অমর মিত্রের র্যাডক্লিফ লাইন
কেউ কেউ ভাবতে পারেন, এটা ‘দেশভাগ’ নিয়ে লেখা—কিন্তু না, এটা ‘মানুষভাগ’ নিয়ে লেখা।
এই উপন্যাসটা পড়তে পড়তে মনে হয়, দেশভাগ যদি কোনও দিন পি-এইচ ডি করত, তার থিসিস সুপারভাইজার হতেন অমর মিত্র। হ্যাঁ, ঠিক সেই অমর মিত্র, যিনি ছিটমহলের গালভরা বেদনা দিয়ে পাঠককে টানেন, আবার যিনি জানেন, গানের চেয়ে বেশি রাজনৈতিক কিছু বোধহয় বাংলায় আর নেই। 'র্যাডক্লিফ লাইন' উপন্যাসে তিনি ইতিহাসকে রেফ্রিজারেটরের ঠান্ডা শবদেহ বানিয়ে রাখেননি, উলটে তার শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে খাড়া করে দাঁড় করিয়েছেন, সাথে জিন্নার বিলেতি ইংরেজিতে গান না-শোনার জেহাদ দিয়ে।
ঘটনা শুরু হয় এক সভায়, মুসলিম লিগের প্রাদেশিক কাউন্সিলে, যেখানে বাংলার হেলে চাষারা আব্বাস উদ্দীনের গান শোনার লোভে মিটিংয়ে এসেছে—কায়েদ-ই-আজমের বাণী শোনার আশায় নয়। গান হবে না, জিন্না বললেন, কারণ গান অনৈতিহাসিক, গান অবাঞ্ছিত, গান হলো আবেগ, আর এখানে তো ধর্ম আছে, আদর্শ আছে, ভাগের ম্যাপ আছে! কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত চিরকালীন ইতিহাসের যেটুকু সাউন্ডট্র্যাক ছিল, সেটাকেই চেপে ধরল। হাজার হাজার লোক গর্জে উঠল—“আব্বাস উদ্দীনের গান আগে চাই!”
এই অংশটুকুতে যেন অদ্ভুত একটা প্রাক-স্মৃতি তৈরি হয়—যেটা আসবে ১৯৭১-এ। ধর্মে ভাগ করা দেশকে ছিঁড়ে বাঙালি নিজের গান দিয়ে বলে, “না, আমরাও আছি। আমরা শুধু হেলে চাষা নই, আমরা ইতিহাসকেও গান দিয়ে নাচাতে জানি।”
তারপর গল্প এগোয় আঁখি মঞ্জিলের দিকে। ঠিক যেন কোনও বংশীবাদক সেখানে বসে পুরনো বেহালার তার টানছেন। এই মঞ্জিল আসলে এক প্রতীক—পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার জমি-আত্মার অদলবদলের প্রতীক, যেখানে এক মুসলমান পরিবারের জায়গা এক হিন্দু পরিবার নিয়ে নিয়েছে বিনিময়ে, কিন্তু স্মৃতি বিনিময় হয়নি। জমি চলে যায়, কিন্তু পুকুরের মধ্যে ডুবে যাওয়া মেয়ের কান্না, চম্পাকলির খেয়াল, কিংবা “গাড়িয়াল ভাই”-এর প্রতিধ্বনি থেকে যায়।
উপন্যাসের শেষভাগে এসে সেই আঁখিমঞ্জিল ধসে পড়ে—প্রোমোটারের ‘নিরামিষ আবাসনে’র চাপ সইতে না পেরে। এটা শুধু একটি বাড়ির ভাঙন নয়, বরং একটি চিন্তার—যেখানে গণপিটুনি বাস্তব, যেখানে বনবিবি নাম বদলে বনদেবী হয়ে যায়—কারণ মুসলমানদের প্রবেশ নিষেধ। হ্যাঁ, এই যে সংখ্যালঘুদের মুছে ফেলার ঠাণ্ডা কৌশল, সেটাই তো আসল ‘মাস্টারপ্ল্যান’।
