অরুন্ধতী রায়ের 'মাদার মেরি কামস টু মি'
অরুন্ধতী রায় বইটিকে পড়ার জন্য এক বিশেষ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন—তিনি এটিকে স্মৃতিকথা হিসেবে নয়, বরং উপন্যাস হিসেবে পড়তে বলছেন।
অরুন্ধতী রায়ের 'মাদার মেরি কামস টু মি'-এর পর্যালোচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় BDNEWS24-এ।
রিটন খান
অরুন্ধতী রায়ের ‘মাদার মেরি কামস টু মি’ ব্যক্তিগত স্মৃতিকে সমাজ, ইতিহাস এবং সাহিত্যের স্তরে নিয়ে যায়। বইটি যেন এক অদৃশ্য ডায়েরি, যেখানে প্রতিটি পৃষ্ঠায় অরুন্ধতীর জীবনের অদেখা ব্যথা, প্রেম, ক্ষোভ আর শিকড়ে ফিরে যাওয়ার আকুলতা খোদাই করা। প্রকাশক হামিশ হ্যামিল্টন ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে এটি প্রকাশ করবে, কিন্তু বইয়ের ভেতরের সময়রেখা আরও দীর্ঘ—শৈশবের স্মৃতি থেকে শুরু করে পরিণত বয়সের বেদনাময় আত্মসমীক্ষা পর্যন্ত।
মাদার মেরি কামস টু মি মূলত এক আত্মজীবনীমূলক আখ্যানের মতো, যেখানে লেখকের জীবনের কঠিন, বেদনাদায়ক এবং অদ্ভুতভাবে আলোকোজ্জ্বল সময়ের ভেতর দিয়ে তাঁর যাত্রা ফুটে উঠেছে। এটি ব্যক্তিগত আঘাত, পরিচয়ের সন্ধান, সম্পর্কের জটিলতা এবং লেখার প্রতি গভীর আকর্ষণের এক তীব্র প্রতিফলন। বইটির গদ্য স্বতঃস্ফূর্ত, নির্মমভাবে সৎ, আর এর ‘জাদুর বাস্তবতা’ এমনভাবে বর্ণনাকে প্রাণবন্ত করে তোলে যে পাঠক যেন মুহূর্তেই সেই সময়, সেই অনুভূতির ভেতরে প্রবেশ করে যায়।
গ্রন্থটির মূল স্রোত ঘুরে বেড়ায় তাঁর মা মেরি রায়ের চারপাশে। মেরি ছিলেন একদিকে প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী, যিনি নিজের জীবনদর্শনে ছিলেন আপসহীন, আবার অন্যদিকে তিনি ছিলেন অরুন্ধতীর শৈশবের সবচেয়ে অস্থির উৎস। শৈশবের দিনগুলোতে মা ও মেয়ের সম্পর্ক প্রায়শই ঝড়ো—কখনও রাগ, কখনও অবজ্ঞা, কখনও নিঃশব্দ দূরত্ব। এই সম্পর্কের ছায়া পরবর্তীতে অরুন্ধতীর লেখকসত্তা, এমনকি রাজনৈতিক অবস্থানকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
অরুন্ধতী রায় বইটিকে পড়ার জন্য এক বিশেষ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন—তিনি এটিকে স্মৃতিকথা হিসেবে নয়, বরং উপন্যাস হিসেবে পড়তে বলছেন। কারণ, তাঁর ভাষায়, কল্পনা কখনও পুরোপুরি ব্যক্তিগত নয়; তা ভেসে আসে অসংখ্য অদেখা উৎস থেকে। তাই বাস্তব ও কল্পনা এই বইয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। একদিকে মেরি রায়ের কঠোর, কখনও নির্মম উপস্থিতি; অন্যদিকে কেরালার সেই ভেজা সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্য, যেখানে নদী, পামগাছ আর ছোট শহরের রাস্তাগুলো সবই যেন মেয়ের মানসপটে মায়ের ছায়া হয়ে ফুটে ওঠে।
বইটি পড়তে পড়তে বোঝা যায়, এটি কেবল একটি ব্যক্তিগত সম্পর্কের নথি নয়; এটি এক প্রজন্মের নারীর সংগ্রামের আখ্যানও বটে। মেরি রায়ের জীবন ও সিদ্ধান্তগুলো শুধু অরুন্ধতীর শৈশবকে গড়ে তোলেনি, বরং তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাহিত্যের প্রতি দৃষ্টিকেও ধারালো করেছে। এই অর্থে মাদার মেরি কামস টু মি কেবল আত্মজৈবনিক নয়, বরং এটি এক প্রজন্মের স্মৃতি ও সংগ্রামের অনন্য দলিল।
অরুন্ধতী রায় তাঁর এই গ্রন্থে মাকে কেন্দ্র করেই পুরো আখ্যান নির্মাণ করেছেন। এই মা—মেরি রায়—ছিলেন এক বিরল, বহুমাত্রিক চরিত্র। অরুন্ধতী তাঁকে একদিকে ‘গ্যাংস্টার’ বলেছেন, আবার অন্যদিকে নিজের ‘আশ্রয় ও ঝড়’ হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। এই দ্বৈততা আসলে তাঁর ব্যক্তিত্বেরই প্রতিচ্ছবি: তিনি যেমন নিঃশঙ্ক ও বিদ্রোহী, তেমনই অগাধ স্নেহশীল এবং বিপজ্জনকভাবে অনিশ্চিত।
অরুন্ধতীর বর্ণনায় মেরির প্রতিচ্ছবি যেন রঙিন অথচ খসখসে এক ক্যানভাস: তাঁর অদ্ভুত প্রতিভা, দয়া ও উদারতা, একইসঙ্গে হঠাৎ উথলে ওঠা নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা; ব্যবসায়িক দক্ষতা আর ঝড়ো, অনিশ্চিত মেজাজ—সব মিলিয়ে এক তীব্র মানবিক জটিলতা। কেরালার কঠোর, পুরুষতান্ত্রিক, শ্বাসরুদ্ধকর সামাজিক পরিসরে তিনি যে নিজের জন্য দৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছিলেন, তা অরুন্ধতীর কাছে সত্যিই এক ‘বিস্ময়’।
এই বিস্ময়ের পেছনে রয়েছে তাঁর অসাধারণ সাহসিকতা। খ্রিষ্টান মহিলাদের সম্পত্তির সমানাধিকারের প্রশ্নে তিনি যে ঐতিহাসিক আইনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন, এবং শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করেছিলেন, তা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত বিজয় নয়, সমগ্র দক্ষিণ ভারতের খ্রিষ্টান নারীদের জন্য এক দৃষ্টান্ত। এই জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে সামাজিক নিয়মের অচল শৃঙ্খল ভেঙে ফেলা সম্ভব, যদি ইচ্ছাশক্তি যথেষ্ট দৃঢ় হয়।
শুধু আইনি সংগ্রামই নয়, তাঁর জীবনের আরেকটি দিকও সমান গুরুত্বপূর্ণ—শিক্ষা। কোট্টায়ামে তিনি যে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এর উদ্ভাবনী শিক্ষাপদ্ধতির জন্য। এই স্কুল ছিল তাঁর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির এক প্রতিফলন: যেখানে শৃঙ্খলা ও স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা ও দায়িত্ব—সব মিলেমিশে এক নতুন শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করেছিল। অরুন্ধতীর ভাষ্যে মেরি রায় যেন একইসঙ্গে এক অনুপ্রেরণা, এক আতঙ্ক এবং এক অমোঘ আকর্ষণ। তিনি ঝড় তুলতে জানতেন, আশ্রয় দিতেও জানতেন। তাঁর জীবনের এই দ্বন্দ্বময় সুরই বইটির হৃদস্পন্দন।
তবু এই অদম্য ব্যক্তিত্বের গাঢ় অন্ধকারও বইটিতে নির্দ্বিধায় উন্মোচিত হয়েছে। অরুন্ধতীর শৈশব ছিল দোদুল্যমান আর ভয়মিশ্রিত অনিশ্চয়তায় ভরা। ছোট থেকেই তিনি এবং তাঁর ভাই এলকেসি (LKC) মায়ের হঠাৎ উথলে ওঠা মেজাজ ও অপ্রত্যাশিত আচরণের শিকার হতেন। স্মৃতির ভেতর আজও রয়ে গেছে মায়ের সেই বিদ্রূপময় বাক্যবাণ—যেমন নয় বছর বয়সে তাঁকে সরাসরি ‘বিচ’ (bitch) বলে ডাকার ঘটনা।
শুধু ভাষার আঘাতেই নয়, শারীরিক নির্যাতনেও তাঁদের শৈশব কলঙ্কিত ছিল—বিশেষত ভাইয়ের ক্ষেত্রে। মায়ের ভাষা ছিল প্রায়শই নির্মম; কখনও ভাইকে ‘পুরুষ আধিপত্যবাদী শূকর’ (male chauvinist pig) বলে বিদ্ধ করতেন, কখনও বলতেন, “তুমি কুৎসিত আর বোকা। আমি যদি তোমার মত হতাম, আমি আত্মহত্যা করতাম”। এসব অভিজ্ঞতা বর্ণনাকারীর নারীবাদ-সংক্রান্ত ধারণাকে “চিরকালের জন্য জটিল ও সংশয়ময়” করে তোলে।
কঠোরতার মাত্রা এতটাই ছিল যে স্কুলের ভিড়ের মধ্যেও তিনি ছেলেমেয়েদেরকে নিজেদের নাম ধরে ডাকতে দিতেন না—বরং ‘মিসেস রয়’ বলে সম্বোধন করতে বাধ্য করতেন। শৈশবের এই অদ্ভুত মিশ্রণ—ভয়, লজ্জা, আর বিদ্রূপ—শেষ পর্যন্ত তাঁদের চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে দাগ কেটে দিয়েছিল। শৈশব থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত মায়ের ছায়ায় বেড়ে উঠেছেন—যে মা ছিলেন একদিকে ‘মা গুরু’, অন্যদিকে ‘কোঁচাম্মা’, অর্থাৎ ছোট মা। মিসেস রয়ের ব্যক্তিত্ব ছিল প্রভাবশালী, প্রায়শই শাসনমূলক এবং নির্মম। তিনি এমন এক স্কুল চালাতেন, যা অনেকটা কাল্টের মতো; সেখানে তাঁর প্রতিটি নির্দেশ ছিল আইন, আর কর্মচারীরা—বিশেষত আম্মাল—অন্ধ ভক্তির মতো তাঁকে সেবা করত। আম্মালের জীবন পুরোপুরি নির্ভর করত মিসেস রয়ের রাগ আর আশীর্বাদের ওপর, আর সেই অদৃশ্য শাসনের ঢেউ এসে লাগত লেখকের জীবনেও।
মায়ের মেজাজ, হঠাৎ উথলে ওঠা নিষ্ঠুরতা, আবার পরক্ষণেই ঢেলে দেওয়া ভালোবাসা—সব মিলিয়ে লেখককে প্রতিদিন ‘চিহ্ন পড়তে’ আর ‘বাতাস পরীক্ষা করতে’ শিখতে হয়েছিল। এই পরিবেশে বেঁচে থাকার মানে ছিল চরম সতর্কতা: আবেগ গোপন রাখা, মুখের হাসি সামলে রাখা, আর ভেতরের ভয় লুকিয়ে রাখা। এই অস্থির শৈশবই গড়ে তুলেছিল এক জটিল, ভেতরে ভেতরে যাযাবর মন, যা কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে শেখেনি।
এই অস্থিরতা লেখকের জীবনকে করেছে মূলত ‘গৃহহীন’। শৈশবের হোস্টেল থেকে দিল্লির বস্তি—ফেরোজ শাহ কোটলায় JC-এর সঙ্গে থাকা—তারপর নিজামুদ্দিন আর মালচা মার্গের ভাড়া ঘর—প্রতিটি ঠিকানাই ছিল ক্ষণস্থায়ী, প্রতিটি জায়গাই যেন অস্থিরতার প্রতীক। এসব স্থান শুধু ভৌগোলিক নয়, তার মানসিক অবস্থারও প্রতিফলন।
এই ভেতরের ভয় এবং অস্থিরতার এক চূড়ান্ত প্রতীক হয়ে ওঠে মায়ের হাতে পোষা কুকুর ডিডোর মৃত্যু। এই ঘটনা লেখকের মনে এক গভীর বিশ্বাসঘাতকতার বোধ এনে দেয়। ক্ষতির সেই দংশন তাঁর অন্তরের যাযাবর সত্তাকে আরও তীব্র করে তোলে—একটি জীবনব্যাপী অনিশ্চয়তার বীজ যা কখনো আর মুছে যায় না।
শৈশব ছিল এক অনিশ্চিত ‘পলাতক’ জীবন, যেখানে উটির ঠাকুমার কটেজে অনাহুত অতিথির মতো দিন কাটানো, মায়ের অবিরাম আর্থিক টানাপোড়েন, আর আত্মীয়দের ভিড়ে গৃহহীনতার অনুভূতি মিশে ছিল। এই আত্মীয়দের মধ্যে ছিলেন তথাকথিত “কসমোপলিটানস”—যেমন জি. আইজ্যাক আর মিস কুরিয়েন—যাদের বাড়িতে থেকেও নিজের বলা যায় এমন কোনো ঠিকানা ছিল না। এই দোদুল্যমানতার মধ্যেই হঠাৎ আলো হয়ে এসেছিলেন কুরুসাম্মল, যিনি নিঃশব্দে তাঁদের জীবনে এনে দিয়েছিলেন স্নেহ, নির্ভরতা আর এক অমূল্য উষ্ণতা।
কিশোরী বয়সে জীবনের গতি বদলে দেয় লরি বেকার নামের এক ব্যতিক্রমী স্থপতির সংস্পর্শ। তাঁর সৃজনশীলতা আর জীবনদর্শন অরুন্ধতীকে ঠেলে দেয় স্থাপত্যবিদ্যার পথে। এটি ছিল একরকম মুক্তির যাত্রা—কোট্টায়ামের সীমাবদ্ধতা থেকে দিল্লির অচেনা আকাশে পা রাখা। এর পেছনে ছিল জীবনের প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ, যার চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে অর্থের প্রয়োজন আর অপ্রকাশিত যৌন আকাঙ্ক্ষা।
দিল্লির স্থাপত্য স্কুলে পৌঁছে তিনি নিজের পুরনো নাম ‘সুসান্না’ ছেড়ে নতুন পরিচয় বেছে নেন, যেন অতীতকে ছিঁড়ে ফেলে নতুন জীবন শুরু করছেন। সেখানেই ভাগ্য মেলায় জেসির সঙ্গে—লরি বেকারের প্রাক্তন সহকারী—যিনি তাঁর জীবনে জাগিয়ে দেন প্রথম যৌন আকাঙ্ক্ষার তীব্র স্পন্দন। এই নতুন অনুভূতি, স্বাধীনতা আর শহরের অজানা সম্ভাবনা মিলে তাঁর যৌবনের মানচিত্রে এক অমোচনীয় দাগ কেটে দেয়।
