বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সম্ভাব্য ঝড় এবং ডলারের ভবিষ্যৎ: একটি বিশ্লেষণ
বর্তমানে আমেরিকার অর্থনৈতিক নীতি এবং এর বৈশ্বিক প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষ করে, জাতীয় ঋণ বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতি এবং ডলারের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রার মর্যাদা হারানোর ঝুঁকি নিয়ে আলোচ
আমি আমার শহর আটলান্টার এক বুকক্লাবের সদস্য। আমরা প্রতি সপ্তাহে একটি সদ্য প্রকাশিত বা প্রকাশিতব্য বই পড়ি। মূলত এই বইগুলো পাবলিশার্সের কাছ থেকেই আসে। তবে ভালো রিভিউ বা পড়তেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। গত সপ্তাহে আমরা পড়লাম হার্ভার্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কেনেথ রোগফের ‘আওয়ার ডলার, ইয়োর প্রবলেম’ বইটি।
বর্তমানে আমেরিকার অর্থনৈতিক নীতি এবং এর বৈশ্বিক প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষ করে, জাতীয় ঋণ বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতি এবং ডলারের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রার মর্যাদা হারানোর ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই বইটিতে। হার্ভার্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কেনেথ রোগফ এই পরিস্থিতিকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি 'পারফেক্ট স্টর্ম'-এর আগমনী বার্তা হিসেবে দেখছেন।
উৎস অনুযায়ী, হোয়াইট হাউস যেখানে সারা বিশ্বের সাথে শুল্ক যুদ্ধ (tariff war) নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে কংগ্রেস একটি বাজেট বিল প্রস্তুত করছে যা প্রায় একই রকম পরিণতির কারণ হতে পারে। যদি এটি ট্রাম্পের ২০১৭ সালের কর ছাড় (tax cuts) নবায়ন করে এবং তার প্রস্তাবিত নতুন কর ছাড়গুলোও কার্যকর করে, একই সাথে যদি ব্যয় কমানো না হয়, তাহলে এটি আগামী দশ বছরে জাতীয় ঋণে অতিরিক্ত ৯ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করবে। পিটার জি. পিটারসন ফাউন্ডেশনের (Peter G. Peterson Foundation) মতো নিরপেক্ষ সংস্থাগুলোর মতে এই তথ্য। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা সম্ভবত ইতিহাসে জিডিপির শতাংশ হিসেবে তার সবচেয়ে বড় ঘাটতিগুলোর মধ্যে একটিতে উপনীত হবে, এবং এটি ঘটছে শান্তিকালীন সময়ে, কোনো মহামারী ছাড়াই।
এই বিশাল ঋণ এবং ঘাটতির সাথে যুক্ত হয়েছে সুদের হার বৃদ্ধি। বছর ধরে সুদের হার নিম্নগামী থাকার পর এখন তা ঐতিহাসিক স্বাভাবিক স্তরে উঠেছে এবং তা সম্ভবত উঁচুতেই থাকবে। রোগফের মতে, এই উচ্চ সুদের হারই আমেরিকার ঋণ বোঝাকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। ঋণের উপর সুদ এখন বছরে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা প্রায় প্রতিরক্ষা ব্যয়ের সমান। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ নিল ফার্গুসন (Neil Ferguson) পরামর্শ দিয়েছেন যে যখন এমনটি ঘটে, তখন একটি মহান শক্তি তার মহানত্ব হারানোর ঝুঁকিতে পড়ে।
কেনেথ রোগফ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে একটি অর্থনৈতিক ঝড় আসছে। তিনি মনে করেন, ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতিগুলো যদি কঠোরভাবে উল্টানো না হয়, তাহলে এই রাষ্ট্রপতি মেয়াদের শেষ নাগাদ একটি আর্থিক সংকট (financial crisis), বা মুদ্রাস্ফীতি (spiraling inflation), বা উভয়ই হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% বা তার বেশি।
