মাই নেম ইজ ইসাবেল আয়েন্দে
অতল শোক থেকে ইতিহাসের আরেক ধ্বস্ত অধ্যায়কে তুলে আনতে চেয়েছেন আয়েন্দে তাঁর উপন্যাসে
নতুন কাহিনি শুরু হবার আগে, যেন কোথাও দুঃখ আর মৃত্যু চুপচাপ মেঝেতে বসে আছে, সেইরকম একটা অনুভব বুকে জমা হয়। এমন এক গৃহযুদ্ধ, যার রক্ত এখনো মাটি থেকে শুকোয়নি, আর তারই ছায়াতলে এক পতিত রাষ্ট্রপতির আত্মহননের রুদ্ধশ্বাস চিত্র। সেইসব কষ্টগাঁথা নিয়েই ইসাবেল আয়েন্দের নতুন উপন্যাস My Name is Emilia del Valle.
এখানে গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন এমিলিয়া দেল ভালে, ক্যালিফোর্নিয়ার এক নবীন সাংবাদিক। ১৮৯১ সালে চিলিতে তাকে পাঠানো হয় রিপোর্টিংয়ের জন্য—সেখানে কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি হোসে ম্যানুয়েল বালমাসেদার অনুগতদের দ্বন্দ্ব রক্তাক্ত রূপ নিচ্ছে। পাঠক যেন সঙ্গে সঙ্গে সময়ের পেছনে চলে যান, ইতিহাসের ক্ষতচিহ্নে হাত রাখেন, আর এমিলিয়ার চোখে দেখেন কীভাবে সংবাদ আর সহানুভূতির মধ্যবর্তী রেখায় দাঁড়িয়ে একজন মানুষ ধীরে ধীরে নিজেকেই খুঁজে পান।
এক সাক্ষাৎকারে ৮২ বছর বয়সী ইসাবেল আয়েন্দে বলেন, "আমি সেই গৃহযুদ্ধ নিয়ে চিরকাল কৌতূহলী ছিলাম,...ওই যুদ্ধে যতজন চিলিয়ান মারা গেছেন, তা পেরু আর বলিভিয়ার বিরুদ্ধে চার বছরের যুদ্ধে নিহতদের চেয়েও বেশি। মানুষ যেন পশুর মতো একে অপরকে মারছিল।"
উপন্যাসের রাষ্ট্রপতি বালমাসেদার করুণ পরিণতি আসলে চিলি-আমেরিকান এই লেখিকার চাচা সালভাদোর আয়েন্দের ভাগ্যেরই পূর্বপ্রতিচ্ছায়া—১৯৭৩ সালে, যাঁর সঙ্গে ইতিহাস যেন একই কুশীলবের দু'টি রক্তাক্ত অধ্যায় রচনা করে। উভয়েই ছিলেন প্রগতিশীল নেতা, যাঁদের বিরুদ্ধে সংসদ এবং দক্ষিণপন্থীরা একত্রিত হয়ে দেয়াল তুলে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত, আত্মহত্যাই ছিল তাঁদের দুজনের শেষ আশ্রয়।
সালভাদোর আয়েন্দে আত্মহত্যা করেছিলেন ১৯৭৩ সালে, যখন জেনারেল অগুস্তো পিনোচেত এক রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন। সেই একতরফা দমন-পীড়নের শাসন স্থায়ী হয় সতেরো বছর, আর রেখে যায় চল্লিশ হাজারেরও বেশি নির্যাতিত মানুষের করুণ নামলিপি।
এই অতল শোক থেকে ইতিহাসের আরেক ধ্বস্ত অধ্যায়কে তুলে আনতে চেয়েছেন আয়েন্দে তাঁর উপন্যাসে—যেটি ইংরেজিতে প্রকাশ পেয়েছে ৬ই মে মঙ্গলবার, আর স্প্যানিশ সংস্করণ আসছে ২০ মে। কিন্তু কাহিনির কেন্দ্রে তিনি চাননি কোনো মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যকে। বরং এক তরুণী, যিনি রাষ্ট্রের নয়, মানুষের কাছে প্রশ্ন করেন। সেই সূত্রেই জন্ম নেয় এমিলিয়া দেল ভালে—চব্বিশ বছরের, চটপটে, আগ্রহী, নির্ভীক। তাঁর শরীরে মিশে আছে চিলির রক্ত, কারণ জন্মদাতা পিতা ছিলেন সেখানকার—বিবাহবহির্ভূত জন্ম হলেও। এমিলিয়া চিলিতে যাচ্ছেন যুদ্ধ কাভার করতে, কিন্তু শুধু সংবাদ সংগ্রহ নয়, তিনি খুঁজছেন নিজের শিকড়ও—একটা পরিচয়, যা হয়তো ধ্বংসস্তূপের নিচে কোথাও চাপা পড়ে আছে।
