মবতন্ত্র > গণতন্ত্র
মবতন্ত্রের সমস্যা হচ্ছে, এটা একটা বেওয়ারিশ কুকুরের মতো—যেকোনো দিকেই দৌড়াতে পারে, যেকোনো সময় মালিককে কামড়ে দিতে পারে।
সবাই একমত যে, একমত হওয়া যাবে না!
বাংলাদেশের রাজনীতি এক অনন্য রোলার কোস্টার—উত্থান, পতন, ঘূর্ণিঝড়, ব্রেকফেল, রক্তপাত, থেমে যাওয়া, আবার চলা। এরকম রাজনীতি পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না, গবেষকরা গবেষণা করে বের করুক। তবে নিশ্চিত বলা যায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র এক অভিজাত অ্যাক্সেসরির মতো। থাকা দরকার, কিন্তু ব্যবহারের কোনো দরকার নেই। ঘরে সুন্দর শোকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য, অতিথিদের দেখানোর জন্য, "আছে আছে, আমরা গণতান্ত্রিক দেশ!"—এই বুলি আওড়ানোর জন্য।
গণতন্ত্র এদেশে একটা হীরের নাকফুলের মতো। সবাই সেটা চায়, কিন্তু কানে গিয়ে বসিয়ে দেয়। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে—‘ঠিক মানাচ্ছে তো?’ স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি, গণতন্ত্রের আশায় আমরা যেই যেই বাস ধরতে চেয়েছি, সেটা ঠিক গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই কে যেন ব্রেক কষে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে এমনও হয়, গণতন্ত্রের জন্য চিৎকার করতে গিয়ে দেখি, যাদের চেঁচানোর অধিকার নেই, তারাই আমাদের মুখ চেপে ধরেছে।
আমরা গণতন্ত্র চাই, এটা নিয়ে সন্দেহ নেই। কারণ, গণতন্ত্র ভালো জিনিস। শুনতে ভালো লাগে, দেখতে ভালো লাগে, এবং মাঝেমধ্যে বিদেশিদের সামনে মুখ রক্ষা করার জন্য কাজে লাগে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা গণতন্ত্রকে চাই একটা চমৎকার পার্টির মতো—যেখানে ঢোকার জন্য ইনভাইটেশন কার্ড লাগে, কিন্তু একবার ঢুকে পড়লে যা খুশি করা যায়। কথা বলা যাবে, মত প্রকাশ করা যাবে, কিন্তু ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে গেলেই বিদ্যুৎ চলে যাবে, ইন্টারনেট অর্ধেক গতিতে চলবে, অথবা একদল মুখোশধারী আপনার দরজায় টোকা দিতে পারে।
গণতন্ত্র! শুনলেই মনে হয়, ঝরঝরে হাওয়া, মুক্ত মতপ্রকাশ, ‘একজনের এক ভোট’—এমন একটা আদর্শ, যা আমাদের বুকের মধ্যে পেঁপে গাছের মতো বড় হতে হতে হঠাৎ ঝড়ে উপড়ে যায়। আমরা ৫৩ বছর ধরে গণতন্ত্র চাইছি, আর সে ঠিক ৫৩ বছর ধরে আমাদের চোখে ধুলো দিচ্ছে। ছ’মাস আগেও আমরা মনে করেছিলাম, এবার বোধহয় গণতন্ত্রের একটা ছাপ্পা পড়বে, একটা নতুন অধ্যায় শুরু হবে। কিন্তু জন্ম হলো ‘ঐকমত্য কমিশন’ নামক এক নতুন ধাপ্পাবাজির। কমিশন হয়েছে, কিন্তু ঐকমত্য হয়নি। কেন হয়নি? কারণ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি—ঐকমত্য হবে না! গণতন্ত্রের জন্মদাত্রী সভ্যতার ইতিহাসে এই দৃশ্য অভিনব: সবাই একমত যে, একমত হওয়া যাবে না!
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা যেন বিয়ের বাজারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলের মতো—তার বিয়ে হবেই, কিন্তু কবে হবে, কাকে দিয়ে হবে, এবং বাসর রাতে সে সত্যিই খুশি থাকবে কি না, কেউ জানে না।
গণতন্ত্রের ব্যাপারে আমাদের দেশে একটা লুকানো নিয়ম আছে: যতক্ষণ গণতন্ত্র সরকারকে বাঁচায়, ততক্ষণ সেটা ভালো, কিন্তু যখনই গণতন্ত্র সরকারকে প্রশ্ন করে, তখন সেটা ষড়যন্ত্র। ইতিহাস বলছে, গণতন্ত্রের গাড়ি বারবার যাত্রা শুরু করেছে, কিন্তু প্রতিবারই পাংচার হয়ে গেছে। কেন? কারণ, এই গাড়িতে চালকের আসনে একদল অলিগার্ক, বড়লোক রাজনীতিবিদ, তাদের ধামাধরা মিডিয়া, আর কিছু সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী। গণতন্ত্র একটা খেলার মাঠ, যেখানে জনগণ শুধু দর্শক। চিৎকার করতে পারে, হাততালি দিতে পারে, কিন্তু ম্যাচের রেফারি সবসময় জানে কোন দল জিতবে।
কেন গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খায়? সমস্যাটা কী? সমস্যা হলো, যারা ক্ষমতার ধারে কাছে যায়, তারা নিজেদের জন্য একটা আরামের সোফা বানিয়ে নেয়। জনতা তখন হয়ে যায় ড্রইংরুমের শোপিস। অতএব, আমরা গণতন্ত্র চাই, কিন্তু যারা ক্ষমতার আশপাশে থাকে, তারা গণতন্ত্রের নামে নিজেদের আরামদায়ক রাজত্ব চায়।
১৯৭১ সালে মানুষ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিল। পাকিস্তানি শাসকরা যখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করল, তখন যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৭২ সালে, রাজনীতিবিদদের বিভাজন, গণতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্র বনাম বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিতর্ক, ক্ষমতার অলিগার্কি তৈরি—এসব মিলিয়ে রাজনীতি আবার সংকীর্ণ গোষ্ঠীর স্বার্থে আটকে গেল।
১৯৭৫-এর পর এক ব্যক্তির শাসন, ১৯৯১-এর পর সংসদীয় গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে এককেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ, ২০০৮-এর পর পারিবারিক শাসন, আর ২০২৪-এ এসে দেখি, আমরা গণতন্ত্রের বদলে মবতন্ত্র চর্চা করছি। এখন কেউ যদি বলে, "গণতন্ত্রে জনগণের ক্ষমতা আছে", তার মানে সে হয় ইতিহাস জানে না, না হলে সোজাসাপ্টা ঠাট্টা করছে।
মবতন্ত্র—মানে সেই ব্যাধি, যেখানে ‘গণ’ থাকে, কিন্তু ‘তন্ত্র’ উধাও। আর এই মব এখন একটানা একরঙা নয়, টুকরো-টুকরো, বিচিত্র ব্যান্ডের ক্যাসেট! কখনো কেউ আসছে ধর্মীয় অনুভূতির দাবিতে, কখনো ফ্যাসিবাদের দালাল খুঁজতে, কখনো একেবারে লুটপাটের মিশনে। ফলে, যেকোনো সময় যে কোনো মব রাস্তায় নেমে পড়তে পারে। কিন্তু মবের বিপদ কোথায়?
মবের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, তারা আদর্শহীন। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে এসে যদি আপনার জানালার গ্রিল খুলে নিয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে, আদর্শের প্রশ্নটাই মাটিচাপা পড়ে গেছে। রাজনৈতিক আন্দোলন মানে তখন শুধু হট্টগোল নয়, একটু জানালার পাইপ, একটু গেট, একটু পোড়া গাড়ির বাম্পার আর টুকটাক মালামাল বগলদাবা করা।
এখন প্রশ্ন হলো, যারা একদা শাসক ছিল, তারা কেন এই মবের সামনে বেরোতে পারছে না? কেন তারা ফেসবুক আর ইউটিউবে সোচ্চার, কিন্তু রাস্তায় নেই? কারণ, তারা জানে, বেরোলেই গণপিটুনি অপেক্ষা করছে। বছরের পর বছর তারা নিজেদের ‘অপরাধহীন শাসক’ বলে চালিয়েছে, অথচ এত অন্যায় করেছে যে এখন মুখ দেখানোর উপায় নেই। কিন্তু মবতন্ত্রের এই মুশকিলটা এখানেই, যে একদল অপরাধ করেছিল বলে, তার বদলা নিতে আরেকদল এখন একই অপরাধ করছে। ফলত, পুরনো শাসকের মতোই নতুন ‘মব’ও বলছে—‘‘তোমার সঙ্গে আমার মতের মিল নেই? তাহলে নিষিদ্ধ!’’
