ইতিহাসের আলো-আঁধারিতে শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ কোনো ‘ঐতিহাসিক’ উপন্যাস নয়—কম করে তিন কেজি ইতিহাসের বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা, তিনপাতা জলে ভেজানো নোট থেকে মুখ তুলে ইতিহাস রচনা করার হুজুগে যারা অভ্যস্ত, তারা এখ
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’—উপন্যাসটার শিরোনাম শুনেই কেউ কেউ ভাবতে পারেন এটা বুঝি কেবলই কল্পনার খেলা। কিন্তু না, সময়টা ১২০৪ সাল। ইতিহাসের এক বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে লেখা, এই কারণেই তাকে ঐতিহাসিক বলতেই হচ্ছে।তখন আর যাই হোক, কেউ ‘দেশপ্রেম’-এর গান গাইত না, “পূর্বজদের গৌরব” দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজত না। তবে লেখক শওকত আলী বুঝেছিলেন, আলো আর অন্ধকারের মাঝামাঝি সময়টাই সবচেয়ে নাটকীয়। নামটাও তাই ‘প্রদোষকাল’—যখন সূর্য একবার ‘গুডবাই কাব্য’ লিখে ফেলেছে, কিন্তু চাঁদ তার মেকআপ সেরে স্ন্যাপচ্যাটে ঢোকেনি।
১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজি বাংলায় এসে ঢুকলেন, ঢুকেই লক্ষণ সেনকে ‘রাজা আউট” করে দিলেন। কেউ কেউ ভাবলেন—“বাপরে মুসলমান এল!”, কেউ কেউ গলা নামিয়ে বললেন—“আরে ভাই, নতুন ম্যানেজমেন্টে হয়তো কিছুর উন্নতি হবে।” এই দুপক্ষের টানাপোড়েনেই উপন্যাসটা। মানে, কেউ সন্ধ্যা দেখে ভয় পেল, কেউ প্রভাত দেখে হাঁফ ছাড়ল। এই হল ‘প্রদোষ’—না আলো, না আঁধার, মাঝখানের বিষণ্ণ আলাপ।
আর চরিত্ররা? দিনাজপুর-আত্রাই-পুন্ড্রবর্ধনের মত গ্রামাঞ্চলের, যাদের মাথায় তখন নেটওয়ার্ক নেই, তবে ষড়যন্ত্র তুঙ্গে। মুসলিম শাসন মানে কী হবে? খাজনা বাড়বে না কমবে? ঈদের সময় শঙ্খ বাজানো যাবে তো? প্রশ্নের পাহাড়, উত্তরের ধ্বংসাবশেষ। শওকত আলীর প্লট হল সাধারণ মানুষ—তাদের দোলাচল, কাপুরুষতা, সাহস, এবং ফিসফিসে গুজব।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ কোনো ‘ঐতিহাসিক’ উপন্যাস নয়—কম করে তিন কেজি ইতিহাসের বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা, তিনপাতা জলে ভেজানো নোট থেকে মুখ তুলে ইতিহাস রচনা করার হুজুগে যারা অভ্যস্ত, তারা এখানে এসে টেস্টপেপারের গন্ধ পাবেন না। মানে, যেরকম ঐতিহাসিক উপন্যাসে ধোপদুরস্ত চরিত্র থাকে—সুনীলবাবুর ‘সেই সময়’ বা ‘প্রথম আলো’ জাতীয় গুচ্ছগুচ্ছ নায়ক-নায়িকা, রাজা-উজির, মন্ত্রী-মশায়, যাঁদের চুলে জবা-তেল আর কথায় প্রজ্ঞা ঝরে—এখানে সে সবের ছিটেফোঁটাও নেই। ইতিহাসের মহাশয়ও এই বই পড়ে কপাল কুঁচকে বলবেন, “ভাই, রেফারেন্স কই?”