বইটি সত্তরের দশকের ভারতের অশান্ত রাজনৈতিক আবহও স্পর্শ করেছে। অরুন্ধতী স্বীকার করেছেন, জরুরি অবস্থার সময় দিল্লিতে তিনি ছিলেন প্রায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ, কিন্তু নকশাল আন্দোলনের প্রভাব তাঁর চেতনায় গভীর ছাপ ফেলেছিল। তিনি দেখেছেন কীভাবে নকশালরা ‘শ্রেণী শত্রুদের’ বিরুদ্ধে চরম হিংস্রতা প্রয়োগ করে, অথচ তাদের ক্ষোভ তিনি সহজাতভাবে উপলব্ধি করতেন। এই অভিজ্ঞতাগুলো পরবর্তী সময়ে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর লেখায়—বিশেষ করে দ্য গড অফ স্মল থিংস এবং ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস-এ। রাজনৈতিক অস্থিরতার এই ছায়া তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতি ও সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে একইসঙ্গে গড়ে তুলেছিল।
এরপর জীবনে আসেন কার্লো বুলড্রিনি—রোমান বন্ধু, আর্কিটেক্ট, অর্ধেক সাংবাদিক, অর্ধেক সন্ন্যাসী, আর অসাধারণ ফটোগ্রাফার। কার্লোই তাঁর জীবনে একরকম স্থিতি নিয়ে আসেন। তিনি শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানসিক সমর্থনও দিয়েছিলেন এবং লেখককে নিজের লেখার আকাঙ্ক্ষা অনুসরণ করতে নির্ভয়ে উৎসাহিত করেছিলেন। আর সঞ্জয় কে., যিনি পরবর্তীতে তাঁর জীবনে “আশ্রয়ের গুহা” হয়ে ওঠেন, ছিলেন এক নিখাদ বন্ধু—যার সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তি ছিল ভানহীনতা আর নিঃশর্ত বিশ্বাস।
লেখক হিসেবে তাঁর যাত্রাও এই বইয়ের কেন্দ্রীয় স্রোত। ছোটবেলা থেকেই লেখার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল, আর তাঁর মা তাঁকে “ফ্রি রাইটিং” অনুশীলনে উৎসাহ দিতেন। তবুও, জীবনের দৈনন্দিন অস্থিরতা ও সংগ্রামের ভিড়ে তাঁর সেই ফ্রি রাইটিং থেমে গিয়েছিল। এই স্থবিরতা ভাঙে প্রদীপের এক সহজ অথচ জাগ্রত করা প্রশ্নে—“আপনি কি কখনও লেখক হওয়ার কথা ভেবেছেন?”—যা তাঁর জীবনে যেন এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।
এই পুনরুত্থানের পর তিনি লেখা শুরু করেন ধারাবাহিকভাবে। প্রথমে তাঁর থিসিস পোস্ট-কলোনিয়াল আরবান ডেভেলপমেন্ট ইন দিল্লি, তারপর চিত্রনাট্যের জগতে প্রবেশ—হাউ দ্য রাইনোসেরোস রিটার্নড আর বারগাদ লেখার অভিজ্ঞতা—সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে তাঁর ভাষা, তাঁর নিজস্ব বর্ণনাশক্তি, যা পরবর্তীতে বিশ্বসাহিত্যে এক অনন্য কণ্ঠস্বর হয়ে ধ্বনিত হয়।
বইটির আরেকটি স্তম্ভ হলো পিতৃপরিচয় এবং সেই সঙ্গে জড়িয়ে থাকা “পরাজয়ের শিল্প”। বহু বছরের দূরত্বের পর বাবার সঙ্গে প্রথম দেখা—একজন মানুষ যাকে লেখক মনে করেন “না-মানুষ”। মিকি রয় ছিলেন এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের প্রতীক—জনপ্রিয়, উদার, আকর্ষণীয়, অথচ অন্তরে এক “ক্ষতিকারক দুর্বৃত্ত”। তাঁর ফাঁপা হাসি, অদ্ভুত খেয়াল আর অস্থির উপস্থিতি যেন লেখকের মায়ের পুরোনো সতর্কবাণীকেই সত্যি করে তুলেছিল। এই সাক্ষাৎ লেখকের জীবনে এক নতুন উপলব্ধি এনে দেয়—পরাজয়ের সঙ্গে লড়াই নয়, বরং তার সঙ্গে একধরনের বন্ধুত্ব গড়ে তোলাই প্রকৃত মুক্তি। এই দৃষ্টিভঙ্গি তিনি শিখেছিলেন জি. আইজ্যাকের কাছ থেকে, যিনি নিজের জীবনের ব্যর্থতাকে রূপান্তর করেছিলেন এক ধরণের জীবনদর্শনে—যেখানে পরাজয় মানে ভাঙন নয়, বরং আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অন্য এক রকম জ্ঞানলাভ।
বইটির আরেকটি শক্তিশালী ধারা রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন। ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যা, যখন দিল্লির রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ নির্মমভাবে হত্যা হয়, লেখকের মনে অমোচনীয় দাগ কেটে যায়। তিনি বুঝতে পারেন, ভাষা কখনও কখনও ব্যর্থ—ভাষাহীনতার মধ্যে দাঁড়িয়েও সেই বিভীষিকা বহন করতে হয়। একইসঙ্গে, দিল্লির প্রতিদিনকার নারীবিদ্বেষী পরিবেশ, বিশেষ করে গণপরিবহনে ক্রমাগত হয়রানি, তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। এই সব অভিজ্ঞতা তাঁকে শুধু সমাজের গভীর বৈষম্যের প্রতি সচেতনই করে না, বরং ভেতরে ভেতরে এক প্রতিবাদী সত্তার জন্ম দেয়—যার মধ্যে প্রতিশোধ, প্রতিরোধ এবং স্বাধীনতার জন্য অদম্য তৃষ্ণা একত্রে মিশে থাকে।
লেখকের সৃজনশীল জীবনের সূচনা ঘটে ছোট বাজেটের চলচ্চিত্র নির্মাণ দিয়ে। তখন দূরদর্শন ছিল ভারতের একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল, আর তারা নতুন প্রজন্মের তরুণ পরিচালকদের স্বল্প ব্যয়ের ফিচার ফিল্মে অর্থায়ন শুরু করেছিল। প্রদীপের সঙ্গে মিলে লেখক এক নতুন চলচ্চিত্রের ধারণা তৈরি করেন, যার চিত্রনাট্যের দায়িত্ব তিনি নিজেই নেন। মাত্র তিন সপ্তাহে, মালচা মার্গের ঘরে বসে জন্ম নেয় In Which Annie Gives It Those Ones—এক চিত্রনাট্য যেখানে স্থাপত্য বিদ্যালয়ের বোহেমিয়ান পরিবেশ, নেশাগ্রস্ত ছাত্রছাত্রী, আর হিন্দি-ইংরেজি মিশ্রণের নিজস্ব এক ভাষা জীবন্ত হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্রের শিরোনামও ছিল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জনপ্রিয় অপভাষা, যার অর্থ—“নিজের মতো করে কাজ করা।”
