শিলার ভেতর গল্প: রিচার্ড শেভার ও রকবুক রহস্য
—শিলাখণ্ডিত এক প্যারানয়িয়া-প্রেমিকের পূজাগাথা
রিচার্ড শার্প শেভার। নামটা শুনলেই মনে হবে, ইনি বুঝি ব্লেড বানান বা CIA-র স্টাইলে মানুষের মানসিকতা ছেঁটে ছেঁটে গোছান। কিন্তু না, ইনি পাথর পড়তেন। না না, ভূতত্ত্ব নয়—বিলক্ষণ পাথর-শাস্ত্র, যেখানে কাঁচা শিলাখণ্ডের গায়ে লুকিয়ে আছে অটলান্টিসের দুঃখ, লেমুরিয়ার লটারি আর পৃথিবীর অভ্যন্তরে গুটিসুটি মেরে থাকা একদল অসভ্য কদাকার দানব, যাদের শেভার আদর করে ডাকতেন “দেরো”।








ভাবছেন—ওনাকে একজন সুস্থ মানুষ বললে আপনি নিজেই অস্বাস্থ্যকর শ্রেণিতে পড়ে যাবেন? ঠিকই ভাবছেন। কিন্তু এ-ও সত্যি যে, ‘Amazing Stories’ নামে একসময়কার হুঙ্কার-দেওয়া পত্রিকা তাঁর লেখায় লাল-নীল হয়ে উঠেছিল। মানে সেই ১৯৪০-এর দশকে, যখন মানুষ গ্রামে চিঠি পাঠাতো আর শহরে ইউএফও-র গল্প শুনে চা ফেলে দিত।
এই শেভার সাহেব একটা কথা বিশ্বাস করতেন। একে বিশ্বাস বললে দোষ, এটা ছিল তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য—পাথর মানেই বই। মানে, পৃথিবীর ছত্রিশ ধরনের ইট, পাথর, নুড়ি, শিলাখণ্ডের প্রত্যেকটিতে নাকি চিপ-চিপে চিপ-সেট লুকিয়ে আছে, যার মধ্যে থেকে আপনি ডিকোড করে নিতে পারবেন এক প্রাগৈতিহাসিক সিভিলাইজেশনের আত্মকথা। আপনার কাজ শুধু কিঞ্চিৎ দৃষ্টি-সাধনা আর অর্ধেক হ্যালুসিনেশন দিয়ে তার মানে উদ্ধার করা।
তখনকার দিনে কম্পিউটার না থাকলেও, শেভারের নিজের টাইপরাইটার ছিল—যেটা দিয়ে তিনি দিনের পর দিন বসে পাথরের ছবির পাশে ব্যাখ্যা লিখতেন। ট্যাবলোয়েড ফরম্যাটে। এবং অনন্ত ধৈর্য নিয়ে—অথবা কখনো অদ্ভুত রেগেমুছে—তিনি লিখে যেতেন: এই যে পাথরটার গায়ে তিন নম্বর কোণে যে ছোপটা দেখছেন, এটা আসলে এক প্রাচীন দেবীর উরু, যিনি মানবজাতিকে শাসন করতেন লেজ আর লেজারের সংমিশ্রণে।
একে আপনি পাগলামি বলতেই পারেন। শেভারের পাথরপাঠ অন্তত একধাপ প্রাচীন ও প্রাসঙ্গিক। কারণ ওঁর কাছে বাস্তব ছিল না যা আপনার চোখে পড়ে—বাস্তব ছিল যা পাথরের ভাঁজে ভাঁজে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে হাজার বছর ধরে।
তার ‘রকফোগো’—মানে Rock + Photography + Logos—এক বিশাল আর্কাইভ, যেটা দেখে কেউ বলবে দুষ্টু পাথর, কেউ বলবে দার্শনিক কল্পনা। তিনি ভাবতেন, এই শিলাপত্রসমূহই আসল বিশ্বসংস্কৃতি। বাকি সব, মানে ইউরোপীয় রেনেসাঁ, আধুনিক গণতন্ত্র, বা ট্রাম্পের টুইট—সব “দেরো”-দের দানবীয় প্রভাবের ফল।
জীবনের শেষ দশকে তিনি কারো সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না। চিঠি চালাতেন কিছু ভক্তের সঙ্গে—যারা হয়তো তাঁর মতোই পাথর পাগল, নয়তো আরও খারাপ। তিনি হাতের লেখা বই বানাতেন, কভার-ডিজাইন নিজে করতেন, আর তার প্রতিটি পাতায় প্রাণপাত ব্যাখ্যা দিতেন—যেন মহাভারতের অর্ধেকটা হারিয়ে গেছে আর ওনার রাঁধুনি সেটা পাথরের পাতায় লিখে রেখেছে।
এখন প্রশ্ন—এইসব করা কেন? কেন একজন মানুষ সারাজীবন শুধু পাথর দেখে সময় কাটালেন?
আপনি যদি প্রশ্ন করেন, তাহলে বুঝতেই পারেননি ব্যাপারটা। এর মানে হল, আপনি এখনো ফেসবুক খুলে স্ট্যাটাস লিখছেন “ফুলস্টপের পরে স্পেস থাকবে”—এই রকম দৈনন্দিন ডিজাস্টারে বুঁদ। আর শেভার? তিনি “ফুলস্টপের ভেতর কে বসে আছে”—সেটা জানতেন।
তাঁর কাজগুলো এখন কিছু লোকের কাছে ওয়্যাকো-সায়েন্স, আবার কারো কাছে এক চূড়ান্ত মানবিক আর্তি—ভালোবাসা, অনুসন্ধান, স্মৃতি, ইতিহাস—সব কিছুর মিলেমিশে এক নীরব দর্শন।
Some Stones Are Ancient Books এই বইটাও ঠিক বই নয়। এটা এক অদ্ভুত ধরনের ক্যানভাস, যেখানে টাইপরাইটার দিয়ে আঁকা হয়েছে এক মানসিক মহাকাব্য। যা আপনি না পড়লেও হেরে যাবেন, আর পড়লেও হেরে যাবেন।
কারণ শেভার বলতেন,
“আমি শিলা পড়ি, কারণ পৃথিবী কথা বলে। আর মানুষ কানে তুলো গুঁজে হাঁটছে।”
আবার কেউ বলবেন, উনি আসলে অসুস্থ ছিলেন। মানসিক ভারসাম্যহীন। ঠিক আছে, তাহলে বরং বলুন, পৃথিবীর সবচেয়ে অসামান্য কল্পবিজ্ঞান রচনা হয়েছিল মানসিক হাসপাতালে বসে পাথরের দিকে তাকিয়ে। বলুন না, এটা একরকম মুক্তি।
আর যাঁরা এখনো প্রশ্ন করছেন, পাথরে কীভাবে গল্প লেখা থাকে—তাঁদের বলি,
আপনি যেদিন প্রথম প্রেমপত্র লিখেছিলেন, জানলার ধারে বসে—সেদিন জানালার গায়ে আঙুল বুলিয়ে যদি কেউ তার ছাপ পড়া দেখত, তাহলে সেটা কী ছিল? রকফোগো, না প্রেমফোগো?
এই প্রশ্নই আসল গল্প। আর শেভার ছিলেন তার একমাত্র সাক্ষী।