রাগ-টানা, মন-টানা এবং ‘ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার’ নিয়ে দরবার
আবেগ একধরনের ইঞ্জিন। এই ইঞ্জিনে জ্বালানি দিতে গিয়ে কেউ ভাবে না রাস্তায় আগুন লাগছে কি না।
এ বছরের শব্দ বেছে নিতে গিয়ে অক্সফোর্ড সম্ভবত জানত যে প্রথম প্রতিক্রিয়াটাই হবে সেই শব্দেরই নমুনা। আপনাকে একটু খোঁচা দিল, আপনাকে একটু বিরক্ত করল, তারপর সেই বিরক্তিটাকেই পুরস্কার দিয়ে ঘোষণা করল বছরের শব্দ: ‘rage bait’। অক্সফোর্ড বলছে, এ শব্দের ব্যবহার তিনগুণ বেড়েছে। আপনারও নিশ্চয়ই অভিজ্ঞতা আছে। ক্লিকের ফাঁদ আগের যুগে ছিল, এই যুগে আছে মেজাজের ফাঁদ। খালি তফাত হলো, তখন আপনাকে ডাকা হতো “লিঙ্কে ক্লিক করতে”, এখন বলা হয় “মনটা একটু চটিয়ে নাও, তারপরই আসল খেলা”।
আপনি হয়তো নিজেই কয়েকবার ফাঁদে পড়েছেন। এই শিল্প নবীন নয়। এর বাজার-দরও কম নয়। মনুষ্য-মনোযোগ এখন আর দার্শনিকের মতন ভেসে ওঠা মেঘ নয়, বরং বাজারের পণ্য; তার মূল্য ওঠানামা করে চরম মাত্রায়। আজ যা দেখছেন তাতেই ক্লিক, কাল যেটা দেখবেন সেটাতে খেদ। তাই মনকে উত্তেজিত করা একধরনের রুটিন অর্থনীতি। বিপণনকারীরা এই সুযোগে শিখে ফেলেছে যে একটু ধাক্কা দিলে লোক বেশি তাকায়। যত অভিযোগ— তত বিক্রি। অথচ তারা বলছে, ইচ্ছে ছিল না কাউকে রাগানোর, কিন্তু প্রতিক্রিয়াটা কাজে লাগল। অন্যদিকে e.l.f.-এর মতো ব্র্যান্ড বুঝে গেছে, সব রাগ-বাণ ফলপ্রসূ হয় না। ভুল জায়গায় লক্ষ্য ধরলে তা boomerang হয়ে ফিরে আসে। এখানে এক ধরনের নৈরাজ্য দেখা যায়। একদিকে কোম্পানি বলছে, “আপনাদের মেজাজকে আমরা উদ্দেশ্য করে বানাইনি”— অথচ ফল দেখে মনে হয় সেভাবেই বানিয়েছে। অন্যদিকে দর্শক বলছে, “আমাদের রাগটাই গোপন পুঁজির মতো, ওরা সেটা দিয়ে দোকান খুলেছে।”
এই সময়ে মানুষ প্রায়ই নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মানুষ ছোট্ট ঝামেলায় পাশের লোকের উপর ঝাল মুছতে যায়। ইন্টারনেট এই ভঙ্গিটাকে আরও শান দিয়েছে। আপনাকে বিরক্ত করার আগে ভিডিও নির্মাতারা এখন বুঝে নিয়েছে, বিরক্ত মানুষই সবচেয়ে দ্রুত কমেন্ট করে। আর কমেন্টই হলো তাদের টিফিন-বক্স। এটা এক ধরনের সামাজিক রোগ। যেমন স্পিভাকের আলোচনায় ভাষা ও উচ্চারণকে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে, তেমনই rage bait-ও ক্ষমতার রূপ। আবেগ আপনাকে চালাবে, আর কে চালাচ্ছে তা আপনি টের পাবেন না। আপনি ভাবছেন, “আমি চটেছি কারণ ভিডিও খারাপ”— কিন্তু ভিডিওর উদ্দেশ্যই ছিল আপনাকে চটানো। এখানে আপনি দর্শক নন, বরং পণ্য। আর আপনার রাগ হচ্ছে বিজ্ঞাপনের আলো। রাজনীতি, বিপণন, মিডিয়া— সবার জন্যই আবেগ একধরনের ইঞ্জিন। এই ইঞ্জিনে জ্বালানি দিতে গিয়ে কেউ ভাবে না রাস্তায় আগুন লাগছে কি না। rage bait তাই একধরনের জ্বালানি-নীতি।
শেষকথা
অক্সফোর্ডের নির্বাচন তাই মজার। শব্দ বাছাইয়ের নামে প্রতিষ্ঠানটা সমাজের মনস্তত্বের আয়না ধরল। আমরা কী দেখলাম? এ যুগে মানুষের ধৈর্যের সঙ্গে ব্যবসার পুঁজি গুলিয়ে গেছে। ইন্টারনেট, যে ইন্টারনেট নেহাত কন্টেন্টস সার্ভ করেনা, বরং ইমোশন রান্না করে। আর আমরা ভাবছি দাঁড়িয়ে আছি, অথচ আমাদের পায়ের নীচে অ্যালগরিদম-চালিত দোলনা। rage bait একটা শব্দ নয়, আমাদের সমাজের প্রতিবিম্ব,আমাদের সময়ের ঘড়ি যা শুধু টিক টিক করে না; টুং টুং করে আমাদের মেজাজে আঙুলও দেয়।