এই চিত্রনাট্য লেখা ছিল লেখকের কাছে একেবারেই ঘরে ফেরার মতো অনুভূতি—যেন তিনি নিজস্ব, পরিচিত জগতে সাঁতার কাটছেন। অ্যানি নামের মূল চরিত্রটি ছিলেন পুরুষ, আসল নাম আনন্দ গ্রোভার, যাকে বন্ধুরা স্নেহ করে অ্যানি বলে ডাকত। সে বারবার একই বর্ষে আটকে আছে, কারণ বিভাগের প্রধান, ওয়াই.ডি. বিলিমোরিয়া—ডাকনাম ‘ইয়ামদুত’ বা মৃত্যুর দেবতার দূত—তার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। চিত্রনাট্যে একক কোনো নায়ক ছিল না; প্রতিটি চরিত্রই নিজস্ব অদ্ভুতিতে অনন্য। লেখক এবং প্রদীপ দুজনেই ভেবেছিলেন, এটি দূরদর্শনের জন্য অনেকটাই অস্বাভাবিক ঠেকবে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে নতুন প্রধান এটি পছন্দ করেন এবং একটি ছোট বাজেট বরাদ্দ দেন—যা লেখকের মতে চলচ্চিত্রটির বেখাপ্পা, বিশৃঙ্খল চরিত্রগুলোর সঙ্গেই মানানসই।
শুটিংয়ের প্রস্তুতির সময় প্রদীপের অ্যাপার্টমেন্ট রূপ নেয় অভিনেতা কর্মশালা ও প্রোডাকশন অফিসে, যা বিশৃঙ্খলার মধ্যেও এক স্বতঃস্ফূর্ত পারিবারিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। লেখকও তখন মালচা মার্গের ঘর এবং আর্থিক নির্ভরতার ভয় ছেড়ে এক নতুন স্বাধীনতায় পা রাখেন। অ্যানির চরিত্রে অভিনয় করেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অর্জুন রায়না, যাকে ভেবেই চরিত্রটি লেখা হয়েছিল। ইয়ামদুত চরিত্রে ছিলেন রোশন শেঠ, যিনি রিচার্ড অ্যাটেনবোরোর গান্ধী ছবিতে নেহরুর ভূমিকায় খ্যাতি পেয়েছিলেন। লেখক নিজেও রাধা নামের এক ছাত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। সিনিয়র এক ছাত্রের চরিত্রে পর্দায় অভিষেক হয় বিশ্বের অন্যতম অভিনেতা শাহরুখ খানেরও।
চলচ্চিত্রটির শুটিং হয়েছিল একেবারে “ক্যাজুয়াল, র্যাগড” ভঙ্গিতে। প্রথম প্রদর্শনী হয় ম্যাক্স মুলার ভবনে, যেখানে ভিড় জমেছিল, আর দর্শকরা নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে চলচ্চিত্রের অনিয়মিত, স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতকে মিলিয়ে নিতে পেরেছিল। পরে এটি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্যানোরামা বিভাগে নির্বাচিত হয়। গার্ডিয়ান পত্রিকার সমালোচক ডেরেক ম্যালকম শিরোনাম নিয়ে আপত্তি তুললেও, চলচ্চিত্রটি জেতে দুটি জাতীয় পুরস্কার—শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য এবং শ্রেষ্ঠ তপসিল-বহির্ভূত ভাষার চলচ্চিত্র। জাতীয় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে লেখকের পোশাক নিয়ে এক আমলা অসন্তোষ জানালে, তিনি তাঁর নিজস্ব দৃঢ়তার সঙ্গে তা উপেক্ষা করেন।
এই জাতীয় পুরস্কার ছিল লেখকের কাছে এক ধরনের “মিষ্টি প্রতিশোধ”—যা তাঁকে মুক্তি দেয় সেই তুচ্ছ পরিচয় থেকে, যেখানে তাঁকে কেবল “প্রদীপের সহকারী” বা “সেক্রেটারি” হিসেবে দেখা হতো। তবে কেরালার সংবাদমাধ্যম তখনও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেই বেশি আগ্রহী—বিশেষত তাঁর মা, মিসেস রয়, এবং জেসির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে। লেখক এই প্রসঙ্গে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেন, তিনি কখনোই “অনুমতি” বা allow শব্দটিকে গ্রহণ করেন না—যা তাঁর স্বাধীনতা ও স্বশাসনের প্রতি এক অনমনীয় বিশ্বাসের প্রমাণ।
মিসেস রয়ের জীবনের আরেকটি নাটকীয় অধ্যায় রচিত হয় তাঁর বিদ্যালয়ে জিসাস ক্রাইস্ট সুপারস্টার মঞ্চস্থ করার চেষ্টা ঘিরে। কোট্টায়মের জেলা কালেক্টর, যিনি ব্যক্তিগত ক্ষোভ পোষণ করছিলেন কারণ তাঁর অনুরোধ সত্ত্বেও বিদ্যালয়ে দুজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি দেওয়া হয়নি, নাটকটির বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি অভিযোগ তোলেন যে এটি “ঈশ্বরনিন্দা” এবং “খ্রিস্টান অনুভূতিতে আঘাত হানা”র শামিল। স্থানীয় প্রশাসনের চাপে নাটকটি নিষিদ্ধ করা হয়।
কিন্তু মিসেস রয় সহজে নতি স্বীকার করা মানুষ নন। তিনি আদালতের দ্বারস্থ হন, লড়াই চালিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে জয়ী হন। তাঁর এই দৃঢ় অবস্থান শুধু ব্যক্তিগত সাহসের দৃষ্টান্তই নয়, বরং এক বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রতিচ্ছবি, যেখানে ধর্মীয় অনুভূতিকে ক্রমেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। এই লড়াই মিসেস রয়কে স্থানীয় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে এবং একইসঙ্গে তাঁর সন্তানদের জীবনেও আরও একটি ঝড় বয়ে আনে।
মিসেস রয় যখন আদালতে তাঁর আইনি লড়াই লড়ছেন, সেই সময় লেখক ও প্রদীপ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাঁদের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ইলেকট্রিক মুন-এর জন্য। ব্রিটিশ টেলিভিশন সংস্থা চ্যানেল ফোর অর্থায়ন করেছিল এই প্রজেক্টে, যা ছিল এক নির্মম ব্যঙ্গচিত্র—অরুন্ধতীর ভাষায়, “মাথা দিয়ে লেখা, হৃদয় দিয়ে নয়।” বিদেশি প্রোডাকশন হওয়ায় শুটিং শুরুর আগে চিত্রনাট্যকে একাধিক সরকারি দপ্তরের অনুমোদন নিতে হয়েছিল। বারবার চাপ আসছিল এমন সংলাপ বা দৃশ্য মুছে ফেলতে, যা নাকি “ভারতকে সঠিক আলোয় দেখাচ্ছে না।”
