খাঁচার বাহবা
বাংলাদেশের সমাজে যারা পরিবর্তনের দাবি তুলছে, তারা জানে, তাদের পথ সহজ নয়। গায়ের রঙ, ধর্ম, শ্রেণি, লিঙ্গ, ভাষা—এসবকে কেন্দ্র করে বৈষম্যের যে দেয়াল, তা রাতারাতি ভাঙা যাবে না।
বাংলাদেশে একদিন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বান এল। শুধু কাগজ-কলমে নয়, আসলেই এল। আন্দোলন যে সত্যি, তার প্রমাণ এই যে, সেটা শুধুই মিছিল আর ফেসবুক পোস্টের ঢেউ হয়ে মিলিয়ে গেল না, বাস্তবের মাটিও কেঁপে উঠল। চাকরির কোটা সংস্কারের দাবি, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, নারীদের প্রতি কাঠামোগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল মানুষ। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সমাজের ভিতটাই যেন কেঁপে উঠেছে। দারসুন-বাবুদের সন্তানেরা রাস্তার ব্যারিকেডের সামনে দাঁড়িয়ে গেল, শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা গার্মেন্টস কর্মীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করল, এমনকি বৈষম্যের প্রাচীরে কাঁটা লাগানো ‘ধর্ম’ পর্যন্ত টলতে শুরু করল।
বিপ্লব এমনই জিনিস—সে কাউকে নোটিশ পাঠায় না। যার ভেতরে প্রাণ আছে, সে ঠিকই সময় বুঝে উঠে দাঁড়ায়। মানুষের অধিকার জন্মগত, কেউ অনুগ্রহ করে তা দেয় না। আন্দোলনের প্রথম দিনগুলোয় মনে হচ্ছিল, জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণের বেড়া একলহমায় ভেঙে পড়বে, নিপীড়িতের কণ্ঠ এবার সত্যিই পৌঁছাবে রাষ্ট্রের উঁচু কক্ষগুলোয়।
কিন্তু সেই জোয়ার নামল। আনন্দ-মিছিল হল। এরপর একদিন দেখলাম, যারা একসময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলেছিল, "আমাদের অধিকার চাই," তারাই এখন বলছে, "যা আছে তাই থাকুক, এই দেশেও তো মানুষ কম কষ্টে নেই!" এখন আবার সমাজ পুরনো বাঁধনকে পবিত্র ঘোষণা করে বলছে, “অবস্থা যা আছে, সেটাই ঠিক, বদল আনতে গেলে নাকি বিশৃঙ্খলা হয়!”
এখন আমরা আত্মপ্রসাদে গদগদ হয়ে বলছি—“দেখো, আমাদের দেশে কী অপূর্ব সামাজিক সহাবস্থান! সব জাত, সব ধর্ম একসঙ্গে বাস করছে!” অথচ বাস্তবতা হলো, চাকরি পাওয়ার সময়, বাসা ভাড়ার সময়, বিয়ের সময়, সামাজিক মঞ্চে দাঁড়ানোর সময় কেউ কেউ বিশেষ সুবিধা ভোগ করে, আর কেউ কেউ ন্যূনতম মর্যাদাটুকুও পায় না। বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললেই জবাব আসে—“নিয়মের বাইরে চলে গেলে সমস্যা হয়, তুমি কেন সমস্যা খুঁজছ?”
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই নিয়ম কাদের জন্য? এই আইন, এই নীতি কাদের স্বার্থ রক্ষা করে? পাহাড়ি জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে ভূমি হারিয়ে যাচ্ছে, শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরি চায়, নারীরা নিরাপদ কর্মক্ষেত্র চায়, সংখ্যালঘুরা সমান মর্যাদা চায়—এসব কি ‘বিশৃঙ্খলা’ নাকি ন্যায়বিচারের দাবি?
দেখুন, যারা কাজ করছে, তারা বাহবা চায় না। বরং যারা কিছু করে না, তারাই নিজের অলসতা ঢাকতে বাহবার খাঁচা তৈরি করে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা যখন রাষ্ট্রের নীতি বদলাতে চায়, তখন রাষ্ট্রই প্রশ্ন তোলে—"বদলানো কি প্রয়োজনীয়? আমাদের সমাজ তো এমনিতেই দারুণ সুন্দর!" আসো দলে ভেড়।
এই যে আত্মতুষ্টির ঢোল, এটা মূলত তাদেরই লাগে যারা নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চায়। ওদিকে পশ্চিমা বিশ্বে আমরা গিয়ে তাদের শাসকদের বলি, "তোমরা সাম্রাজ্যবাদী, তুমি নিপীড়ক!" তারা শুনেও হাসে। তারা জানে, আমরা আসলে আমাদের নিজেদের বৈষম্য ঢাকতে চাই। ওরা অন্তত সামনে এগিয়ে চলেছে, নিজেদের ভুল স্বীকার করে শোধরানোর চেষ্টা করছে। আর আমরা? আমরা বাঁধন আঁকড়ে ধরে বলছি, “এটাই আসল ঐতিহ্য!”
আমাদের সমাজের কাজ এখন শুধু একটা—পথ বন্ধ করা, যতটা সম্ভব শৃঙ্খল মজবুত করা। তাই যারা পথ ভাঙতে চায়, তারা সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার হয়। যারা পাহাড়িদের অধিকার নিয়ে কথা বলে, যারা নারীবাদী নীতির কথা বলে, তাদের তকমা জুটে যায়—‘উগ্র’, ‘বিতর্কিত’, ‘বিশৃঙ্খল সৃষ্টিকারী’।
কিন্তু বাধা দিয়ে লাভ হবে না। জাগরণ মানে শুধু একদল মানুষ জাগবে না—যারা রাস্তায় নামবে, তারা যেমন জাগবে, যারা বাধা দেবে তারাও জাগবে।
বাংলাদেশের সমাজে যারা পরিবর্তনের দাবি তুলছে, তারা জানে, তাদের পথ সহজ নয়। গায়ের রঙ, ধর্ম, শ্রেণি, লিঙ্গ, ভাষা—এসবকে কেন্দ্র করে বৈষম্যের যে দেয়াল, তা রাতারাতি ভাঙা যাবে না। কিন্তু খাঁচার বাহবা দিয়ে কেউ মুক্তি পায় না, খাঁচা ভাঙার স্পর্ধা থাকলেই তবেই মুক্তি আসে।
এই পথ চলবেই। কারণ পথচলা মানেই মুক্তির স্রোত, আর স্রোত মানেই জীবন। খাঁচার আয়ুর চেয়ে একঝাঁক মুক্ত পাখির ওড়াই অনেক বেশি সার্থক।