যুগান্তরের মূর্খতা: গুটিকলমে মুছে যাচ্ছে পাঠের পরিশীলন
নতুন মিডিয়া—বিশেষ করে টিকটক আর চ্যাটজিপিটির যুগে—আমরা হয়তো চিন্তা করার ক্ষমতা হারাচ্ছি। ভাবুন, এমন একটা যুগে ঢুকে গেছি যেখানে প্রশ্ন করলেই উত্তর আসে, পড়া লাগেই না। ফলে মানুষের নিজের চিন্তাকে গুলে খ
আপনার মন যদি এখনও ‘ডিজিটাল টিকটিকি’তে কামড় না খেয়েও থাকে, তবে বসে থাকেন। কামড়টা আসবেই। হয়তো এই প্যারাতেই, নয়তো পঞ্চমটায়। হঠাৎই মাথার ভেতরে কিসব চিপঘেরা আওয়াজ বাজবে: “ইমেইলটা একটু দেখি না...”, “ইনস্টাগ্রামে একটা গল্প আছে...”, “চারটা ইমোজি দিয়েছে—মানে কি?”, “চ্যাটজিপিটিকে একটু জিগাই, আঁচিলটা ক্যান্সার কিনা?”
আপনি যদি আমার মতো হন—অর্থাৎ ‘লাইক’ আর ‘ল্যাগ’ এর মাঝে হোঁচট খেতে খেতে, অ্যালগরিদমের গলা টিপে দিব্যি একটা দুপুর কেটে যায়—তাহলে বুঝতেই পারছেন, পড়া ব্যাপারটা এখন ইউরেনিয়াম-সমতুল্য একটা রেয়ার আর্ট।
না না, আমরা একেবারেই পড়ছি না এমনটা নয়। আমরা পড়ি। বহু পড়ি। ইন্সটাগ্রামের ক্যাপশন, টিকটকের সাবটাইটেল, হিংস্র মিম, রাজনৈতিক পোস্টের কমেন্ট, সেই সব “একটা বাক্যেই ভোল পালটে দাও” স্ট্যাটাস। পড়ছি তো, শুধু বইটা পড়ছি না। আর পড়লেও, সে ‘পড়ার’ ধাতুটা হয় ‘স্ক্রল’ নয়তো ‘স্কিম’। হেমিংওয়ের কাব্যিক দাড়ির বদলে আমরা এখন বেছে নিচ্ছি মিমের সরু গোঁফ।
একটা দীর্ঘ লেখা পুরো মনোযোগ দিয়ে পড়ার মধ্যে একটা গঠনমূলক চিন্তার যোগসূত্র তৈরি হয়। পাঠক যখন গভীর মনোযোগে লেখায় ডুব দেয়, তখন তার মাথার ভেতরে পিঁপড়েদের মতো সারি সারি ধ্বনি, স্মৃতি, অনুভব, যুক্তি আর কল্পনার পিঁপড়ে মিছিল শুরু হয়। এই গভীর পাঠের মৃত্যু এখন ক্লাসিকাল সুরের মতোই দুঃখজনক: শুনি বটে, বুঝি কম। আমেরিকান প্রাপ্তবয়স্করা এখন বই পড়ে অর্ধেক পরিমাণে, আর কিশোরদের কথা তো বাদই দিন। তারা এখন বই পড়ার চেয়ে রব্লক্সে দুনিয়া বানাতে বেশি আগ্রহী।
তবু কিছু লোক আছেন, যাঁরা এই সর্বনাশে এক বিশেষ দর্শন খুঁজে পান। তাঁরা বলেন, মানবসভ্যতা আবার ফিরছে সেই আদিযুগে, যেখানে জ্ঞান ছিল মুখে মুখে, চোখে চোখে, এবং রাগে রাগে। ‘ওরাল কালচার’ নামে এক দার্শনিক নস্টালজিয়া প্যাকেজ! ওয়াল্টার ওং নামক এক পন্ডিত বলেছিলেন, যখন মানুষেরা লিখতে জানত না, তখন তারা কথার মধ্যে স্মৃতি রাখত। হোমার যেমন বলতেন—“চটপটে অ্যাকিলিস”, আমাদের যুগে ট্রাম্প বলছেন—“ক্রুকড হিলারি”। একই রকমের খ্যাপাটে কাব্য।