শুটিংয়ের সময় বাস্তব জীবনের রাজনৈতিক ঝড়ও এসে পড়ে। অ্যাডভানির রথযাত্রার কারণে কাজ বিলম্বিত হয়, যা অরুন্ধতীর কাছে ফ্যাসিবাদের উত্থানের এক স্পষ্ট পূর্বাভাসের মতো মনে হয়েছিল। কিন্তু শুটিংয়ের অভিজ্ঞতাই ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম কঠিন ও তিক্ত অধ্যায়। সেটে ছিল সংস্কৃতিগত সংঘাত, ভুল বোঝাবুঝি, এবং এমনকি বর্ণবাদের অভিযোগ পর্যন্ত ওঠে।
ইলেকট্রিক মুন শেষ পর্যন্ত অরুন্ধতীকে ভেতরে ভেতরে অস্থির করে তোলে। কেন এই অভিজ্ঞতা এত গভীরভাবে অস্বস্তিকর ছিল, তা বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন একটি প্রবন্ধ—In a Proper Light। এই লেখা প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সান্ডে-তে, যা তাঁর গদ্য লেখার জগতে প্রথম পদক্ষেপ হয়ে ওঠে এবং ভবিষ্যতের সাহিত্যিক পথচলার দরজা খুলে দেয়।
ইলেকট্রিক মুন-এর তিক্ত অভিজ্ঞতার পর অরুন্ধতী সিদ্ধান্ত নেন আর কোনো চলচ্চিত্রে কাজ করবেন না। তিনি একা কাজ করতে চান, নিজের লেখার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে চান। আর্থিক স্বাধীনতা তাকে সেই সুযোগ দেয়—“নিজের সময় কিনে নেওয়া,” যেমন তিনি বলেন। এই নিঃসঙ্গতার মুহূর্তেই তাঁর মনে ভিড় জমাতে শুরু করে আইমেনেম—তার নদী, তার বাড়ি, আর তার মানুষজন। তিনি লিখতে চান এমন এক “অচল” বই, যা চিত্রনাট্যের দ্রুতগতি আর বাজারের সম্পূর্ণ বিপরীত।
এই সিদ্ধান্ত প্রদীপকে জানানো সহজ ছিল না। তাঁরা ছিলেন যেন এক “ব্যান্ড”—দু’জনের সৃষ্টিশীল জীবন পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে। প্রদীপ প্রথমে আপত্তি করলেও, শেষ পর্যন্ত অরুন্ধতীর প্রবল আকাঙ্ক্ষার কাছে নতিস্বীকার করেন। এই সময় প্রদীপের বাবার অসুস্থতা এবং মৃত্যু তাঁদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। প্রদীপের মায়ের মানসিক অবস্থা কিছুটা শান্ত করতে, হঠাৎ করেই অরুন্ধতী ও প্রদীপ বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। এটি ছিল একেবারেই আনুষ্ঠানিক, নিবন্ধিত বিয়ে—যেখানে মিসেস রয়ও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এই বিয়ে নিয়ে কেউ, এমনকি নবদম্পতিও, কোনো উচ্ছ্বাস অনুভব করেনি। অরুন্ধতী পরে স্বীকার করেছেন যে প্রদীপ ও সঞ্জয়কে তিনি “খুব আলাদা উপায়ে” ভালোবেসেছিলেন, আর সেই সম্পর্ক ছিল নিখাদভাবে “জটিল।”
এই সময় লেখক শুরু করেন The Thing I Was Not Supposed to Be Writing—যা পরবর্তী সময়ে সাহিত্যের মানচিত্রে এক অনন্য স্থান করে নেয়। একই সময়ে তিনি দেখেন Bandit Queen চলচ্চিত্র, যা তাঁকে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ করে। জীবিত এক নারীর ধর্ষণকে তার সম্মতি ছাড়া পর্দায় পুনর্নির্মাণ—এই নৈতিক প্রশ্ন তাঁর মনে তীব্র আলোড়ন তোলে। প্রতিক্রিয়ায় তিনি লেখেন The Great Indian Rape-Trick শিরোনামে দুটি প্রবন্ধ, যা প্রকাশিত হয় Sunday পত্রিকায়। এই লেখাগুলো সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায় চলচ্চিত্রের নৈতিকতাকে এবং এর ফলেই চ্যানেল ফোর-এর কমিশনকারী সম্পাদক তাঁর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হন, তাঁকে উপহাস করে “অসংযমী মাতাল” বলে অভিহিত করেন। এই বিতর্কের মাঝেই তিনি চ্যানেলের জন্য কমিশন করা একটি স্ক্রিপ্টকে বিদ্রুপাত্মক, ব্যঙ্গ-হাস্যরসে রূপান্তরিত করেন এবং নিজেকে সেখানে এক তিক্ত নারীবাদী চরিত্রে মূর্ত করে তোলেন।
এই সময় প্রাপ্ত রয়্যালটি তাঁকে আরও কিছু স্বাধীনতা এনে দেয়, আর সেই সময়ে জন্ম নেয় The God of Small Things। বইটি প্রথমে তাঁর মনে আসে এক দৃশ্য হিসেবে—যমজ শিশু রাহেল ও এস্থা, যারা একটি রেলওয়ে ক্রসিং-এ আটকে আছে। এই দৃশ্য থেকে শুরু হয় চার বছরের দীর্ঘ সৃজনযাত্রা। বই শেষ করার পর প্রথমে প্রদীপকে শোনান। প্রদীপ বইটি পড়ে দুঃখিতভাবে বলেন, “আমি তোমাকে হারাতে চলেছি।” এই সময় লেখক আর্থিক সংকটে পড়েন। দীর্ঘ একাকিত্ব, উদ্বেগ, আর সৃষ্টিশীলতার চাপ তাঁর শরীরে দাগ কাটে—ত্বকে অদ্ভুত সমস্যার উদ্ভব হয়। তবুও, এই দুঃসহ সময়ই তাঁকে নিয়ে আসে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সাহিত্যিক সাফল্যের দোরগোড়ায়।
পাঙ্কজ মিশ্র, তখনকার হার্পারকলিন্স ইন্ডিয়ার প্রধান, অরুন্ধতীর পাণ্ডুলিপি পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই মুগ্ধ হন এবং তা প্রকাশ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়—এরপর বইটি ঘিরে শুরু হয় আন্তর্জাতিক প্রকাশনা জগতের এক বিরল “হৈচৈ।” ডেভিড গডউইন, লন্ডনের নামকরা সাহিত্য এজেন্ট, ব্যক্তিগতভাবে দিল্লি এসে লেখকের সঙ্গে দেখা করেন এবং মুহূর্তের মধ্যেই তাঁদের মধ্যে চুক্তি সম্পন্ন হয়। বইটি শেষ পর্যন্ত বিশ্বের চল্লিশটিরও বেশি প্রকাশকের হাতে যায় এবং অগ্রিম রয়্যালটি হিসেবে লেখক পান এক মিলিয়ন ডলার। সেই অর্থ তিনি পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নেন, কারণ তাঁর নিজের ভাষায়—“যাদের আমি ভালোবাসি তাদের কাছে কিছুই নেই, তখন সচ্ছলতার মধ্যে বসে অর্থ জমিয়ে রাখা সম্ভব নয়।”
