একদিন পৌনে চার বছরের এক খুদে – পরনে নতুন জামা, চোখে একরাশ কৌতূহল – দাদাদের সঙ্গে স্কুলে যাবেই যাবে বলে পাড়ার রাস্তায় হাপুস নয়নে কান্নাকাটি করছে। যেন বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বিক্ষোভ মিছিল শুরু হলো গৃহস্থের উঠোন থেকে। দাদারা চকচকে চেহারা নিয়ে রওনা দিল, খুদেটার বুকের ভেতর থেকে হাহাকার উঠল, সেও স্কুলে যাবে। আর সেই কান্নার মধ্যেই জন্ম নিল ভবিষ্যতের নোবেলজয়ী – হ্যাঁ, তিনিই আমাদের রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু ঈশ্বরও বোধহয় হেসে ফেলেছিলেন। কারণ এই স্কুলজীবন যে শুরু হলো হাজার কান্নাকাটি আর আবদার মেনে, সেটা যে একেবারেই বিপর্যয়ের খাতা। খুদের চোখে স্কুলের ঘর মানে ছিল এক বিশাল খোপওয়ালা বাক্স, যার ভেতরে মানবিকতার কোনো সাইনবোর্ডই ঝুলছিল না। দেওয়ালগুলো যেন পাহারাদার, আর আনন্দ-উৎসাহের সঙ্গে কোনো দূরসম্পর্কও রাখে না। রঙ নেই, সজ্জা নেই, এমনকি ছেলেদের ভালোমন্দ লাগার ভাবনাও নেই—যেন কেউ ইচ্ছে করেই শৈশবকে এক গ্লাস ফোটানো জলে চুবিয়ে দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই পরে লিখেছিলেন—বিদ্যালয়ের ভিতরে ছেলেদের হৃদয়কে আকর্ষণ করার লেশমাত্র চেষ্টা নেই। সোজা কথায়, স্কুল মানে ছিল সরকারি অফিসের আর্কাইভ রুম আর জেলখানার মাঝামাঝি কোনো জগৎ, যেখানে শিশুদের সৃজনশীলতা প্রবেশ করলেই দরোয়ান বাঁশি বাজিয়ে তেড়ে আসত।
এই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কারণে প্রায় দশ বছরের স্কুলজীবনে তিনি পাঁচবার স্কুল বদলেছেন। অবশেষে তিনি বুঝলেন, এই অ্যান্টিসেপটিক পরিবেশে তাঁর মনের রোদ আর বাতাস ধরা দেবে না। তাই স্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে ফেললেন। এই অভিজ্ঞতাই বোধহয় পরে তাঁকে শান্তিনিকেতনের মতো স্কুল গড়তে প্রেরণা জুগিয়েছিল—যেখানে খোপের বদলে আকাশ আছে, পাহারাদারের বদলে আছে জারুল গাছের ছায়া।
আজ, ২২শে শ্রাবণ—রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ দিবস। তাঁর স্মৃতিতে গভীর শ্রদ্ধা।
১৩০ বছর আগের ব্যবসায়ীরা যে বুদ্ধি খাটিয়েছিলেন, তা একেবারেই ‘বাইরে ঠাকুর, ভেতরে বাজার’ ধরনের। ভাবুন তো, গঙ্গার ঘাটে বসে মিষ্টির হাঁড়ি বেচছেন, আর হঠাৎ আপনার মাথায় এল—‘রবীন্দ্রনাথ’ নামটাকে যদি লেবেলে মেরে দিই, খদ্দেররা মিষ্টি নয়, বিশ্বকবিতার কড়াই কিনে নিয়ে যাবে! তখনও তো ঠাকুরদেবতার গায়ে হালকা ধুলো জমেনি, তিনি তখনও বেঁচেবর্তে কলম চালাচ্ছেন। কিন্তু তাতে ব্যবসায়ীর কী! নামটা পেলেই বাজারে সোনার চামচ গজাবে। ফলত, রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্যের পোস্টারবয় হয়ে উঠলেন।
কিন্তু তার চূড়ান্ত পরিণতিটা দেখলে হেসে পেট ফেটে যাবে। বিজ্ঞাপনের রঙ্গমঞ্চে ঠাকুরের নেমপ্লেট দিয়ে বিক্রি হয়েছে শাড়ি, সাবান, শাড়ির কলকারখানা, চা, সুগন্ধি—সব কিছু। তাও মানা যায়। কিন্তু ‘পাগলের ওষুধ’? ভাবা যায়? রবীন্দ্রনাথের নাম দিয়ে মাথার গণ্ডগোল সারানোর প্রতিশ্রুতি! এটা যেন ‘গীতাঞ্জলি’ পড়লেই জ্বর কেটে যাবে, ‘শেষের কবিতা’ গিলে খেলে মৃগী নিরাময়। একেবারে ‘সাহিত্যক ট্যাবলেট’।
আপনি শিয়রে শোয়া রোগীকে শোনাচ্ছেন, ‘দেখো, এই টনিক খেলে শুধু জ্বর সারবে না, সঙ্গে Nobel সম্মানও মিশে আছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? হ্যাঁ, মাঝে মাঝে হঠাৎ করে মনে হবে তুমি পিয়ানো বাজাচ্ছ।’ বাঙালি তখনও ‘নাম বিক্রি’কে লজ্জাজনক মনে করত না। বরং পণ্যের গায়ে রবীন্দ্রনাথ বসানোটা ছিল একধরনের জাতীয় গর্ব—যেন বিশ্বকবিকে হাটে নামিয়ে দিয়ে বলছি, ‘এই নিন, সাহেবরা, আমাদেরও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর আছে।’
আজকের চোখে দেখলে ব্যাপারটা এতটাই অবাস্তব যে মনে হয়, এর পরের ধাপ হয়তো হতো—‘চুল পড়া বন্ধ করতে রবীন্দ্রনাথ তেল’ বা ‘গোঁফ পাকানো ঠেকাতে রবীন্দ্রশ্রী ক্রিম’। আর একটু এগোলে কেউ হয়তো বিক্রি করত—‘বুকফাটা কাশিতে ভুগছেন? সঙ্গে নিন “চোখের বালি” সিরাপ’। বাঙালি তখন থেকেই বুঝে গিয়েছিল, বাণিজ্যের জগতে সাহিত্যিকের নাম মানেই হাটে হিরের ঝলক।