আজ অন্যরকম একটা বইয়ের গল্প বলি। বেবি পাউডার, আমাদের সকলের পরিচিত। এই পাউডার বানায় জোনসন অ্যান্ড জোনসন কম্পানি, এক মাফিয়া অর্গানাইজেশনের গল্প।
এই বইটিকে যদি আমরা “রোগ নিরাময়ের প্রতিশ্রুতি” নামের শ্লোগানগুলোর খোলস খুলে দেখি, তাহলে এর নিচে জোনসন অ্যান্ড জোনসনের ব্যবসায়িক কৌশলের এক শীতল, অথচ চমকপ্রদ নীলনকশা উন্মোচিত হয়—যেখানে শিশুদের জন্য বানানো পাউডারের ভেতরও আছে অ্যাসবেস্টস, যেখানে হিপ ইমপ্লান্টের পর আবার ছুরি ধরাতে হয়, আর একপ্রকারের ‘অ্যাটিপিক্যাল অ্যান্টিসাইকোটিক’ ওষুধ শিশু ও বৃদ্ধ উভয়ের শরীরে নানা ধরনের বিপর্যয় নামিয়ে আনে।
“No More Tears: The Dark Secrets of Johnson & Johnson” বইয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিক গার্ডিনার হ্যারিস দেখান কিভাবে একটি একক কর্পোরেশন তার নিরীহ ভাবমূর্তির আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে রচে এসেছে জনস্বাস্থ্যবিরোধী এক বিরাট কাহিনি। এটা মার্কিন পুঁজিবাদের সেই আদর্শ প্রতিমা, যে একদিকে “টিয়ার্স ফ্রি” দাবি তোলে, অন্যদিকে চোখে ছিটিয়ে দেয় বিষাক্ত ধুলো।
প্রথম অধ্যায়ে তিনি দেখান কীভাবে শিশুদের জন্য বানানো বেবি পাউডার, যার নামেই মমতামাখা এক কোমলতার আভাস, তা-ই আসলে অ্যাসবেস্টস-দূষিত। এরপর আসেন Procrit নামের একটি ওষুধে, যা রক্তের লোহিত কণিকা বাড়াতে ব্যবহৃত হলেও ক্যানসার রোগীদের মধ্যে টিউমার বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। আরেকদিকে রয়েছে hip implant প্রযুক্তি—যা এমনভাবে বিপণন করা হয়েছিল যেন এটি চিকিৎসাশাস্ত্রের যুগান্তকারী আবিষ্কার, অথচ এর ফলশ্রুতিতে বহু রোগীকে নতুন করে অস্ত্রোপচারের মুখোমুখি হতে হয়।
এই গল্পগুলো শুধুই পণ্যের নয়—এগুলো একসাথে টেনে আনে বিজ্ঞাপন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, FDA-এর নির্লজ্জতা, কর্পোরেট সংযোগ, এবং সবচেয়ে গভীরে, সেই অর্থনৈতিক ও নৈতিক কাঠামো যা রোগীকে পণ্য করে তোলে। গার্ডিনার দেখান কিভাবে চিকিৎসক, গবেষক, কোম্পানি এবং সরকার পরস্পরকে ব্যবহার করে এক ভয়াবহ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে—যেখানে যেটুকু সত্য আবিষ্কৃত হয়, তা প্রায়শই মামলার এফিডেভিটে, প্রেস কভারেজে নয়।
বিশেষভাবে দৃষ্টিকটু অধ্যায়টি আসে যখন গার্ডিনার তুলে ধরেন Risperdal নামক ওষুধের কাহিনি। শিশু মনোরোগ চিকিৎসকদের জন্য আইসক্রিম পার্টি, ললিপপ, লেগো সেট আর ব্র্যান্ডেড ক্যান্ডি জার—এসব দিয়েই শুরু হয় ওষুধ বিক্রির প্রলোভন। এরপর আসে তথ্য গোপনের চক্রান্ত, যেগুলো শিশুদের ওজন বৃদ্ধির সমস্যা এবং বালকদের স্তন বৃদ্ধির ঝুঁকি দেখাচ্ছিল। পরবর্তীতে এটি ব্যবহৃত হয় নার্সিং হোমে, ডিমেনশিয়া আক্রান্ত বৃদ্ধদের ওপর, যেখানে এটি স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ায়।
গার্ডিনার বলেন—FDA এদের ‘রক্ষক’ নয়, বরং প্রায়শই তাদের অ্যাবেটর। এক জায়গায় তিনি কড়া ভাষায় লেখেন, “The sad truth is that the FDA ignored, enabled, or encouraged every Johnson & Johnson disaster in this book.” তাদের কার্যক্রম এতটাই কর্পোরেট-নির্ভর হয়ে উঠেছে যে, তারা যেন নিয়ন্ত্রক নয়, বরং যৌথ উদ্যোগের অংশীদার।
তবে সবই অন্ধকার নয়। গার্ডিনার কিছু ব্যতিক্রমী “নায়কের” কথা বলেন—সাংবাদিক, ভেতরের মানুষ, এমনকি কিছু সেলস রিপ যারা হুইসলব্লোয়ার হয়ে ওঠেন। “It’s notable that over the past thirty years, it’s been the sales reps—not the executives or even the scientists—who have filed almost every whistleblower case against the industry,” লিখে গার্ডিনার এই সত্যটি স্পষ্ট করেন যে, অর্থ আর তথ্যের দৌড়ে, মানবিক বোধের খোঁজ প্রায়ই নিচতলার মানুষজনের মধ্যেই থাকে।
বইয়ের শেষাংশে গার্ডিনার যেসব প্রস্তাব দেন, তা এক কথায় সংস্কারবাদী। ওষুধ কোম্পানিগুলো থেকে চিকিৎসকদের উপহার নেওয়া নিষিদ্ধ করা, FDA-এর অর্থায়ন কাঠামো পুনর্গঠন করা, দোষী নির্বাহীদের ব্যক্তিগতভাবে অভিযুক্ত করা, এবং FDA অনুমোদনের নামে দেওয়া কিছু আইনি রক্ষাকবচ বাতিল করা—এসবই তার সংস্কার পরিকল্পনার অংশ।
এই বই তাই কেবল জোনসন অ্যান্ড জোনসনের বিরুদ্ধে একটি চার্জশিট নয়, বরং বৃহত্তর অর্থে এক জৈব-রাজনৈতিক কাঠামোর উপর অভিযোগপত্র—যেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মুখোশের নিচে লুকিয়ে থাকে কর্পোরেট তর্জনী, আর আমাদের “নিরাপত্তা” নির্ভর করে মামলার রায়ের উপর, নীতিনির্ধারকদের উপর নয়। এবং যে সময়টায় বিশ্বজুড়ে রেগুলেটরি কাঠামো দুর্বল করে ফেলা হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে এই বই হয়ে ওঠে এক অনিবার্য সতর্কবার্তা—“No More Tears” নয়, বরং “Know More Fears”।
No More Tears
The Dark Secrets of Johnson & Johnson
By Gardiner Harris.
Random House. 464 pp. $32