লক্ষণ সেন আছেন ঠিকই, কিন্তু সেই “আছেন” মানে গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স। আর তার রাজসভার হলুয়াধ মিশ্র মশায়—এই নামটাই শুনে মনে হয় যেন একাধারে ক্যাটারিং সার্ভিস দেন, আবার সাহিত্যচর্চাও করেন—তিনি একটি বই লিখেছেন, নাম ‘সেকশুভোদয়া’, যেটা পড়লে বোঝা যায় তখনকার দিনে মানুষ কী খেতেন, কী ভাবতেন, আর কী নিয়ে অকারণে আতঙ্কিত হতেন।
কিন্তু এই উপন্যাসে নায়ক-নায়িকা কারা? ইতিহাস যাদের ধুলো চাপা দিয়ে রেখেছে—শ্যামাঙ্গ, লীলাবতী, বসন্তদাস, মায়াবতী, মিত্রানন্দ... শুনলেই মনে হয় এরা কেউ মুদির দোকানের তালিকা না, তো হারিয়ে যাওয়া পুজোর মঞ্চের চরিত্র। কোনো রাজমুকুট নেই, নেই মন্ত্রীসভার এজেন্ডা, নেই অতীত গৌরবের ঢাক। আছে শুধু কাঁধে লাঙ্গল, হাতে কুমারচাক, পিঠে সংসার আর মাথায় শঙ্কা। কেউ ক্ষেত চষে, কেউ মাটির হাঁড়ি বানায়, কেউ কাঁসার থালায় ভাগ্য দেখে।
ইতিহাস বলে, “আমি বড়লোকদের কথা লিখি।” শওকত আলীর এই উপন্যাস বলে, “তুমি যা খুশি লেখো, আমি বরং সেই লোকগুলোর গল্প বলি, যারা ইতিহাস লেখার সময় পাশে দাঁড়িয়ে শুধু ধুলো ঝেড়েছে।”
গ্রামের হাটে হাটে, ধানের গোলায় আর পুকুরপাড়ে এখন একটাই হাল্কা ভয়ে-ভেজা গুজব: পশ্চিম থেকে যবন আসছে। না, ইনফ্লুয়েঞ্জা না, ইনভেডার। সেন সাম্রাজ্য নাকি এবার “আলবিদা”, এবং তার বদলে নতুন ‘ম্যানেজমেন্ট’ ঢুকছে—এক প্রকার ‘রাজনৈতিক কন্ট্রাক্ট ফর চেঞ্জ’।
তবে মজার ব্যাপার, লোকজন খুব একটা শোকপত্র লেখেনি। কেউ কেউ বরং খুশি, এক প্রকার ‘সামন্ত লুটে-পুটে খেল, এবার তোদের পালা শেষ’। কারণ, এই দেশের হাই ক্লাস—মানে, ‘মহাসামন্ত-মহারাজা-দেবতা’—তাদের নির্যাতন কনসালটেন্সি চালাচ্ছিল এতদিন। নিচু জাতের ডোম, মুচি, ক্ষেত্রকর—এদের ওপর অত্যাচারের অ্যাকশন প্ল্যান ছিল চমৎকার ফাইলবন্দী। এখন তারা ভাবছে, “যদি যবন আসে, হয়তো ব্রাহ্মণ্যতার এই মহাপিশাচ থামবে।”
এখন, গ্রামের লোকেরা ততটাও সরল না—‘নতুন শাসক মানেই মুক্তি’, এই বিজ্ঞাপনেও তারা বিশ্বাস করে না। তারা জানে, সামন্তদের জায়গায় আসবে নতুন শোষক, হোক সে নামাজি কিংবা সূর্যবন্দি। তারা শুধু এইটুকু দেখেছে—যবনদের ধর্মে কোনও ‘মুচি তোমার চটি ছুঁয়েছে বলিয়া গঙ্গা ডুব দাও’ সংস্কৃতি নেই। আবার তারা প্রতিরোধও জানে, যদিও সেটা টুকরো টুকরো, ইচ্ছে আছে, কনসেন্ট নেই।