লেখক আরও নিশ্চিত করেন যে The God of Small Things প্রথমে ভারতে প্রকাশিত হোক। বন্ধুদের সহযোগিতায় ‘ইন্ডিয়া ইঙ্ক’ নামে একটি নতুন প্রকাশনা সংস্থা গড়ে ওঠে, যা বইটির স্থানীয় প্রকাশনার দায়িত্ব নেয়। তবে বইটি প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র—কেউ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে, কেউ তীব্র ঘৃণা। কোট্টায়মে বইয়ের আনুষ্ঠানিক উন্মোচন হয় মিসেস রয়ের স্কুলেই। কেরালায় বইটি নিয়ে শোরগোল কম ছিল না। স্থানীয় মার্কসবাদী সরকার বইটিকে দল এবং এর কিংবদন্তি নেতা ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদের প্রতি “অগ্রহণযোগ্য সমালোচনা” মনে করেছিল। পাশাপাশি উপন্যাসে সিরিয়ান খ্রিস্টান ও পারাভান সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত বৈষম্যের ইঙ্গিত বহু রক্ষণশীল সিরিয়ান খ্রিস্টান এবং কিছু আইনজীবীকে উত্তেজিত করে। শেষ পর্যন্ত পাঁচজন পুরুষ আইনজীবী লেখকের বিরুদ্ধে “অশ্লীলতা” এবং “নৈতিকতা নষ্ট করার” অভিযোগে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। এই মামলা লেখকের জীবনে বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে এর মোকাবিলা করেন।
মোড়ক উন্মোচনের দিন ছিল নানা স্তরের আবেগে ভরা। মিসেস রয় ও তাঁর ভাই জি. আইজ্যাকের মধ্যে উত্তেজনার বাতাস বইছিল। জি. আইজ্যাক, যিনি যেন উপন্যাসের ‘চ্যাকো’ চরিত্রের প্রতিচ্ছবি, বইয়ের নিজের সংলাপগুলো জোরে জোরে আবৃত্তি করতে শুরু করেন। আর অরুন্ধতী দ্রুত পড়ে শোনান একটি অংশ, যেখানে শিশুদের ভালোবাসার পুনর্বিন্যাস নিয়ে লেখা ছিল—যেন নিজের বইকে সবার সামনে প্রথমবারের মতো মুক্তি দেওয়া।
এরপর এল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত—বুকার পুরস্কার। জয় ছিল নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর, কিন্তু তার সঙ্গেই এলো এক অদ্ভুত অনুভূতি—যেন খ্যাতি হয়ে উঠেছে এক “সোনালী খাঁচা,” যা স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। অরুন্ধতী অনুভব করলেন, এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসাই তাঁর পরবর্তী চ্যালেঞ্জ। তবুও, বুকার পুরস্কার তাঁকে এনে দেয় এক অমূল্য মুক্তি—নিজের শর্তে বাঁচা এবং লেখা। পুরস্কার ঘোষণার পর তিনি ফোন করেন মিসেস রয়কে, যিনি বলেন—“ওয়েল ডান, বেবি গার্ল।” লেখকের কাছে সেই মুহূর্তটি ছিল অবিশ্বাস্য ভালোবাসার স্পর্শ—এক নিঃশব্দ স্বীকৃতি, যা তিনি সারাজীবন বয়ে নিয়ে চলবেন।
বুকার জয়ের কয়েক মাস পরই প্রদীপের মা মারা যান, আর সেই মুহূর্তে লেখকের জীবনে নতুন এক দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়—পারিবারিক সম্পত্তি আর তথাকথিত “ডাউনস্টেয়ার্স লাইফ,” অর্থাৎ পরিচারকবেষ্টিত বিলাসী জীবন। এই জীবনযাপন তাঁর কাছে মনে হয়েছিল নিছক এক “উচ্চ ভণ্ডামি”—যা তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস, নৈতিকতা এবং শৈল্পিক সততার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দ্বিধা কাটাতে এবং নিজের নৈতিক অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখতে তিনি পরিবারের সেই আরামদায়ক পরিবেশ থেকে সরে এসে একটি পৃথক অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন।
এর কিছুদিন পর ১৯৯৮ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসে এবং পরিচালনা করে পারমাণবিক পরীক্ষা। এই ঘটনাই অরুন্ধতীকে রাজনৈতিক করে তোলে। তিনি লেখেন The End of Imagination, একটি ক্ষুরধার রাজনৈতিক প্রবন্ধ যা পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়। এই লেখাই তাঁকে রাতারাতি “সাহিত্যিক তারকা” থেকে “দেশবিরোধী” তকমা এনে দেয়। তখন তিনি নিজেকে ঘোষণা করেন “স্বাধীন, মোবাইল প্রজাতন্ত্র” হিসেবে। ব্যক্তিগত জীবন তখন প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, তবুও রাজনীতি, ক্রোধ এবং নৈতিক দৃঢ়তা তাঁকে ভেতরে ভেতরে একত্রে ধরে রেখেছিল।
এই সময়ে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন নর্মদা উপত্যকার বাঁধ-বিরোধী আন্দোলনে। বড় বাঁধের পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক ক্ষতির বিরুদ্ধে তিনি লেখেন তীব্র প্রবন্ধ The Greater Common Good। এই লেখাই আবার তাঁকে আদালতের অবমাননার অভিযোগের মুখে ঠেলে দেয়। সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে তাচ্ছিল্যভরে আখ্যা দেয়—“সেই মহিলা”—যা লেখকের মনে জেগে তোলে পুরোনো আঘাতের স্মৃতি, যখন তাঁকে সামাজিক পরিসরে “রক্ষিতা” বা “উপপত্নী”র তকমা শুনতে হয়েছিল। বিদ্রূপ আর প্রতিবাদের মিশেলে তিনি নিজেকে ডাকতে শুরু করেন—“বুকার জেতা বেশ্যা” (Hooker who won the Booker)—যা তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক যাত্রাকে এক নিঃসংকোচ, আত্মসমালোচনামূলক ভাষায় সংজ্ঞায়িত করে।
