আচার্য ও তার অলীক পাণ্ডুলিপি
আচার্য ও তার অলীক পাণ্ডুলিপি: যেখানে রবীন্দ্রসংগীত, হার্ট অ্যাটাক, আর অসীম অক্ষমতা একসঙ্গে বসে চা খাচ্ছে।
আচার্য হারমোনিয়ামের কাছে বসে আছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ হতে চান। না, রবীন্দ্রনাথ হওয়ার স্বপ্ন দেখা বারণ নয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হওয়ার ব্যর্থতা তো আর চাইলেই ঢেকে রাখা যায় না। তাই আচার্য সুর তুলতে চান, কিন্তু গলা তাঁর সায় দেয় না। তিনি বাংলা নাটকের এক সময়ের মহারাজ, এখন তবে কী? ভবঘুরে এক সুরসন্ধানী? নাকি পরাজিত এক রবীন্দ্রানুসারী, যিনি জানেন তাঁর সৃষ্টি পাণ্ডুলিপি হয়ে জমা থাকবে, তবে অমর হবে না? অসাধারণ লেখা, এমন সাহিত্য এই দেশে হয় না! ;)
নোমান সাহেবের আচার্য ও তার অলীক পাণ্ডুলিপি পড়া শেষ হয়নি, কিন্তু ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য ওইটুকু অংশই যথেষ্ট মনে হলো। কিন্তু পড়ুয়া হিসেবে আরও একটুখানি বলতে মন চাইছে। বই পড়তে পড়তে যখন পাঠক একেবারে শেষে পৌঁছে যান, তখনও কি সত্যিই বলা যায় যে তিনি বইটি পুরোপুরি বুঝেছেন? কিংবা পড়ার আগে যা ধারণা ছিল, তার সঙ্গে পড়ার পরের উপলব্ধির কতটা ফারাক হয়? অনেক ক্ষেত্রে তো দেখা যায়, উপন্যাসের শুরুতে যা বাস্তব মনে হয়েছিল, তা শেষে এসে অলীক বলে ধরা দেয়। আবার, যেটাকে অলীক বলে ভেবেছিলেন, সেটাই সত্য বলে প্রতিভাত হয়। অবশ্য, পাঠকের স্বাধীনতা তো এক বিশাল ক্ষমতা। কেউ তা দায়িত্ব নিয়ে ব্যবহার করেন, কেউ করেন কেবল নিজস্ব আনন্দের জন্য। একেবারে শেষ লাইন পর্যন্ত পড়ে কেউ বলবে, "এই উপন্যাস তো কিচ্ছু বোঝাল না," আর কেউ প্রথম পৃষ্ঠা পড়েই বলে দেবেন, "অসাধারণ লেখা, এমন সাহিত্য এই দেশে হয় না!"
প্রথম আলোর বিজ্ঞাপনটা একেবারে ঠাস-বোকা মার্কা! "এই উপন্যাস পড়ে দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষেরা একটু চমকাবেন"—অর্থাৎ, বইটা পড়লেই বাঙালির বুদ্ধিজীবী সমাজ কালবৈশাখীর হাওয়ার মতো কাঁপতে থাকবে! যেন এতদিন তাঁরা ঘুমোচ্ছিলেন, আর এই বই পড়ামাত্রই ঝটকা মেরে উঠে বলবেন, “বলেন কি! এমন উপন্যাসও লেখা যায়!” তার উপর এই "চমকানোর" ব্যাপারটা একেবারে ঝাঁকুনির মতো শোনাচ্ছে। চমকানো মানে কী? ভয় পাবেন? আঁতকে উঠবেন? নাকি কেউ উপন্যাস পড়তে পড়তে ধপ করে চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়বেন? যদি সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষজন এত সহজে চমকে যেতেন, তাহলে কবেই তাঁরা টিকটক বুকটকের আঘাতে অজ্ঞান হয়ে যেতেন! বিজ্ঞাপন বানানোর জন্য হাইপারবোলি দরকার। কিন্তু এই উপন্যাস পড়লে মানুষ চমকে যাবে টাইপের দাবি আর এই ফেসক্রিম লাগালে আপনি ঐশ্বরিয়া রাই হয়ে যাবেন—দুটোর মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি নেই।
আপনার মনে হতেই পারে, উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমি অপ্রাসঙ্গিক আলাপে ঢুকে গেছি—কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি কেবল গল্পের ভেতরটা পড়ি না, তার বাইরের আবরণও খুঁটিয়ে দেখি। আমি প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে বাইন্ডিসের আঠা পর্যন্ত বিশ্লেষণ করি, যেন বোঝা যায়, লেখাটি শিল্পের উচ্চস্তরে পৌঁছেছে, নাকি কেবল বাজারচলতি প্যাকেজিং-এ সীমাবদ্ধ রয়েছে। বইয়ের বিষয়বস্তু তো আছেই, কিন্তু সেটাকে পাঠকের কাছে পরিবেশনের ধরনটাও কি সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়?