এদিকে উচ্চবর্ণের ভদ্রলোকদের মুখে কিন্তু দুশ্চিন্তার ছিটেফোঁটাও নেই। কেন? কারণ তারা জানে—রাজা গেলে কী হয়েছে, দপ্তরের ঝাঁপি কিন্তু বদলায় না। আমলারা তো কালি দিয়ে নয়, কৌশলে শাসন করেন। হোসেন শাহ হোন, আকবর হোন, সিরাজ হোন—মন্ত্রীদের তো কেতা সেই এক, কালি বদলায়, কলম বদলায় না। আর এই হুজুগের মধ্যে লক্ষণ সেনের মন্ত্রী হলায়ুধ মিস্ত্রী—এক ধরনের সিনিয়র ব্যুরোক্র্যাট-কাম-দার্শনিক—বলে ফেললেন অমর বাক্য—
‘আমার বিশ্বাস, যবনদের আগমনে ধর্ম বলো, জাতি বলো, সমাজ বলো, কোন কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তারা যদি এদেশ জয় করে নেয়, তাহলে তাদের নিশ্চয়ই এদেশ শাসন করতে হবে। সামন্ত বলো, মন্ত্রী বলো, সেনাপতি বলো, এমনকি গ্রামপতি বীথিপতি বলো—এদের সহযোগিতা ব্যতিরেকে কি রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব? সুতরাং অহেতুক তোমার দুশ্চিন্তা। যবনরা যদি আসে, তখনো দেখবে তাদের উচ্চশ্রেণীর লোকেরা সদ্ভাব করছে আমাদের উচ্চশ্রেণীর লোকদের সঙ্গে। নিচ যে, সে সর্ব অবস্থায়ই নিচই থাকবে।’
এই উপন্যাসের কেন্দ্রে একটাই কথা—জীবন মানেই প্রতিটি সম্পর্ক একটা ভাঙা ল্যান্ডলাইন। সমাজ যখন দেখা না-দেখার মতো দুর্ভেদ্য সংকটে ঢোকে, তখন ব্যক্তি ভাবেন—আমি কি কোনও অ্যাপে ভুল লগ ইন করে ফেলেছি? এটাই ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর নরমে গরমে বলা কথা। সমাজ ভেঙে পড়ছে, শ্যামাঙ্গ, লীলাবতী, বসন্তদাস—তাঁরা কেউই এই অগ্নিকুণ্ডে ঘি ঢালেন না, বরং মাঝে মাঝে বেরোতে চেষ্টা করেন দরজা খুঁজে, আবার একসময় ফিরে আসেন আগুনেই বসে চা খেতে।
জীবন এখানে জ্বলে না, ঝলসে ওঠে না—স্রেফ ধুঁকতে ধুঁকতে ফ্যাকাসে হয়। জীবনের অর্থহীনতা এতটাই উচ্চমাত্রায় যে, সেখান থেকে আত্মহত্যা নয় বরং আত্মানুসন্ধান জন্ম নেয়। তবে চেষ্টাও আছে, মানুষ বাঁচতে চায়—এবং বাঁচার প্রক্রিয়ায় সে সম্পর্ক বদলায়। পুরনো বন্ধন ছিঁড়ে নতুন আলপিনে গাঁথে পরিচয়ের ব্যাজ। কেউ ফিরে যায় পুরনো আত্মীয়তায়—যেমন বসন্তদাস, যিনি মায়াবতীর গর্ভজাত সন্তানের দিকে ফিরে হাঁটে। আবার কেউ কেউ পুরনো প্রেমের শাড়ি খুলে নতুন সংসারের নাইটি পরে ফেলে—যেমন বিবাহিত লীলাবতী, যার ইচ্ছে শ্যামাঙ্গকে নিয়ে জীবনটা নতুন করে সাজানোর। কিন্তু শ্যামাঙ্গ? সে তো হিরো নয়, সে প্রতিকূলতার সামনে এক আধুনিক দর্শক—শেষমেশ মৃত্যুই তার কাছে ‘লগ আউট’ বাটন টিপে দেয়।
এই উপন্যাসে নায়ক-নায়িকার গল্পে পুরুষেরা যেন টাইপকাস্ট চরিত্রে—যেমন ভ্রমর গুনগুন করে, তেমন তারা গম্ভীর, দ্বিধাগ্রস্ত, এবং মাঝে মাঝে পরিণতি-ভীত। কিন্তু মহিলারা? উফ্, যেন সিঁদুর নয়, সাহসের আগুন মেখে বেরিয়েছে তারা। যদি বলি, এই উপন্যাসের মেয়েরাই আসল ‘ন্যারেটিভ চেঞ্জার’।
একটা দৃশ্য মনে পড়ে? এক যবন সৈনিক হাটে এসে মিষ্টির হাঁড়ি থেকে খেয়ে দাম না দিয়ে ‘তালাক’ না বলেই হাঁটা ধরল, তখন এক প্রৌঢ়া (কে বলে বৃদ্ধদের সাহস কম?) রসগোল্লা ফেলে সৈনিকের গায়ে হাঁড়ি ছুড়ে মারেন। সে দৃশ্য দেখে বসন্তদাসও ফিসফিসিয়ে মিত্রানন্দকে বলেই ফেলে—“দ্যাখলি তো বঙ্গবাসিনী কেমন রসগোল্লায় বিদ্রোহ ফোটাল?”
তবে শুধু হাঁড়ির গরমে নয়, এই নারীর প্রতিবাদ এসেছে চেতনার ফ্রাইংপ্যানে ঝলসে। লীলাবতী তার অন্যতম নজির। সে বিবাহিত, কিন্তু তার বিয়ে এমন, স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই, তাই সে নিজের জীবনকে সাজাতে চায়—নয় শুধু প্রেমিকের হাত ধরে ঘোরাঘুরি, বরং সংসার, স্বামী, সন্তান—অর্থাৎ ‘লাইফ উইথ বেনিফিটস’। তাই লীলাবতী বলে ফেলে, একদম স্পষ্ট ও সাহসী কণ্ঠে, “আমি সবকিছু চাই—ছেলে-মেয়ে-সঙ্গী সব। কম হলে আমার চলে না।”এমন দাবি শুনে শ্যামাঙ্গ তো প্রায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে ওঠে, “এত সাহস, কোন ধর্মে পড়েছ তুমি?” তখন লীলাবতীর সেই চাবুকমারা সংলাপ—
‘আমার ধর্ম কোথায়? আমি তা বুঝি নাই। সত্য সত্য আমার ধর্ম বলে কোনো বস্তু আমার ছিল না। যদি ছিল ধরে নিই, তাহলে সে ধর্ম আমার সাথে প্রতারণা করেছে। এমন বিবাহ দিয়েছে যা আমি চাইনি, সে ধর্ম আমার জীবনকে বিপন্ন করেছে, সে ধর্ম আমাকে পিতৃহীন করেছে। বলো, তাকে আমি ধর্ম বলবো?’
