রিলকের জন্য শোকগাথা, হিজিবিজি সভ্যতা
এই লেখা পড়া শেষমেশ কেউ ঘুমোতে যাবে, কেউ ইন্টারনেট ব্রাউজ করবে, কেউ রিলকের কবিতা খুলে দেখবে, আবার কেউ একবার দেখে রেখে দেবে, ব্যস্ত জীবনের ব্যাকরণে আটকে যাবে।
রিলকের সঠিক উচারণ বোধহয় রিলকাহ
আকাশের নিচে এক ভার্চুয়াল সভা—পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে জোড়া লাগানো একগাদা মুখ। ওরা সবাই এসে জড়ো হয়েছে কবিতার জন্য, যেন রিলকের পঙক্তিগুলো সময়ের কারাগার ছিন্ন করে ছুটে বেড়াতে পারে। প্যারিস, প্রাগ, কলকাতা, মন্ট্রিয়াল—একটু আধটু বিদ্যুতের ঝলক, স্ক্রিনের টিপটিপ আলো, পৃথিবীর ম্যাপ ভরে উঠছে মানুষের নীরব সম্মতিতে। কেউ বসে আছে কাঠের চেয়ারে, কেউ আকাশপানে তাকিয়ে, কেউ পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভাবছে—রিলকের কবিতা কি এখনো জীবন বাঁচাতে পারে? মানুষ এখনো নিজেকে ছুঁয়ে দেখতে পারে একাকী সন্ধ্যার আলোয়? নাকি সবই বিজ্ঞাপনের প্যাকেটে বন্দি, মহাজাগতিক মুদিখানা?
রিলকে কি আমাদের ভেতর বাস করেন? নাকি আমরা কেবল পরস্পরের ছায়া নিয়ে খেলছি? সভার লোকজন বলে, জীবন কেবল বাহ্যিক ঝঞ্ঝাট নয়, ভেতরের গভীর এক গুহা, যেখানে নিজেকে লুকিয়ে রাখা যায়, যেখানে সময় নেই, হাহাকার নেই, যেখানে কবিতার শব্দগুলো আত্মার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়। এই তো সেই আশ্রয়, যেখানে বসে বসে রিলকে একদিন লিখেছিলেন—"তোমার একাকীত্বের চাষ করো, একদিন তা স্বর্ণমুদ্রা হয়ে ফিরবে!" এক মুহূর্তের জন্য সবাই থমকে যায়। তারা কি সত্যিই প্রস্তুত একাকীত্বের জন্য? নাকি এই সভাটাও এক প্রহসন, যেখানে শব্দের গায়ে পালিশ করা ব্যাকরণ ছাড়া কিছু নেই?
রিলকে বলেছিলেন, জীবনকে গ্রহণ করতে শেখো। ফুলের মতো খোল, বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়ো। কিন্তু গ্রহণ করার আগেই কি কিছু বর্জন করা উচিত ছিল? "গার্ডেনকে গাও!"(বাগান শব্দটি এখানে বিরক্তিকর)—রিলকের এই কথাটি ঘুরে ফিরে আসে। সভ্যতার ভেতর, নিয়ম-কানুনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে কি কবিতা জন্ম নিতে পারে? নাকি সবটাই হাওয়ার উড়ো রঙ?
"তোমরা এখনো রিলকের কথায় ডুবে যেতে পারো?"— "ডুব দেওয়া এখন বিলাসিতা।" জীবন সুন্দর, কবিতা অনন্ত; সবই ফাঁকি, সবই বিকিয়ে গেছে স্টকের দামে।
রিলকের কবিতা কি আজও মানুষকে টেনে আনে? তার "Duino Elegies" আর "The Sonnets to Orpheus" কি এখনো আত্মাকে খুলে দেয়, নাকি সবই এক বোতলজাত শোক, যা সাহিত্য সমালোচকদের মুখস্থ আবৃত্তির তালিকায় বন্দি? কেউ কেউ বলছে, রিলকে আসলে বিশুদ্ধতায় বিশ্বাসী ছিলেন, আবার কেউ বলছে, কবিতার বিশুদ্ধতা এক ধাপ পিছিয়ে এখন বাজারের নতুন মুদ্রা।
রিলকের কল্পনার ঈশ্বর উঠে আসে। সেই ঈশ্বর যিনি চার্চের নয়, পাথরের নয়, শূন্যেরও নয়, বরং প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত নির্জনতায় লুকিয়ে আছেন। কেউ বলে, কবিতা ঈশ্বর হতে পারে, আবার কেউ বলে, ঈশ্বর যদি থাকতেন, তবে রিলকের মতো মানুষকে দুঃখের নিচে পিষ্ট হতে হতো না।—কবিতার সভায় ঈশ্বর? নাকি ঈশ্বরের সভায় কবিতা?
রিলকে কি শক্তির কথা বলেছেন? কিন্তু তিনি তো রাজনীতিবিদ নন, তিনি মিছিলের নেতা নন! "রিলকের ক্ষমতা ছিল গ্রহণ করার ক্ষমতা, শক্তির চেয়ে বেশি শক্তিশালী।" কেউ বলে, "এটা আসলে দুর্বলতার গালগল্প, বাস্তবে টিকে থাকার জন্য বলপ্রয়োগ দরকার, কবিতা দিয়ে কি খিদে মেটে?" রিলকে নিশ্চয়ই এর জবাব দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি কবিতা লিখেই থেমে গেছেন—উত্তর দিতে আসেননি।
শিল্প কি কিছু বদলাতে পারে? রিলকে কি দুনিয়ার কিছু বদলেছেন? না কি তিনি নিজেই বদলে গেছেন ক্রমাগত, নিজেকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে? সভার আলোচনায় কেউ কেউ বলে, কবিতা পরিবর্তনের হাতিয়ার, আর কেউ বলে, কবিতা একমাত্র যা বদলায় তা হলো পড়াশোনার সিলেবাস।
এই লেখা পড়া শেষমেশ কেউ ঘুমোতে যাবে, কেউ ইন্টারনেট ব্রাউজ করবে, কেউ রিলকের কবিতা খুলে দেখবে, আবার কেউ একবার দেখে রেখে দেবে, ব্যস্ত জীবনের ব্যাকরণে আটকে যাবে। আমি বলে যাই, "তোমরা সকলে রিলকের শব্দগুলো বয়ে বেড়াবে, প্রতিদিন একটু একটু করে ঢুকতে দেবে তোমার জীবনযাপনের ভেতর।" হ্যাঁ, তবে শর্ত একটাই—কেউ যেন ভুলে না যায়, কবিতা আসলে কি? কিংবা, কবিতা আদৌ কিছু?