“সবকিছু সহ্য করার পরও এমিলিয়া এই দেশকে ভালোবেসে ফেলে,” এমনভাবে আয়েন্দে, যিনি আবারও তাঁর লেখায় ক্যালিফোর্নিয়া আর চিলির মধ্যেকার এক অদৃশ্য সেতুবন্ধ গেঁথে দেন। যুদ্ধের মাঠে এমিলিয়ার দেখা হয় অ্যাঞ্জেলিতা আয়ালেফ-এর সঙ্গে, যিনি একজন মাপুচে নারী এবং "ক্যান্তিনেরা" নামে পরিচিত সেই নারীদের একজন—যাঁরা সেনাবাহিনীর পেছনে ছায়ার মতো হাঁটেন, সৈনিকদের খাওয়ান, ওষুধ দেন, আর অজস্র অদৃশ্য কাজ করেন যেগুলোর ইতিহাসে নাম থাকে না।
এই নারীরা কারা ছিলেন, এই ক্যান্তিনেরা? ইতিহাস তাদের কণ্ঠ দেয় না, তাদের কোনো ব্যক্তিত্ব নেই, নাম নেই, অথচ তাদের কাজ ছিল একেবারে সৈনিকের মতো, আর তারা মরেছেও সৈনিকের মতো করেই।
আইরিশ ক্যাথলিক মা আর মেক্সিকান বংশোদ্ভূত সৎবাবার ছায়ায় বড় হওয়া এমিলিয়ার জীবনে ধর্ম নতুন কিছু নয়। সবসময় তার গলায় ঝোলে গুয়াদালুপের ভার্জিনের এক ছোট্ট লোকেট। সৎবাবাকে সে ভালোবেসে ডাকে “পাপো” নামে।
এই পাপো আসলে তাঁর নিজের সৎবাবাকে শ্রদ্ধা জানানো, তিনিও এমিলিয়ার মতো তাঁর বাবাকে চিনতেন না, কিন্তু তাঁর সৎবাবা ছিলেন অসাধারণ এক মানুষ। এই চরিত্রের ভেতর দিয়ে তিনি তাঁকেই স্মরণ করছেন।
ভালোবাসা আর নির্মম সততার মিশেলে পাপো একদিন এমিলিয়াকে বলেন—“মনে রেখো, রাজকন্যে, একজন পুরুষ যতটা খ্যাতি পায়, তার অর্ধেকটা পেতেও তোমায় দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হবে।”
একজন নারী হয়ে—আয়েন্দে কি নিজেও এমন বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছেন?
উত্তরে স্মৃতির সরু গলিতে ফিরে যান ইসাবেল। মনে পড়ে যায় The House of the Spirits শেষ করে সেই প্রথম রোমাঞ্চিত মুহূর্ত—যখন পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলেন কারমেন বালসেলসকে, বার্সেলোনার প্রখ্যাত সাহিত্য এজেন্ট, যিনি ছিলেন ষাট ও সত্তরের দশকের ‘বুম’ নামক লাতিন আমেরিকান সাহিত্য আন্দোলনের অদৃশ্য নায়িকা। এই নারীর হাতে নিজের প্রথম বই তুলে দেওয়া—আয়েন্দের কাছে সেটাই ছিল এক নারীর হাত ধরে বিশ্বসাহিত্যের দরজায় পৌঁছে যাওয়া।
ইসাবেলার কাছে বালসেলসের সেই নির্মম স্পষ্ট উচ্চারণটাই ছিল একরকম বেদবাক্য: “এই উপন্যাসটা ভালো, আমি প্রকাশ করব। কিন্তু তাই বলে তুমি লেখক, সেটা বলা যায় না। আর তুমি যেহেতু নারী, পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ শ্রম দিতে হবে তোমায়।”... আর সেটাই হয়েছে বাস্তবের নামতা—সম্মান পেতে, স্বীকৃতি অর্জনে, সব কাজের জন্য দিতে হয়েছে দ্বিগুণ পরিশ্রম।
এই বালসেলসই অন্য এক রূপে জীবিত আছেন উপন্যাসের চরিত্র পাউলিনা দেল ভালে-র মধ্যে—এক সফল, স্বাধীনচেতা, নির্মমভাবে সৎ ব্যবসায়ী, যিনি এমিলিয়ার ফুফু এবং তাঁকেই সঙ্গে নিয়ে চিলির অভিজাত সমাজে প্রবেশ করান। এই পাউলিনাকে আমরা আগেও দেখেছি—Daughter of Fortune (১৯৯৯) এবং Portrait in Sepia (২০০০)-এর পাতায়। যেন একই চরিত্র, নতুন সময়ে ফিরে এসেছেন আবার, আরও এক সাহসিনীকে আশ্রয় দিতে।
যখন কারমেন ওই উপন্যাসগুলোর পাণ্ডুলিপি পড়লেন, তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘এ তো আমি!’—নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন চরিত্রে। কারমেন বালসেলস মারা যান ২০১৫ সালে।
