচার্য
দে’জ পাবলিশিং
জানুয়ারি, ২০২৩
২৯৯ রুপি