বইয়ের প্রচার আর বিজ্ঞাপন নিয়ে আমার পুরোনো ক্ষোভও কম নয়। এর আগে বহুবার চেঁচিয়ে বলেছি—একটা বই পাঠকের হাতে পৌঁছনোর আগে তাকে যে ভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে বাজারে নামানো হয়, সেটাও একটা শিল্প, বা অন্তত একটা কৌশল। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটাকে এমন বেহুদা, বস্তাপচা ভাষায় উপস্থাপন করা হয় যে মনে হয়, বইয়ের গুণমান নয়, বিজ্ঞাপনের চটকদারি দিয়েই পাঠককে টানা হচ্ছে।
এই বার এই বার খুকু চোখ খুলল; স্পয়লারহীন রিভিউ:
উপন্যাসের স্বাদ তার অনাকাঙ্ক্ষিত চমকের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। তাই আমি চাই না কেউ কেবল সারাংশ পড়ে গল্পের আসল উত্তেজনা, চরিত্রদের জটিলতা বা প্লটের বাঁকবদল থেকে বঞ্চিত হন। প্রতিটি শব্দের মধ্যে যে রহস্য, প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে যে অনিশ্চয়তা, সেটাই তো পড়ার প্রকৃত আনন্দ। আগেভাগে সব বলে দিলে সেই রোমাঞ্চটাই ম্লান হয়ে যায়।
পৌষের বিকেল। বৃষ্টি পড়ছে। আচার্য হার্ট অ্যাটাক করবেন দুদিন পর, এখনো সময় আছে। তিনি রিডিং রুমে বসে রবীন্দ্রসংগীত শুনছেন। হাতে চায়ের কাপ, পায়ের কাছে অনন্ত বসে আছে, যেন চন্ডীদাসের মুখোমুখি এক অনুজ। কুয়াশার আড়াল দিয়ে এক ঝাঁক ভিখিরি দৌড়ে যাচ্ছে, দূরে পুলিশের বাঁশি। কিন্তু আচার্যের মাথায় এখন এসব নেই, তিনি ভাবছেন গান নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের অমরত্ব নিয়ে। বেঁচে থাকার একমাত্র রাস্তা সংগীত। কবিতা, গল্প, নাটক দিয়ে কিছুই হয় না, মানুষ গান মনে রাখে। আর তিনিও গান লিখতে চান।
স্বকৃত নোমানের আচার্য ও তার অলীক পাণ্ডুলিপি একটা ম্যাজিক ট্রিক। প্রথমে মনে হবে, এক বৃদ্ধ সাহিত্যিকের জীবনকাহিনি পড়ছি। একটু এগোলেই বোঝা যাবে, এটা আসলে একটা বিদ্রূপাত্মক ধাঁধা। পাঠককে কনুই মেরে বলা হয়, "দেখলেন? এখানে যা হচ্ছে, বাস্তবে তাই হয়। এই দুনিয়ায় সবাই অক্ষমতার স্বীকারোক্তি দেয় না, কিন্তু মনে মনে জানে, সে কিছুই পারে না।" আচার্য এই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের গানের মহিমায় অবনত হয়ে তিনি নিজেকেও ব্যর্থ মনে করেন। গান লিখতে পারেন না, সুর দিতে পারেন না, গাইতেও পারেন না—তবে চেষ্টা চলছে।