এই এক প্রশ্নেই লীলাবতী নিজের ধর্ম, সমাজ, সংসার—সব কিছুর জগদল পাথর এক লাথিতে সরিয়ে দেয়। সে জানে, ‘ধর্ম’ যদি তোমার জীবনকে বোঝার বদলে বোঝা বানায়, তবে তা শুদ্ধ নয়, শাস্ত্র নয়—শুধু শোষণ। অন্যদিকে, পুরুষেরা—শ্যামাঙ্গ কিংবা বসন্তদাস—তারা হাঁটে, ভাবুক হয়, দার্শনিক হয়ে ওঠে, কিন্তু লীলাবতীর মতো বুক ঠুকে বলে না, “আমি চাই।” এই উপন্যাসে নারীই তাই বিবর্তনের অনুঘটক—অথচ তার হাতে নেই কোনও রাজদণ্ড, শুধু আছে হাঁড়ি আর হৃদয়, আর সেই হৃদয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে গনগনে বিদ্রোহ।
এখানে নারীরা শুধু প্রেমিকা বা গৃহিণী নন—তারা একেকজন প্রায় ষড়যন্ত্রকারী, রাজনীতির অঘোষিত এজেন্ট, যাঁদের অফিস ঘর নয়, পূজার কুঠুরি। মন্দিরের দাসীরা—হ্যাঁ, দাসী, মানে যাদের জীবনে না আছে পেনশন, না আছে পরিত্রাণ—তারাও জানে, মন্দিরের প্রতিমা যতই রুপোর বালিশে ঘুমোক, বাইরে দাঁড়িয়ে তারা কেবল রক্ষাকর্তা নয়, কৌশলী। সামন্তর চোখকে ফাঁকি দিয়ে, তারা বিদ্রোহের গন্ধে কাশির ধূপ জ্বালিয়ে দেয়।
তাদের রুটিনে সকাল-বিকেলের প্রণাম আছে, কিন্তু রাতে? রাতে তারা ভিক্ষু আর বিপ্লবীদের বাঁচিয়ে রাখে, যেন গোপনে দেশের রিসেট বাটনে চাপ দিচ্ছে। অথচ তারাই জানে—শাসক পাল্টালেও তাদের পরিচয় ‘পাল্টাবে না’। রাজার নাম পাল্টালেও তাদের ডাকে কেউ ‘দেবী’ বলবে না, বলবে ‘দাসী’। অর্থাৎ, সিস্টেম চেঞ্জ হলেও ওদের অপারেটিং সিস্টেম আপগ্রেড হবে না।
তবু তারা পক্ষে। পরিবর্তনের। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কৃষ্ণা দাসীর মুখে এসে দাঁড়ায় যেন দর্শনের দরজা। সে বসন্তদাসকে বলে—
‘বিদ্রোহ যদি হয়, তাহলে তা হবে কার জন্য, আমার জন্য? বলো? আমাকে কী দেবে এই উপবিপ্লব? আমরা মন্দিরদাসী, আমাদের গৃহ নেই, সরকার নেই, ভবিষ্যৎ নেই তথাপি আমাদের মনে হয়েছে অত্যাচারের অবসান হওয়া উচিত, মানুষের অপমান এবং যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না।’
এই হলো গদ্যের হিরোইন। যে জানে তার লড়াই কোনো জয়ের গ্যারান্টি দেয় না, কেবল ‘না বলা কথা’র প্রতিবাদ করে। শোষণের গর্তে দাঁড়িয়ে সে তারই মতো শত সহস্র মেয়ের নাম না-থাকা বিদ্রোহের কণ্ঠস্বর।
এই উপন্যাসে শাসক বদলের চেয়েও বড় কথা হল—এই দাসীরা ‘আপনি কি চান পরিবর্তন?’ প্রশ্নে ক্লিক না করেই হ্যাঁ বলে দেন। তারা জানে, মুক্তি হয়তো আসবে না, তবু দুর্বলের মুখে প্রতিবাদ মানে ইতিহাসের খাতায় ছোট্ট একটা কালি টেনে দেওয়া—‘তুমি আমাদের ভুলে গেলেও, আমরা তো নিজেকে ভুলি না।’