কিন্তু গণতন্ত্র তো নিষিদ্ধকরণের কথা বলে না। বই লেখা, প্রকাশনা, পাঠক কী পড়বে—এসব সিদ্ধান্ত ব্যক্তির, কারও গুঁতো খাওয়ার বিষয় নয়। অথচ এখন পত্রিকার সামনে গরু জবাই হচ্ছে, বই বন্ধ করার দাবি উঠছে, স্টল ভাঙা হচ্ছে—এ যেন গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে খাঁটি মধ্যযুগীয় বর্বরতার অনুশীলন।
এই মবতন্ত্র বড় মজার জিনিস। এখানে শাসক গোষ্ঠী একদম নির্বিকারভাবে চুরি করতে পারে, জনগণের পকেট কেটে নিজেদের রাজপ্রাসাদ বানাতে পারে, কিন্তু রাস্তায় যদি পাঁচজন লোক একসঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলে, তখনই বলা হবে, "গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে!" অথচ রাস্তায় যদি একদল লোক দোকান ভেঙে ফেলে, বইমেলায় স্টল বন্ধ করে দেয়, মাজার ধ্বংস করে, তখন সেটা 'জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া'। স্বতঃস্ফূর্ততা এমন একটা ব্যাপার, যা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে গেলে মহান, আর বিরোধীদের পক্ষে গেলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা।
মবতন্ত্রের সমস্যা হচ্ছে, এটা একটা বেওয়ারিশ কুকুরের মতো—যেকোনো দিকেই দৌড়াতে পারে, যেকোনো সময় মালিককে কামড়ে দিতে পারে। আজ একদল রাস্তা অবরোধ করছে কারণ তারা গণতন্ত্র চায়, কাল আরেকদল একই রাস্তা অবরোধ করবে কারণ তারা গণতন্ত্র চায় না। মবতন্ত্র মানে হলো, যার লাঠি তার ক্ষমতা। পার্থক্য শুধু লাঠির আকার আর কারা ফেসবুক লাইভে বেশি চিৎকার করতে পারে।
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট একটা গণবিদ্রোহ ঘটল, সবাই ভাবল গণতন্ত্রের জয় হবে, কিন্তু ছয় মাস পর দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্র আসে নাই, এসেছে মবতন্ত্রের নতুন সংস্করণ। মানুষ রাস্তায় নামে, ভাঙচুর করে, লুটপাট করে, অথচ যাদের আদর্শের জন্য আন্দোলন, তারাই নেই। তারা ফেসবুক লাইভে ব্যস্ত, কীবোর্ড চাপছে, লম্বা পোস্ট দিচ্ছে, কিন্তু রাস্তায় নামলে গণপিটুনির ভয়ে লুকিয়ে থাকে।
সত্যি বলতে, বাংলাদেশে এখন দুটি সরকার চলছে—একটা ইউটিউব সরকার, আরেকটা রাস্তার সরকার। ইউটিউব সরকার বিশ্লেষণ দিচ্ছে, "বাংলাদেশ আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমেরিকা হয়ে যাবে!" আর রাস্তার সরকার বলছে, "আগামীকাল সকালেই ইসলামি খেলাফত কায়েম হয়ে যাবে!" ফলাফল? কেউ জানে না, তবে বিনিয়োগ বন্ধ, চাকরি নেই, বাজারে দ্রব্যমূল্য চড়ছে, আর মানুষ ভাবছে, "ভাই, কোন দেশে আছি?"
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস্থার পরিণতি কী? আমরা কি গণতন্ত্রের দিকে যাব, নাকি মবতন্ত্রেই ডুবে থাকব? ইতিহাস বলে, গণতন্ত্রের দিকে যেতে হলে নির্বাচনের দরকার। কিন্তু নির্বাচন হবে কি? এই মুহূর্তে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা যেন বিয়ের বাজারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলের মতো—তার বিয়ে হবেই, কিন্তু কবে হবে, কাকে দিয়ে হবে, এবং বাসর রাতে সে সত্যিই খুশি থাকবে কি না, কেউ জানে না।
আজকের বাস্তবতায় আমাদের গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার চ্যালেঞ্জ সবচেয়ে বড়। আর যদি কেউ শেখার আগ্রহই না রাখে, তাহলে সেই রাজনীতি শুধু ক্ষমতার লড়াই হয়ে দাঁড়ায়, আর গণতন্ত্র হয়ে যায় মবতন্ত্রের স্টেজ—যেখানে একদল লুটপাট করে, আরেকদল চুপচাপ ফেসবুকে ঝগড়া করে, আর জনগণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে।
তাহলে কি গণতন্ত্র ফিরবে না? ফিরবে! কিন্তু তার জন্য দরকার ক্ষমতার চৌহদ্দির বাইরে থাকা মানুষদের সাহস। আমরা যারা সত্যি সত্যি গণতন্ত্র চাই, তারা কি আসলে গণতন্ত্রের জন্য তৈরি? নাকি গণতন্ত্র বলতে বুঝি, ‘আমার পছন্দের লোক ক্ষমতায় থাকলে ঠিক, না থাকলে রাজপথ বন্ধ করে দাও’—এই দ্বৈতসত্তাটাই আসলে সমস্যা।
সুতরাং, গণতন্ত্রকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে শাসকের ওপর দায় চাপিয়ে লাভ নেই। দায় নিতে হবে আমাদেরও। প্রশ্নটা খুবই সহজ—আমরা কি সত্যি গণতন্ত্র চাই, নাকি শুধু চাই, আমাদের সুবিধার গণতন্ত্র?
তবে এটুকু বলা যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত না দেশে একটা স্বচ্ছ নির্বাচন হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না নেতৃত্বে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চর্চা আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ একটা অনিশ্চিত অন্ধকারে ডুবে থাকবে। আর যদি ইতিহাসের ভুলগুলো আবারও করা হয়, তাহলে একদিন হয়তো শুনবেন, কারা যেন বলতে শুরু করেছে—"আসলে পাকিস্তান ভাঙাটা ভুল ছিল!" এবং তখন, সত্যি সত্যি দেশটা কোন দিকে যাবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।