তবে গল্প শুধু সংগীতপ্রেমী বৃদ্ধের নয়, তার চারপাশের সংঘাতেরও। স্ত্রী রাফিদার ক্রোধ, তার ছাত্রীরা (পুত্রীসুলভ, কিন্তু গানের জন্য ব্যবহৃত), পারিবারিক ঠান্ডা যুদ্ধ—সব মিলিয়ে এক ধরনের কাব্যিক বিশৃঙ্খলা। সংসার চলছে, তবু চলছে না। সম্পর্কের মধ্যে অস্বস্তি আছে, আছে টানাপোড়েন, আছে এমন এক বোঝাপড়া যেখানে কেউ কাউকে নাড়িয়ে দেয় না, কারণ সেটাই সবচেয়ে নিরাপদ। এই স্ট্যাটাস-কোয়াইয়েট ভেঙে যায় সংগীতের উন্মাদনায়।
আচার্যের স্ত্রী রাফিদা চরিত্রটি চিৎকার করেন না, কিন্তু চিৎকারের মতোই তীব্রভাবে স্বামীর জীবনযাত্রাকে কটাক্ষ করেন। (আমি কবি রফিক আজাদের ঘরে এমন চরিত্র দেখেছিলাম, আর আমার ঘরও যে তার ব্যতিক্রম, তা বলা যাবে না!) আচার্যের গান লেখার বাসনা নিয়ে তার অবিরাম সন্দেহ আর বিদ্রূপ মূলত একটা গভীর অস্বস্তিকে আড়াল করে—একটা সম্পর্কের কোল্ড ওয়ার।
গল্প এগোয় আর পাঠক অনুভব করে, এটা কি আচার্যের গল্প, নাকি আমাদের সবার? বাঙালির চিরন্তন আত্মপ্রতারণা—আমরা যা নই, হতে চাই, আর হতে না পারলে মহত্বের মোড়কে সেটাকে ঢেকে ফেলি। রবীন্দ্রনাথের নাম নিয়ে আমরা আমাদের অক্ষমতাকে বৈধতা দিই, নিজের ব্যর্থতার ওপর একটা মহৎ ব্যাখ্যা বসিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি।
গল্পের ভাষা একদম খোঁচানো ধারালো আবার মলম মেশানো, সরু একটা ব্লেড দিয়ে সমাজের আবরণ চেঁছে ফেলা হচ্ছে। এই টেক্সটে বাস্তবতার সঙ্গে জাদুবাস্তবতার খেলা চলে। (আসলে আমি জাদুবাস্তবতা বলতে বুঝি, বৃষ্টি এলে শহর ডুবে যায় না, বরং রাস্তায় পদ্মফুল ফোটে।)
রবীন্দ্রসংগীতের সিডি কেনার গল্পের মধ্যে আচার্যের অলীক ব্যর্থতা, সম্পর্কের শীতলতা, সংসারের টানাপোড়েন এমনভাবে মিশেছে যে, পাঠক কখন হাসবে আর কখন বিষণ্ণ হবে, তা ঠিক করতে পারে না।
স্বকৃত নোমানের ভাষার মধ্যে আছে প্রচণ্ড ব্যঙ্গ, কিন্তু আশ্চর্যভাবে তা কখনোই অতি-আবেগী হয়ে ওঠে না। (হতেও পারে আমি জানি না, উনি মন না বলে বলেন মানবহৃদয়, অভ্রতে এই ছয় অক্ষর লিখতে খরচ হয়েছে বারোটা) বরং এক নিখুঁত ছন্দে চলতে থাকে, ঠিক যেমন আচার্যের চোখ বন্ধ করে রবীন্দ্রসংগীত শোনা। গল্পের শেষে পাঠকের মনে হতে পারে, আমরা সবাই হয়তো আচার্য, আমাদের সবার একটা অলীক পাণ্ডুলিপি আছে, যেখানে আমরা নিজেদের মহত্ত্বের কল্পনা লিখি, অথচ জানি, সত্যি বলতে, আমরা কেউই রবীন্দ্রনাথ হতে পারব না।
উপন্যাসটি সেইসব পাঠকদের জন্য যারা ভাবতে চান, যারা ব্যঙ্গ আর বাস্তবতার মাঝখানে হারিয়ে যেতে ভালোবাসেন। আর যারা রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে নিজের ব্যর্থতা নিয়ে খানিকটা গর্ব অনুভব করেন।