ইতিহাসবিদদের এক শ্রেণী আছেন, যাঁরা কলম চালান যেন তলোয়ার। বিশেষত মুসলিম জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা একটা তত্ত্ব নিয়ে খুব উৎসাহী ছিলেন, যেটা শুনলে বর্ণ হিন্দুদের ভুরিভোজ হজম হতে চায় না। তাঁদের মতে, পূর্ব বাংলায় ইসলাম এত তাড়াতাড়ি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, কারণ হিন্দু সমাজের ‘বর্ণভেদ’ নামক সামাজিক লকডাউনে অন্ত্যেজ শ্রেণির শ্বাস রীতিমতো বন্ধ হয়ে এসেছিল। তাই তারা মুক্তির জন্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলে মিছিল ধরেছিল। এই তত্ত্বের পায়ে গেঁথে অনেক পিএইচডি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রতিটা স্লাইডে পেছন থেকে কেউ না কেউ উঠে দাঁড়িয়ে বলেছে, “স্যার, একটু বিরতি দিন—ডাউট আছে।”
আর শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন? উপন্যাস হলেও, সে যেন এই তত্ত্বের অজান্তে লাইভ অ্যাক্টিং। কেউ ইতিহাস বানায়, কেউ গল্প বলেন—কিন্তু এখানে ইতিহাসটাই গল্প হয়ে পড়ে। অবশ্য, উপন্যাসটা পড়ে শওকত আলীর ধর্মীয় কোনও ‘গ্লোরিফিকেশন স্কিম’ আছে বলে মনে হয় না। তিনি ইসলামের গুণকীর্তন করেননি, বরং সমাজের কঙ্কালে হাত রেখেছেন।
সেন আমলের সামন্তরা যে সকলেই প্রজাপীড়ক, সে তো উপন্যাসে একপ্রকার মেনুতে লিখে দেওয়া। অবশ্য এমনও প্রশ্ন উঠতে পারে—সব সামন্ত কি এতটাই নিষ্ঠুর ছিল? কেউ কি ফুল দিত না? ন্যায্য খাজনা নিত না? ছিল হয়তো, যেমন প্রতি কৌটায় এক ফোঁটা রুহ আফজা পড়ে যায়। কিন্তু শওকত আলীর গল্পে এই রুহ আফজা নেই—আছে কষা ঘাম, আছে লুট, আর আছে জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি।
আর মজার ব্যাপার, মুসলিম আক্রমণকারীরা শুধু নদীয়া-লক্ষণাবতী গুঁড়িয়ে দিচ্ছে না, সঙ্গে অনেক পুরনো সামন্তও দলে দলে যোগ দিয়ে ‘নতুন চাকরি, পুরনো হিংসা’ সিস্টেমে ঝাঁপ দিচ্ছে। তারা যবনদের লুটে সহায়তা করছে, আবার একইসঙ্গে বৌদ্ধদের ওপর ঝাঁপাচ্ছে। কারণ? হিন্দু সামন্তদের ধারণা ছিল, যবন সেনাবাহিনীর আগমনের পেছনে নাকি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটা ‘গুপ্ত কামনা’ ছিল। ইতিহাসের ফাইল ফুঁড়ে কে কখন কী প্ররোচনা করেছিল, সেটা কে জানে! তবে মজার বিষয়, ভিক্ষুদেরও এখানে এমবিএ করে রাখতে হতো, এমন একটা ভাব।
এইভাবে উপন্যাসটা শেষমেশ দাঁড়ায় ইতিহাসের নিচু সিলিংয়ে মাথা ঠোকা একরাশ মানুষদের কাহিনি হয়ে—যেখানে ধর্ম, রাজনীতি, ও ব্যক্তিগত অপমান সব একসাথে রক্তাক্ত গোলাকার রুটিতে পরিণত হয়েছে। এবং সেই রুটি কে খাবে আর কে পোড়াবে, সেটা নির্ধারণ করছে না ধর্ম, করছে ক্ষোভ আর সুযোগের প্যাঁচপয়জার।