অথচ, লেখার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে একটা মহাজাগতিক পট পরিবর্তন ঘটল। ভাষা আর শুধু কথা নয়—সে হয়ে উঠল এক ধরনের ফ্রিজ। আপনি যা বললেন, তা জমে থাকল। ফলে আপনি বলতে পারলেন এমন কিছু, যা তৎক্ষণাৎ না বোঝা গেলেও পরে এসে কেউ বোঝার চেষ্টা করতে পারল। ভাবুন, এই পৃথিবীতে একমাত্র বই-ই আমাদের ‘সাইলেন্ট কনভার্সেশন’ এর সুযোগ দেয়।
কিন্তু এখন? এখন আমরা সেই প্যালেওলিথিক মানসিকতায় ফিরছি। কিন্তু সেই গুহাচিত্রের স্থিরতা নয়—বরং ১০ সেকেন্ডে ‘লাইক বা স্কিপ’ গোত্রের গুহানৃত্য।
‘ডিজিটাল ওরালিটি’ নাম দিয়ে এই বিষাদকে একরাশ তত্ত্বে ছেঁকে ছেঁকে পরিবেশন করছেন আন্দ্রে মির, ক্যাথরিন ডি, অ্যাডাম গারফিঙ্কেল ইত্যাদি। তাঁরা বলছেন, মানুষের চিন্তা এখন আবার দৃশ্য ও কণ্ঠনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। এতে নাকি গণতন্ত্রের ভোগান্তি হচ্ছে। গভীর চিন্তার অভাবে মানুষ এখন রাগে রেসপন্ড করে, যুক্তিতে নয়। বই পড়ে যুক্তি শেখে না, মিম দেখে শেখে। একটার সঙ্গে ভোটার তৈরির সম্পর্ক আছে, অন্যটার সঙ্গে কনটেন্ট ক্রিয়েটরের ইনকাম। বোঝাই যাচ্ছে, রাজনীতি আর সাহিত্য এখন একই মার্কেট শেলফে ঝুলছে, শুধু দামের ট্যাগ আলাদা। কিন্তু সব দোষ যদি পাঠহীনতার ঘাড়ে চাপানো হয়, সেটা এক ধরনের জ্ঞানীগুণীর আত্মরতিসুখ।
তবু একটা ভয় রয়েই যায়। নতুন মিডিয়া—বিশেষ করে টিকটক আর চ্যাটজিপিটির যুগে—আমরা হয়তো চিন্তা করার ক্ষমতা হারাচ্ছি। ভাবুন, এমন একটা যুগে ঢুকে গেছি যেখানে প্রশ্ন করলেই উত্তর আসে, পড়া লাগেই না। ফলে মানুষের নিজের চিন্তাকে গুলে খাওয়া শুরু হয়, হেঁচকি তো হবেই।
তবে একটা জিনিস ভুলে গেলে চলবে না—এই ‘মেডিয়া-ম্যালাঙ্কলি’ নতুন কিছু নয়। সক্রেটিস নিজেই একবার বলেছিলেন, “লেখা ভুলের প্রতিষেধক নয়, বরং ভুলে যাওয়ার কৌশল।”
তাহলে প্রশ্নটা দাঁড়ায়—আমরা কি আদতে নতুন কোনও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের শিকার, না কি আমরা সেই চিরকালীন বৃদ্ধ বুদ্ধিজীবী, যিনি শুধু চান ‘আজকালকার ছেলেমেয়েরা’ তার ছেলেবেলাটা মেনেই চলুক?
হয়তো উত্তরটা হলো, দুটোই। আমরা ক্ষুব্ধ, কারণ আমরা হারাচ্ছি। কিন্তু এই ক্ষোভটাই প্রমাণ করে, এখনও আমরা মনের গভীরে কোথাও বিশ্বাস করি—একটা ভালো লেখা, একটা সত্যিকারের বই, এখনও সমাজকে বদলাতে পারে।
পড়ে থাকলে কৃতজ্ঞ—মতামত দিন, মন্দ হলে বলুন ভালো লাগেনি। এটাও তো আজকাল একটা মতামত, একশো শব্দের দ্যোতনাও আছে তাতে। লেখাটায় যদি আপনার হৃদকম্পন একটু হলেও অনুভূত হয়—হতেই পারে, তাহলে সাবস্ক্রিপশনের কায়দা আছে দু’রকম—একটা বিনা পয়সার আরেকটা টাকাওয়ালার, যেটা আপনার দয়ার দান। যেটা পারেন, সেটাই দিন, আমি তো এদিকে কিবোর্ড ঠুকে মরেই যাচ্ছি।