নিঃশব্দের শৈল্পিকতা
মানুষের জীবনে কিছু জায়গা থাকা দরকার, যেখানে সে 'গায়েব' হয়ে যেতে পারে—যেখানে কেউ প্রশ্ন করবে না, কেউ রেকর্ড রাখবে না, এমনকি নিজেও জানবে না সে কোথায় ছিল।
আজকাল গোপনীয়তা মানে যেন শুধু ডাটা সামলানো আর নজরদারি এড়ানো। সারাক্ষণ সেটিংস ঠিক করা, ব্রাউজারের কুকিজ উপেক্ষা করা, আর সিগন্যালের মতো নিরাপদ অ্যাপ ব্যবহার করাই আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। অথচ রাজনীতি বিশেষজ্ঞ লরি প্রেসলি বলছেন, গোপনীয়তা মানে শুধু তথ্য লুকিয়ে রাখা নয়, বরং এমন এক জায়গা তৈরি করা, যেখানে ডিজিটাল চোখ পৌঁছাতে পারে না। তিনি 'ভুলে যাওয়া'কে গুরুত্ব দেন—ব্যাখ্যা করেন, গোপনীয়তা কেবল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা নয়, বরং জীবনের সেই অনুচ্চারিত, অনলিখিত অংশগুলোর আশ্রয়স্থল। যেখানে অনুভূতি, সৃজনশীলতা আর নিজেকে হারিয়ে ফেলার সুযোগ থাকে, যেখানে কোনো রেকর্ড থাকে না, কোনো নজরদারি নেই।
মানুষের জীবনে কিছু জায়গা থাকা দরকার, যেখানে সে 'গায়েব' হয়ে যেতে পারে—যেখানে কেউ প্রশ্ন করবে না, কেউ রেকর্ড রাখবে না, এমনকি নিজেও জানবে না সে কোথায় ছিল। একসময় মানুষের এই ধরনের জায়গা ছিল—জলাভূমির ধারে, সন্ধ্যার উঠোনে, কিংবা বৃষ্টির রাতে একা হাঁটার সময়। এখন সেইসব হারিয়ে যাচ্ছে। শহরজুড়ে সিসিটিভি, হাতে স্মার্টফোন, অনবরত নোটিফিকেশন। আমাদের প্রতিটি পা-ফেলার শব্দই যেন কোথাও রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে।
একটা সময় ছিল, মানুষ সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে থাকত, আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবত—'আমার অস্তিত্বের কোনো দাগ থাকবে না, এমন একটা জায়গায় যদি চলে যেতে পারতাম!' আজকাল সেটাও সম্ভব নয়। মানুষের মনের গোপন অংশগুলো পর্যন্ত আর নিজের থাকে না, কারণ সেগুলোরও বিশ্লেষণ হয়, অ্যালগরিদম দিয়ে গণনা করা হয়।
তাই প্রেসলির ভাবনা শুধু গোপনীয়তার প্রশ্ন নয়, বরং একটা নস্টালজিয়া—একটা সময়ের জন্য, যখন ভুলে যাওয়াটা সম্ভব ছিল। যেভাবে হারিকেনের আলোয় কেউ বসে থাকত আর বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যেত, তেমন একটা জায়গা, যেখানে কোনো লগইন লাগবে না, কোনো পাসওয়ার্ড মনে রাখতে হবে না, কেউ জিজ্ঞেস করবে না—'তুমি শেষবার অনলাইনে ছিলে কবে?'
গোপনীয়তা মানে নিজের কিছু সময় নিজের কাছে রাখা। যেখানে কেউ টের পাবে না, কেউ প্রশ্ন করবে না—তুমি কোথায় ছিলে, কী করছিলে? এটা সেই রকম, যেমন মধ্যরাতে হঠাৎ উঠে বসা, জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকা, অথবা একটা পুরনো চিঠি খুলে পড়া, যা কাউকে দেখানোর জন্য লেখা হয়নি।
কিন্তু এখন? এখন প্রতিটি চিঠি যেন আগে থেকেই কারো চোখে পড়ে থাকে। ফোন হাতে নিলেই নোটিফিকেশন বলে দেয়, তুমি কী দেখবে, কী পড়বে, কী নিয়ে ভাববে। তুমি কার সাথে কথা বলবে, সেটাও যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি ঠিক করে দেয়। প্রেসলি বলছেন, এটাই আসল বিপদ—আমরা নিজেরাই নিজেদের পর্যবেক্ষণ করতে শিখে গেছি। কেবল কর্পোরেশন নয়, আমরা নিজেরাই নিজেদের এমনভাবে দেখি যেন সবকিছু লিপিবদ্ধ করতে হবে, যেন জীবনটা কোনো ডাটাবেসের প্রবেশযোগ্য তথ্যমাত্র।
একজন মানুষ রিকশায় বসে আছে, কিন্তু সে জানে না, তার গতিবিধি ট্র্যাক হচ্ছে। হয়তো কেউ গভীর রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, কিন্তু তার সার্চ হিস্ট্রি বলে দিচ্ছে, সে কী নিয়ে চিন্তা করতে পারে। এই অবস্থায় গোপনীয়তা শুধু অধিকার নয়, বরং এক প্রকার স্বাধীনতা, যা হারিয়ে গেলে মানুষের জীবনটা আর গল্পের মতো থাকবে না—হয়ে যাবে নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণযোগ্য একটা অ্যালগরিদমিক কাঠামো।