উপন্যাসে লোকজন যা বলেন, তা শুনলে মনে হয় সবাই যেন ব্যাকরণ অলিম্পিয়াডে নাম লিখিয়ে রেখেছে। উদাহরণ স্বরূপ একটা লাইন ধরো—‘দীনদাস তখন মুখ গহ্বরে মৎস্য পেটিকার তৈলাক্ত অংশটি নিয়ে ওষ্ঠদ্বয় সংবদ্ধ করে দক্ষিণহস্তে কণ্টক গুচ্ছ টানতে ব্যস্ত।’ মানে, একটাই কথা: লোকটা মাছের কাঁটা তুলছে। কিন্তু সেটা এমন ভঙ্গিতে বলছে, যেন ডক্টরেট থিসিস দিচ্ছে “মৌখিক যন্ত্রণার শাস্ত্রীয় অনুবাদ” নামে।
তবে একটু সুবিচার করাই যাক। লেখক শওকত আলী তো টাইম ট্র্যাভেল করে ঠিক ৮০০ বছর পেছনে চলে গেছেন। এখন, সেই দূরত্ব যদি ভাষায় না আসে, তাহলে কিভাবে বোঝাবেন যে তখন আর "অতঃপর" শব্দটা তখন ‘তখন’–এর থেকেও গ্ল্যামারাস ছিল? সুতরাং, তৎসম শব্দের এই প্যারা-পারেড হয়তো ইচ্ছাকৃত, যেন পাঠক একবারে সিঁড়ি ভাঙা কণ্ঠে বলে উঠতে পারেন—“আহা, সত্যিই অনেক প্রাচীন!”
কিন্তু তবুও প্রশ্নটা ওঠে—সবাই কি তখন এভাবেই কথা বলত? মানে, মাঠের ধারের ক্ষেত্রকর, মন্দিরের দাসী, সৈনিকের পদচারি, আর রাজদরবারের পন্ডিত—তাঁরা কি ‘ওষ্ঠদ্বয়’ আর ‘কণ্টকগুচ্ছ’ ছাড়া কথা বলতেন না?
এ প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক। কারণ, যদি মেথরের মুখেও ‘বিবর্তিত বর্ণানুক্রমে ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার’ ধ্বনিত হয়, তবে সন্দেহ জাগে—মেথর নাকি সাহিত্য এক্সাম দিতে এসেছে। বাস্তবে, তখনকার নিম্নবর্গের মানুষের ভাষা নিশ্চয়ই ছিল অনেক সরল, অনেক বেশি লোকজ, অনেক বেশি মাটির গন্ধময়।
তবে এ-ও ঠিক, কথ্য ভাষার প্রতিলিপি তৈরি করতে গেলে হয় অতি সরলতা এসে পড়ে (যাতে পাঠকের মনে হয় লেখকই বোধহয় কিছু পারেন না), অথবা এমন একটা কৃত্রিম শুদ্ধতার আড়াল তৈরি হয়, যেখানে সব চরিত্রই যেন বাংলা অভিধানের ঘরজামাই।
শওকত আলী দ্বিতীয় পথ বেছে নিয়েছেন—একটা সুশৃঙ্খল, দণ্ডিধারী, ‘সময়ের ভারে ধূসর’ ভাষার চাষ। এতে করে সময়টা ধরা যায় ঠিকই, কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়—সবাই কি একসুরে এতটা তৎসম হতে পারে? নাকি এ শুধুই আমাদের সাহিত্যিক শ্রদ্ধা, যা অতীতকে বুঝতে গিয়ে অতিরঞ্জনের পোশাক পরিয়ে দেয়? এই উপন্যাসে ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতার নয়, ঘরের কোণেরও। কেউ পুরনো শাসনের বিদায়ে কাঁদছে, যেন নাট্যকার পালিয়ে গেছে। আবার কেউ উল্টোদিকে নেমে সেলাম ঠুকছে, “সাহেব এসেছে!” বলেই। এইভাবে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ শুধুই এক সময়ের ছবি নয়—এ হল, কে কোন আলো দেখে কী ভাবে, সেই গল্প।
This article first published on pratidhwanibd.com