অরুন্ধতী “লেখক-কর্মী” বা writer-activist শব্দটিকে নিছক হাস্যকর মনে করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, মানুষের জীবনে যেসব বিষয় গভীর প্রভাব ফেলে, সেগুলো নিয়ে লেখা একজন লেখকের মৌলিক দায়িত্ব—এটাই লেখালেখির স্বাভাবিক পথ। খ্যাতি ও অর্থ তাঁকে স্বস্তি না দিয়ে বরং অস্বস্তির ভেতর ঠেলে দিয়েছিল। তাঁর বই যখন লাখে লাখে বিক্রি হচ্ছিল, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফুলেফেঁপে উঠছিল, তখনও তাঁর চোখে ধরা দিত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দারিদ্র্য। এই দ্বন্দ্ব মেটাতে তিনি নিজের রয়্যালটির একটি বড় অংশ একটি ট্রাস্টে দেন, যা সমর্থন জোগায় সেইসব সাংবাদিক, কর্মী, শিক্ষক, আইনজীবী, শিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের—যারা সাহসের সঙ্গে প্রবাহের বিপরীতে দাঁড়ান। তাঁর ভাষায়, “অর্থ মানুষকে মুক্তি দিতে পারে, আবার সেটি পঙ্গু করে দিতে পারে, এমনকি পারমাণবিক বর্জ্যের মতো ধ্বংসাত্মকও হতে পারে।”
কিন্তু এই আদর্শিক যাত্রাপথ কখনোই সহজ ছিল না। আইনি ঝামেলা প্রায় নিয়ত তাঁর সঙ্গী ছিল। “অশ্লীলতা”র অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আরও দুটি ফৌজদারি মামলা হয়, যার একটিতে তাঁকে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কারাগারেও যেতে হয়। একইসঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনও ছিল চ্যালেঞ্জে পূর্ণ—বিশেষ করে মিকি রয়ের মতো ঘনিষ্ঠ মানুষের আসক্তির সঙ্গে সংগ্রাম। লেখক নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করে মিকিকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করান এবং তাঁর জন্য এক নতুন জীবনের সম্ভাবনা তৈরি করার চেষ্টা করেন। এই সবকিছু মিলিয়ে তাঁর জীবন হয়ে ওঠে প্রকাশ্য সংগ্রাম আর ব্যক্তিগত দায়িত্বের এক জটিল সমীকরণ—যেখানে খ্যাতি, অর্থ, নৈতিকতা, সম্পর্ক আর রাজনৈতিক অবস্থান এক অদৃশ্য সূতোয় বাঁধা।
অরুন্ধতী রায় তাঁর স্মৃতিচারণে আদালত অবমাননার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার দিনের অভিজ্ঞতা ফুটিয়ে তুলেছেন। ছয় মাসের কারাদণ্ডের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পেলেন মাত্র এক দিনের জেল এবং একটি ক্ষুদ্র জরিমানা। সাজাটি ছিল মূলত প্রতীকী, তবু সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে। অথচ অরুন্ধতীর চোখে এই নাটকীয়তা ঢেকে রাখতে পারেনি তার সময়ের প্রকৃত বিভীষিকা—গুজরাটে দিনের আলোয় হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হচ্ছিল, যা তাঁর মনে করিয়ে দেয় ১৯৮৪ সালের শিখবিরোধী দাঙ্গার ভয়াবহতাকে। তিনি সরাসরি তুলে ধরেন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর ভূমিকা এবং গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দায়িত্ব, যা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর জাতীয় ট্র্যাজেডির মধ্যে এক তীব্র বৈপরীত্য সৃষ্টি করে, পাঠকের মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
কারাগারে লেখকের সাক্ষাৎ হয় আফসান নামের এক গর্ভবতী কাশ্মীরি নারীর সঙ্গে, যাকে ২০০১ সালের ভারতীয় পার্লামেন্ট হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই সাক্ষাৎ তাঁকে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ত্রুটি এবং সংবাদমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। তিনি দেখান কিভাবে পুলিশ ও মিডিয়া পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তে পৌঁছে আফসান ও এস.এ.আর. গিলানির মতো নিরপরাধদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে। পরবর্তীতে আফজল গুরুকে “মূলচক্রান্তকারী” হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যদিও সরাসরি কোনো প্রমাণ ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় “সমাজের সম্মিলিত বিবেক”কে সন্তুষ্ট করার জন্য দেওয়া হয়েছিল, যা লেখকের কাছে এক মর্মান্তিক বিচারিক প্রহসন। তিনি আফজলের জোরপূর্বক স্বীকারোক্তির বিবরণ তুলে ধরেন এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে আসল সত্যটি আড়াল করে রাখা হয়েছিল।
এই কাশ্মীর অধ্যায়টি অরুন্ধতীর লেখায় ভারতীয় রাষ্ট্রের দমনমূলক নীতির এক নির্মম চিত্র তুলে ধরে। তিনি কাশ্মীরকে বর্ণনা করেছেন “সামরিক দখলদারিত্ব” হিসেবে, যেখানে অপমান আর নৃশংসতা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। সেনাবাহিনী শুধু জনজীবনেই নয়, মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরেও হস্তক্ষেপ করে। এই বিবরণের মধ্যে সঞ্জয়ের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জটিল অবস্থানের উল্লেখ রয়েছে, যা পুরো বয়ানকে আরও সংবেদনশীল করে। কাশ্মীরি পরিবারগুলোর পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা, তাদের উপর চাপানো সম্মিলিত শাস্তি আর অরুন্ধতীর নিজের একাকীত্ব—সব মিলিয়ে এই অধ্যায়ে ফুটে ওঠে তাঁর ভেতরে বাসা বাঁধা অনিশ্চয়তা ও যাযাবর জীবনবোধের গভীর প্রতিধ্বনি।