আরেক দিকে আছে রব—মুসলিম লিগপন্থী, প্রেতাত্মার মতো ঘোরে। আঁখিতারা, যাকে খুন করা হয়েছিল সম্পত্তির লোভে, সে ফিরে আসে উপন্যাসের ছায়ার মধ্যে। যেন মৃত মেয়েটিই সাক্ষী থেকে যায় উপমহাদেশের ক্ষমতা আর হিংসার তামাশার। “জমি ফেরত দিতে হলে স্মৃতি কোথায় রাখব?”—এই প্রশ্নই যেন শেষতক পাঠকের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বিমল চন্দ্র এই উপন্যাসের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী চরিত্র। প্রোমোটারের থাবায় পড়া এক ক্ষয়িষ্ণু কলকাতার প্রতীক তিনি। প্রাক্তন সহ-সম্পাদক, যিনি জানেন মিথ্যা রিভিউ কীভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করে। তিনি প্রতিবাদ করেন, পত্রিকা ছেড়ে দেন, নিজের সংগ্রহে রাখা বই আর স্মৃতি আঁকড়ে থাকেন। তাঁর প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় নগরায়নের বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার বিরুদ্ধে, এমনকি সাহিত্যজগতের মেকি শুদ্ধতার বিরুদ্ধেও।
উপন্যাসে ইতিহাস আর কুহক বাস্তব মিলেমিশে তৈরি করে এক অনন্য বয়ান। এখানে যেমন জিন্নার নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে গান গাওয়া হয়, তেমনি কোভিডকালে নির্বোধ প্রোমোটাররা নিরামিষ আবাসনের ভেতর করোনাদেবীর উপাসনা করে। বনবিবি হয়ে ওঠেন সুপ্রতিষ্ঠিত এনআরআই সুচরিতার গৃহপরিচারিকা—নাম পাল্টে হলেও বেঁচে থাকা একটি অন্যসত্তার প্রতীক। ভাঙনের পর গড়ে ওঠা সেই "রিভার ভিউ" টাওয়ার ফেটে যায় মাঝরাতে—আবার এক প্রতীক, আধুনিক ভারতের চূড়ান্ত ভ্রান্তির।
এই উপন্যাসের গঠনশৈলী, বিস্তৃত সময়সীমা ও চরিত্রের গভীরতা রীতিমতো বিস্ময়কর। প্রায় এক শতাব্দীর ঘটনাপ্রবাহকে অমর মিত্র এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন যে পাঠক অনুভব করেন ইতিহাস তাঁদের ব্যক্তিগত আখ্যান। প্রতিটি চরিত্র যেন নিজেই একেকটি রাষ্ট্র—কখনও নির্যাতিত, কখনও অত্যাচারী, কখনও ইতিহাসের ভুলের সাক্ষ্যবহনকারী।
অনেকেই গম্ভীর কথাকে ঠাস করে চৌখুপি বসাতে পারেন, অমর মিত্র তা করেন গানে, স্মৃতিতে, এবং ভূগোলে। কেউ কেউ ভাবতে পারেন, এটা ‘দেশভাগ’ নিয়ে লেখা—কিন্তু না, এটা ‘মানুষভাগ’ নিয়ে লেখা।
এই উপন্যাস পড়তে পড়তে মনে হয়, সিরিল র্যাডক্লিফ না হয়ে যদি আব্বাস উদ্দীন দেশের সীমারেখা আঁকতেন, তাহলে মানচিত্রের কোণায় লেখা থাকত—“ও গাড়িয়াল ভাই…”
আর জিন্না সাহেবের বরফঠান্ডা গলায় ভেসে আসত“নো সং। আই সে, নো সং।”তবে ইতিহাস তো জানে, গানই শেষমেশ গলা ফাটায়।