এমিলিয়ার চোখ দিয়ে পাঠককে নিয়ে যান তিনি সেই সময়ের নিষ্ঠুর বাস্তবতায়—যেখানে যুদ্ধ মানে ছিল বুক চিতিয়ে সম্মুখসমরে লড়াই, কামানের গর্জন, আর রাষ্ট্রপতি বালমাসেদার অনুগতদের ওপর দমনপীড়নের ছায়া।
তখনকার যুদ্ধগুলো ছিল হাতাহাতি, চোখে চোখ রেখে—কিন্তু তার চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার, তখন মানুষ কম মরত। এক একজনকে আলাদাভাবে মারা হত। আজকের মতো নয়, যেখানে একবারে শ’ শ’ মানুষ নিহত হয়। আজ তো টেক্সাসে বসে কেউ একটা বোতাম চেপে ইরাকে বোমা ফেলছে—আর কতজন মরল, সেটা গোনার বাইরে চলে যাচ্ছে। সংখ্যায় রূপ নিচ্ছে মৃত্যু।
এই বইটি ইসাবেল উৎসর্গ করেছেন তাঁর ভাই হুয়ানকে, যিনি ইতিহাসভিত্তিক গবেষণায় তাঁকে সহায়তা করেছিলেন—যেন এই উপন্যাস শুধু কল্পনার নয়, একরকম নথিভুক্ত ইতিহাসও বটে।
যদিও ইসাবেল নিজে ধর্মবিশ্বাসী নন, তবুও পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর খবরে তিনি গভীর শোক প্রকাশ করেন। তাঁকে বললেন—“এক অসাধারণ মানুষ—সহজ, বিনয়ী, বুদ্ধিমান।”“আমি ওঁকে ভালোবাসতাম, কারণ উনি পোপ ছিলেন বলে নয়, বরং এই জন্য যে তিনি এমন এক গির্জাকে বদলাতে চেয়েছিলেন, যেটা তখনই ছিল ভেতর থেকে পুরনো ও ক্লান্ত।”
একইসঙ্গে, ইসাবেল শোকাহত হয়েছেন পেরুভিয়ান নোবেলজয়ী মারিও ভার্গাস যোসার মৃত্যুতে—যাঁর বিদায় যেন রেখে যায় দ্বিমত। কেউ তাঁকে শ্রদ্ধা করেন সাহিত্যে অবদানের জন্য, আবার কেউ তীব্র সমালোচনা করেন তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের, বিশেষ করে জীবনের শেষ দিকে।
“সাহিত্যিক উত্তরাধিকার অমর,” বলেন ইসাবেল। “তিনি সাহিত্যের জগতে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। রাজনীতি? ওটা আরেক গল্প। থেকে যায় যা, তা তাঁর কাজ—তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়।”
তাঁর পরবর্তী বই হবে আরেকটি স্মৃতিকথা, যার ভিত্তি তাঁর মায়ের কাছে পাঠানো প্রতিদিনের চিঠির এক বিপুল সংগ্রহ। ষোলো বছর বয়সে প্রথম চিঠি লেখেন, তারপর দিনের পর দিন সেই চিঠির নদী বয়ে গেছে মায়ের ঠিকানায়।
“স্মৃতিকথা লেখা উপন্যাসের চেয়েও কঠিন, আমার জীবনে যা ঘটেছে, তার নব্বই শতাংশ আমি ভুলে গেছি। আর যে দশ শতাংশ মনে আছে, সেগুলো আসলে সেভাবে ঘটেনি... কিন্তু যখন চিঠিগুলো দেখি, প্রতিদিনকার সেই শব্দের ভেতর দিয়ে আবার ফিরে পাই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি, ফিরে আসে মুহূর্তের অনুভব।” এমনটা বলেছেন ইসাবেল এক সাক্ষাৎকারে।
নিজের সবচেয়ে প্রিয় কাজটি এখনো করতে পারছেন বলে কৃতজ্ঞ এই লেখিকা। “আমার মাথা এখনো কাজ করে,” বলেন তিনি। “যতদিন মনোযোগ রাখতে পারব, মনে রাখতে পারব, নিজেকে পুনরাবৃত্তির ফাঁদে ফেলব না—ততদিন লিখে যেতে পারব। তবে একটা দিন আসবে, যখন আর সম্ভব হবে না।”
ইসাবেল আয়েন্দের একটি সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছিলাম বছর দুয়েক আগে। বাংলাদেশের একটি গল্পবিষয়ক লিটলম্যাগ 'গল্পকার'-এর একটি সংখ্যায় সেটি প্রকাশিত হয়। লেখক যদি আগ্রহী হোন, তাহলে সেই সাক্ষাৎকারটি ফরওয়ার্ড করতে পারি।