উৎসগুলো ডলারের কেন্দ্রীয় ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরেছে। আমেরিকাবাসী ডলারের "অতিরিক্ত সুবিধা" (exorbitant privilege) থেকে প্রভূত সুবিধা পায়, কারণ এটি বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা। রোগফ ব্যাখ্যা করেছেন যে এটি আমেরিকাকে আরও সস্তায় ঋণ নিতে সাহায্য করে, তা মর্টগেজ, গাড়ির ঋণ বা ক্রেডিট কার্ড ঋণ যাই হোক না কেন। তিনি অনুমান করেছেন যে ডলারের কারণে আমেরিকানরা তাদের ঋণের উপর প্রায় অর্ধ শতাংশ থেকে ১% পর্যন্ত ছাড় পায়।
তবে, ডলারের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এখন ঝুঁকির মুখে। উৎসগুলো অনুযায়ী, কিছু চাপ আমেরিকার নিয়ন্ত্রণের বাইরের ঘটনার কারণেও সৃষ্টি হয়েছে। অন্যান্য দেশ সর্বদা ডলারের উচ্চ মর্যাদা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল, বিশেষ করে যখন আমেরিকা এটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। ওয়াশিংটন যথেচ্ছভাবে dozens of countries-এর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, প্রায়শই একতরফাভাবে, এবং এই নিষেধাজ্ঞাগুলো কেবল ডলারের বিশেষ মর্যাদার কারণেই কাজ করে। ইউরোপীয়রা, চীনারা, রুশরা এবং প্রায় প্রতিটি বড় দেশ নীরবে ডলারের উপর তাদের নির্ভরতা কমানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এটি একটি ধীর প্রক্রিয়া হলেও এটি কেবল একটি দিকেই এগোচ্ছে – ডলার থেকে দূরে। যদিও আমেরিকার মুদ্রার কোনো একক বিকল্প নেই, রোগফ বিশ্বাস করেন যে ডলার অন্যান্য মুদ্রার একটি ঝুড়ি এবং বিটকয়েনের মতো বিকল্পগুলোর কাছে তার অংশ হারাবে।
এই পরিস্থিতি কেবল ট্রাম্পের নীতিগুলোর কারণে নয়। রোগফ যুক্তি দেন যে বছর ধরে আমেরিকার আর্থিক নীতিতে একটি দ্বিদলীয় বেপরোয়া মনোভাব দেখা গেছে। রিপাবলিকানরা কর কমিয়েছে এবং ডেমোক্র্যাটরা ব্যয় বাড়িয়েছে, উভয় পক্ষই সংযম ছাড়াই কাজ করেছে। তবে, এটি লক্ষণীয় যে গত ২৫ বছরে জিডিপি অনুপাতের ঋণের বেশিরভাগ বৃদ্ধির জন্য কর ছাড়ই দায়ী।
রোগফ আরও গভীরভাবে চিন্তিত যে ফেডের স্বাধীনতা (Federal Reserve's independence compromised) হচ্ছে, এটি ডান ও বাম উভয় দিক থেকেই ঘটছে। যদিও এটি উল্লেখযোগ্য যে ট্রাম্পই প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি নিয়মিত ফেডকে আক্রমণ করেছেন, এর চেয়ারকে বরখাস্ত করার হুমকি দিয়েছেন এবং এর মতো স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের বৈধতাকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছেন। রোগফ বলেছেন, ডলারের ভূমিকার বেশিরভাগই আসে ভাল, স্থিতিশীল, অনুমানযোগ্য নীতি, রাজনৈতিক চাপ থেকে ফেডের স্বাধীনতা এবং বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার বিশ্বস্ততার খ্যাতি থেকে। তিনি মনে করেন, এই সবগুলোকে নষ্ট করলে ডলার প্রভাবিত হবেই।
উৎসগুলো অনুযায়ী, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় অবশ্যই আছে, তবে কোনোটিই পেইনলেস নয়। কিছু সঞ্চয় প্রচেষ্টার ব্যর্থতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন ডজ (Dodge), যা ট্রিলিয়ন ডলার সঞ্চয়ের দাবি করলেও যাচাইযোগ্য সঞ্চয়ের পরিমাণ অনেক কম ছিল। এর চেয়েও বড় কথা, এটি বিশাল বাজেট ঘাটতির তুলনায় নগণ্য। তাই, ঘাটতি কমানোর পথ হলো বড় প্রোগ্রামগুলোর (যেমন মেডিকেয়ার, সোশ্যাল সিকিউরিটি এবং প্রতিরক্ষা) ব্যয় কমানো এবং কর বৃদ্ধি করা। কিন্তু আমেরিকা উল্টো পথে হাঁটছে বলে মনে করা হচ্ছে: বিশাল কর ছাড় কার্যকর করা হচ্ছে এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় ১৩% পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে।
রোগফ উপসংহারে বলেছেন যে আমেরিকা গত কয়েক দশক ধরে স্মার্ট এবং ভাগ্যবান, যা তাকে কোনো দৃশ্যমান খরচ ছাড়াই ঘাটতি চালাতে সাহায্য করেছে। কিন্তু তার মতে, আমেরিকার অর্থনৈতিক নীতি এখন "dumb" বা মূর্খ। তিনি এটিকে তার "জীবনের সবচেয়ে খারাপ" নীতি বলে অভিহিত করেছেন এবং মনে করেন আমেরিকার সুদিন হয়তো শেষ হয়ে গেছে।