বইটির মূল স্রোত বয়ে গেছে লেখকের মায়ের সঙ্গে তাঁর আজীবনের জটিল সম্পর্কের ভেতর দিয়ে। বিশেষ করে মৃত্যুর মুহূর্তে মায়ের বলা, “আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি,” আর লেখকের অপ্রকাশিত ঘৃণা সত্ত্বেও অবিচল স্নেহ—এই দ্বন্দ্ব তাদের সম্পর্ককে এক অমোচনীয় গভীরতা দেয়। মৃত্যুর পর মায়ের বাড়ি সংস্কার এবং তাঁর স্মরণে একটি “কুঞ্জবন” তৈরির সিদ্ধান্ত ছিল অরুন্ধতীর নিঃশব্দ কিন্তু গভীর ভালোবাসার প্রকাশ।
এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই জন্ম নেয় The Ministry of Utmost Happiness। উপন্যাসটির গঠন যেন দুটি কবরস্থানের মধ্যকার কথোপকথন—কাশ্মীরের একটি কবরস্থান এবং দিল্লির একটি কবরস্থান, যেখানে আঞ্জুম চরিত্রটি ‘জান্নাত গেস্ট হাউস’ তৈরি করে। আঞ্জুম, একজন হিজরা এবং গুজরাট গণহত্যার বেঁচে ফেরা মানুষ, উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষের গল্পকে কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এই উপন্যাসের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয় লেখকের রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং সমাজের প্রান্তিক মানুষের প্রতি তাঁর গভীর সংবেদনশীলতা।
রাজনৈতিক লেখালেখি ও সক্রিয়তার ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি রাষ্ট্রের দমননীতির মুখোমুখি হয়েছেন। “অপারেশন গ্রিন হান্ট”-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নকশালপন্থী অঞ্চলে তাঁর যাত্রা এবং জি.এন. সাইবাবার মতো তথাকথিত “আরবান নকশাল” বুদ্ধিজীবীদের প্রতি রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন নিয়ে তিনি অকপটে লিখেছেন। আফজল গুরুর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফাঁসি এবং সাইবাবার অন্যায় কারাবাস ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ভঙ্গুরতা এবং রাজনৈতিক স্বার্থে আইনের অপব্যবহারকে স্পষ্ট করে তোলে। সাইবাবার দীর্ঘ কারাবাস এবং পরবর্তী মৃত্যু লেখককে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে—যেন ব্যক্তিগত শোক আর বৃহত্তর সামাজিক অন্যায় এক বিন্দুতে এসে মিলেছে।
‘মাদার মেরি কামস টু মি’ কেবল ব্যক্তিগত স্মৃতির গাথা নয়, বরং স্মৃতি ও কল্পনার এক জটিল মিশ্রণ। লেখক নিজেকে এক “গোলকধাঁধা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেখানে মায়ের উপস্থিতি একদিকে মুক্তির দিশা, অন্যদিকে ক্রোধ ও বিদ্বেষের ছায়া। মায়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত সেই “অন্ধকারের উপহার”ই শেষ পর্যন্ত তাঁকে স্বাধীনতার পথে ঠেলে দেয়, প্রমাণ করে যে ব্যক্তিগত ট্রমা প্রায়শই সৃষ্টিশীলতার চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে।
বইটি অসামান্য—আবেগ, বেদনা, আত্মদর্শন আর অদম্য সাহসের। অরুন্ধতী রায় তাঁর শৈশবের ক্ষতচিহ্ন, মায়ের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক আর ধীরে ধীরে অর্জিত ব্যক্তিগত মুক্তিকে পাঠকের হৃদয়ে স্থাপন করেন। মেরি রয় এই আখ্যানের মূল স্তম্ভ—ভয়ঙ্কর অথচ অনন্যসুন্দর এক নারী, যিনি একই সঙ্গে তিক্ততা আর মুগ্ধতা ছড়ান। ফলে এই বইটি কেবল একটি স্মৃতিকথা নয়; এটি পরিবার, স্বাধীনতা আর স্মৃতির অস্পষ্ট প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে মানব অবস্থা নিয়ে এক বিস্তৃত ভাষ্য।
সবশেষে বলা যায়, মাদার মেরি কামস টু মি হলো ব্যক্তিগত অস্থিরতা, ট্র্যাজেডি আর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্থিতি, প্রেম আর আত্মপরিচয় খোঁজার এক শক্তিশালী যাত্রা। লেখকের “যাযাবর” সত্তা, বেপরোয়া মানসিকতা, এবং পরাজয়কে সাফল্যেরই একটি মুখ হিসেবে দেখার ক্ষমতা এই আখ্যানকে অনন্য মাত্রা দেয়। জীবন যতই কদর্য হোক, তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে নিজেকে আবিষ্কার, শিল্প এবং স্থিতিস্থাপকতা মানুষের পথ আলোকিত করতে পারে। তাই বইটি কেবল এক লেখকের জীবনের পথচিত্র নয়, বরং খ্যাতি, সম্পদ, দায়িত্ব এবং নৈতিকতার জটিলতাগুলো নিয়ে এক গভীর প্রতিফলন। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিকের নিবিড় সংমিশ্রণ অরুন্ধতী রায়ের লেখাকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে—যেখানে আত্মজীবনীর ভেতর দিয়েই উঠে আসে অস্থির ভারতের এক মর্মস্পর্শী প্রতিকৃতি। প্রতিটি ব্যক্তিগত ক্ষত, প্রতিটি বিদ্রোহ, বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিশে এক অখণ্ড বয়ান রচনা করেছে। এটি নিঃসন্দেহে এক হৃদয়বিদারক এবং শক্তিশালী আখ্যান, যা পাঠককে নিজের জীবন, এবং নিজের অন্তর্নিহিত শক্তি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। এটি যেমন ব্যক্তিগত সাহস ও শিল্পের গল্প, তেমনি ভারতীয় সমাজ ও মানবাধিকারের প্রশ্ন নিয়ে এক নির্ভীক উচ্চারণ।