একটা মানুষকে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে গেলে তাকে ভুল বুঝতে হয়। কারণ মানুষ কখনোই পুরোপুরি ধরা দেয় না, ধরা দেয়ার জন্য তৈরি হয়নি। কিন্তু যখনি তাকে ক্যামেরা, ডকুমেন্ট, কিংবা অ্যালগরিদমের মধ্যে স্থায়ীভাবে আটকে ফেলা হয়, তখন তার ব্যক্তিস্বাধীনতা হারিয়ে যায়। একটা সময় ছিল, কেউ চাইলে নিজের পরিচয় বদলাতে পারত—গ্রাম ছেড়ে শহরে গেলে, শহর থেকে অন্য কোথাও চলে গেলে, সে অন্যরকম হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু এখন? এখন গুগল, ফেসবুক, সিসিটিভি—সবাই যেন বলে দেয়, 'তুমি কে'।
একজন নামহীন পথচারী শহরের এক ব্যস্ত মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন, মনে মনে ভাবছেন, 'আমি যদি হুট করে হারিয়ে যাই, কেউ খুঁজে পাবে?' অথচ তিনি জানেন, খুঁজে পাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র—তার ফোনের লোকেশন, তার ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন, তার গুগল ম্যাপে দেখা পথ—সবই বলে দেবে, তিনি কোথায় গেছেন, কী করেছেন। প্রেসলির বিশ্লেষণ এখানেই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি দেখাচ্ছেন, একসময় যারা নিজেদের চিত্রায়িত হতে দিতে চাইতেন না, আজ তারা নিজেরাই প্রতিদিন নিজের ছবি তুলছে, নিজের গতিবিধি লিপিবদ্ধ করছে, আর গোপনীয়তা নামক অনুভূতিটাকে স্মৃতির মতো দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
মানুষের জীবনে এমন কিছু জায়গা থাকা উচিত, যেখানে কেউ প্রবেশ করবে না, কেউ প্রশ্ন করবে না, কেউ জানতে চাইবে না। গোপনীয়তা মানে শুধু লেনদেনের তথ্য বা ব্যক্তিগত চ্যাট রক্ষা করা নয়; বরং এমন এক পরিসর তৈরি করা, যেখানে মানুষ তার অজানা দিকগুলো নিয়ে বাঁচতে পারে। এই নীতিহীন বিশ্বে গোপনীয়তাই হয়তো একমাত্র নীতি, যেখানে অন্যের না-জানা অংশটুকুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া যায়।
একজন বৃদ্ধ তার বাগানে বসে আছেন, সামনে ছড়ানো কিছু পুরনো চিঠি। কেউ জিজ্ঞেস করলে তিনি হয়তো বলতেন, ‘এগুলো ব্যক্তিগত, কারও দেখার দরকার নেই।’ কিন্তু এখন? এখন সেই পুরনো চিঠিগুলো আর লেখা হয় না। কারণ, মানুষের অনুভূতিগুলোও ধরা পড়ে যায়, বিশ্লেষণ করা হয়, অ্যালগরিদম বুঝে ফেলে সে কী ভাবছে। প্রেসলি এই কারণেই বলেন, গোপনীয়তা আইন বা প্রযুক্তির বিষয় নয়, বরং একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা—যেখানে আমরা স্বীকার করি, কিছু জিনিস জানার দরকার নেই, কিছু প্রশ্ন না করাই শ্রেয়, কিছু মানুষকে কেবল তাদের রহস্যময়তায় বাঁচতে দেওয়া উচিত।
‘জীবনে কিছু সময় থাকা দরকার যেখানে কেউ ডেকে বলবে না, ‘আপনি এখন কী ভাবছেন?’ এই সময়টুকু হতে হবে একান্ত নিজের। যেখানে চিন্তাগুলো গুছিয়ে বসতে পারে, স্মৃতিগুলো নিজের মতো করে তৈরি হতে পারে।’’ একজন মধ্যবয়সী মানুষ নদীর ধারে বসে আছেন, তার সামনে ঝিরঝিরে বাতাসে দুলছে কিছু কাশফুল। কেউ আসেনি খোঁজ নিতে, তার ফোন বন্ধ, কোনো ট্র্যাকিং নেই। সেই মুহূর্তে তিনি নিজেকে সবচেয়ে বেশি জীবন্ত মনে করেন।
প্রেসলির বক্তব্য এখানেই গুরুত্বপূর্ণ—এই ধরনের মুহূর্তগুলোই প্রকৃত স্বাধীনতা তৈরি করে। আমরা যতই ডিজিটাল সংযুক্তির ভেতর থাকি, ততই নিজেকে সংরক্ষণের জন্য এই ‘নিঃশব্দের শৈল্পিকতা’ দরকার। কারণ কিছু কিছু চিন্তা কেবল একাকী থাকলেই গভীর হয়, কিছু কিছু আবেগ শুধু তখনই সত্যি হয়, যখন কেউ তার বিশ্লেষণ করে না। গোপনীয়তার এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শেখায়, কেবল দেখানোর জন্যই সবকিছু থাকা জরুরি নয়—কিছু কিছু জিনিস না দেখানোর মধ্যেই তাদের প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে।
লোউরি প্রেসলি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগ এবং ম্যাককয় ফ্যামিলি সেন্টার ফর এথিকস ইন সোসাইটিতে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। তার লেখা Los Angeles Review of Books, The Point, Political Theory, এবং Public Books-এ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি তিনি The Right to Oblivion: Privacy and the Good Life শিরোনামে একটি বই লিখেছেন, যেখানে তিনি গোপনীয়তার নৈতিক ও দর্শনগত দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন।