একটা সময় ছিল যখন দক্ষিণপন্থীরা শুধুই ঠোঁটের কোণে রিগ্যান ঝুলিয়ে রাখত, আর বাকি সবটুকু থাকত ঈশ্বর, বন্দুক, আর বাজারের উপর নির্ভরশীল। তবু আশির দশক পেরোতেই দেখা গেল—যার কোনোদিন দার্শনিক হবু ভাবটুকুও ছিল না, সেই দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবীরা হঠাৎ এক কারাগারে ফিরে তাকাচ্ছে। সেখানে বসে একজন ইতালীয় মার্কসবাদী—অ্যান্টোনিও গ্রামশি—একটা কুচকুচে নোটবুকে লিখে চলেছেন, “রাজনীতি যতটা না সংসদে, তার চেয়েও বেশি ঘটে স্কুলে, গির্জায়, পত্রিকায়, সিনেমায়।” দক্ষিণপন্থীরা শুতে যাওয়ার আগে যে জিনিসটা চারবার গালাগালি করত—‘কালচারাল মার্কসিজম’—তাকেই তারা নিজের ঘরে টেনে আনল, বাথরুম পরিষ্কার করল, তারপরে সেই ভাষাতেই যুদ্ধ ঘোষণা করল। কেউ বোঝে, কেউ শুধু কপি করে।
স্যাম ফ্রান্সিস, এক অবসন্ন রেসিয়াল ন্যাশনালিস্ট, সবার আগে বুঝেছিলেন যে মার্ক্স নয়, গ্রামশিই কাজে দেবে। কারণ মার্ক্স বিপ্লব চেয়েছিলেন শিল্পাঞ্চলে, আর গ্রামশি বিপ্লব কল্পনা করেছিলেন সংস্কৃতির গভীরে, স্কুলের হোয়াইটবোর্ডে, মঞ্চের পর্দায়, যাজকের মুখে। এইখানেই পুঁজিবাদপন্থী বিপ্লবীরা সম্ভাবনা দেখতে পেল—জনগণকে না জিতেও ‘মত’ জিতে নেওয়া যায়।
তবে আসল রূপকথা শুরু হয় প্যারিসে। আলাঁ দ্য বেনোয়া—নব্য ডানপন্থার কালো পর্দার কবি—গ্রামশিকে খণ্ডিত করলেন এক অপার শৈল্পিক নিষ্ঠুরতায়। তার গ্রামশি আর শ্রমিকদের কথা বলেন না। বরং বলেন “ইউরোপীয় সভ্যতা,” “জাতিগত শুদ্ধতা,” “মেটাপলিটিক্স।” গ্রামশি যদি বলতেন ‘মুক্তির জন্য সংস্কৃতি দরকার’, দ্য বেনোয়া বললেন—‘সংস্কৃতির জন্য জাতি দরকার।’ তার এই মেটাপলিটিক্স মানে সোজাসুজি কিছু নয়—ভোট নয়, ভাবনা; বক্তৃতা নয়, বই; পার্লামেন্ট নয়, পডকাস্ট। এবং সবশেষে, নব্য ডানপন্থার নিজস্ব অপেরা হাউস বানিয়ে ফেলা, যেখানে সুরটা বড্ড চেনা, শুধু রচয়িতার নামটা বদলে গেছে।
এই যে ‘রাইট গ্রামশিয়ানিজম’—এটা মূলত এক ধরণের ঠকবাজি। এক সময় যারা “কালচারাল মারক্সিজম” বলে কান্নাকাটি করত, তারাই এখন গ্রামশির চামড়া পরে সভ্যতার পুনর্নির্মাণের কথা বলছে। ব্রাজিলে অলাভো দে কার্ভালিও, ফরাসি প্রেক্ষাপটে মারিওন মারেশাল, এমনকি আর্জেন্টিনার হাই-অকটেন চিৎকারী প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলে—সবাই এক ধরণের গ্রামশি পড়েছেন। না, তিনি কী বলেছেন তা বোঝার জন্য নয়, বরং তিনি কীভাবে বলেছেন সেটা চুরি করার জন্য।
এখানে কেউ ‘প্রলেতারিয়েত’ বলে না, বলে ‘পিতৃতন্ত্র।’ কেউ ‘বিপ্লব’ বলে না, বলে ‘ঐতিহ্য রক্ষা।’ আর কেউ ‘বুর্জোয়া সংস্কৃতি’ নিয়ে কথা বলে না, বলে ‘ওয়াক কালচার ধ্বংস করতে হবে।’ গ্রামশির ভাষা—ভোকাবুলারি—তাদের নিজের মত করে দখল করেছে। মানে, তিনি একজন দর্শন-দূষিত সাহিত্যের লোক ছিলেন, এখন তিনি হয়ে উঠেছেন ইউটিউব ইনফ্লুয়েন্সারদের জন্য স্ট্র্যাটেজিক সাউন্ডবাইট।
জার্মানিতে থুলে সেমিনার, ফ্রান্সে GRECE—এইসব প্রতিষ্ঠানগুলো ভাবল—কথা দিয়ে জয় আসবে, পোস্টমডার্ন কেতা দিয়ে রাষ্ট্রের মুখ বদলানো যাবে। আর তারা করেও ফেলল—একটা সংস্কৃতি তৈরি করল, যা রিকশাওয়ালার নয়, পডকাস্টারদের। বই বেরোল, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গড়ল, “রেনেসাঁ চাই” বলল, এবং একইসঙ্গে গণতন্ত্রকে ‘অতিমূল্যায়িত ইউরো-লিবারাল ভ্রান্তি’ বলে বাতিল করল।
তবু প্রশ্ন থাকে—এইসব হাইব্রো ট্র্যাজেডি আর গ্রিক মিথোলজি ঠাসা ক্যাননে আদৌ কিছু হল কি? আমেরিকায় ট্রাম্প এল, চিৎকার করে বলল “We’re taking back the culture!” আর সেই সময়ে দেশজুড়ে LGBTQ স্বীকৃতি বেড়ে গেল, তরুণরা মর্সি করে আর ‘পরম্পরা’কে মানলো না। ভারতেও মোদির ভার্সন অফ হিন্দু পুনর্জাগরণ দেখতে গিয়ে দেখা গেল—ফ্যাশন, সিনেমা, টিন্ডার, আর রান্নাঘরের ইউটিউবই শেষ কথা।
কেন? কারণ সংস্কৃতি এমন কিছু নয় যা স্লোগানে চলে। সংস্কৃতি চালায় জিজ্ঞাসা, বদলায় অভ্যাসে, আর ফল দেয় এক প্রজন্ম পরে। এই যে ‘কালচারাল হেগেমনির’ (হেজেমনি পড়বেন না) গল্প—গ্রামশির মূল কথাটা কোথাও হারিয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘সংস্কৃতি আর শ্রেণির দ্বন্দ্ব আলাদা নয়।’ আপনি বই লিখে মানুষকে যতোই “ঐতিহ্য” মনে করান না কেন, যদি তার চাকরি না থাকে, যদি তার চিকিৎসা না হয়, সে একসময় আপনাকে বেছে নেবে না।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি আর ইউরোপীয় ফ্যাসিস্ট রেনেসাঁর মধ্যে কেবল ভূগোলটাই আলাদা। ভারতে মোদি, বাংলাদেশে ‘বিজয়’ নামের রাজনৈতিক পর্দা, আর পাকিস্তানে ডান-বাম দোলাচল—সব জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে, গ্রামশির ভাষার ছায়া। “সংস্কৃতি” এখন ক্ষমতার নতুন মুদ্রা, “ঐতিহ্য” এখন নয়া জাতীয়তাবাদের মুখপত্র।
ভারতে RSS স্কুলের পাঠ্যক্রমে ঢুকে পড়েছে—‘ভারত’ এখন ‘ঋষি-মুনি-গোরক্ষা-অকৃত্রিম-স্বর্ণযুগ’-এর নিরবিচারে সংকলন। ঠিক যেমন গ্রামশি বলেছিলেন, শিক্ষা হচ্ছে রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রধান পরিসর, সেই কথা RSS যেন ধর্মীয় ভাষায় রূপান্তর করে ফেলেছে। তফাৎ শুধু এতটুকুই—গ্রামশি যেখানে নিপীড়িতদের ইতিহাস চাইতেন, এখানে ইতিহাস একরকম বৈদিক কল্পনার মহাকাব্য হয়ে গেছে, যেখানে দলিত আর মুসলিম শুধু চুপচাপ দর্শক।
বাংলাদেশে আবার গ্রামশির নাম কেউ উচ্চারণ করে না, তবু তার ছায়া রয়েছে বাংলা ভাষা দিবসের প্রায়-বাণিজ্যিকীকরণে, বিজয়ের কনসার্টে, আর অনলাইনে ওয়েস্টার্ন কালচার বিরোধিতার হঠাৎ জনপ্রিয়তায়। ‘সংস্কৃতি রক্ষা’-র নাম করে হিজাবের পক্ষে পোস্ট, আবার সেই হিজাবি ইনফ্লুয়েন্সারের রিল-এ নাচা—এটাই মেটাপলিটিক্সের মঞ্চ, যেখানে আত্মবিরোধিতাই হল অ্যাস্থেটিক।
পাকিস্তানেও অবস্থা আলাদা নয়। ওরাও গ্রামশির নাম উচ্চারণ না করলেও, তার ভাষা—“মিডিয়া হাইজ্যাক,” “মুসলিম আইডেন্টিটি,” “পশ্চিমা আগ্রাসন”—সবই গ্রামশির পোস্টমডার্ন সংস্করণ। কিন্তু তাত্ত্বিক স্পষ্টতা নয়, বরং ইমোশনাল ইউটিউবে লাইভই এখন বিপ্লব। ভাষার ভিতর আর কোনও কনসিসটেন্সি নেই—শুধু আবেগ, দেশপ্রেম, আর ঈশ্বরের পোস্টার।
এইখানে এসে দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি যুদ্ধ ও ইউরোপের গ্রামশিয়ানিজম একবিন্দুতে মিলে যায়। উভয়েই ভাবছে—ন্যারেটিভ নিয়ন্ত্রণ করলেই রাজনীতি তাদের হাতে। কিন্তু তারা ভুলে যায়—ন্যারেটিভ ঠিক তখনই বদলায়, যখন মানুষ ক্ষুধার মুখে দাঁড়িয়ে গল্প বদলাতে বাধ্য হয়।
গ্রামশির প্রতি ডানপন্থার আগ্রহ এক ধরণের ব্যর্থ প্রেম। তারা তার চেহারা চায়, তার মন নয়। তারা তার শব্দবন্ধ কোট করে, তার মূল্যবোধ ভুলে যায়। তারা ‘হেজেমনি’ বোঝে, কিন্তু ‘হিউম্যান এম্যানসিপেশন’কে তুচ্ছ করে।
ডানপন্থীরা ভাবে, তারা সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা আরও গোলমেলে। জনগণ এখন জানে—বিপ্লব মানে কেবল টকশো জেতা নয়, মানে জীবন বদলানো। তারা ‘ঐতিহ্য’ ও ‘পুনর্জাগরণ’কে ফলো করে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তারা আর প্রশ্ন করবে না।
গ্রামশি আমাদের শিখিয়েছিলেন—সংস্কৃতি আর শ্রেণি একে অপরের ছায়া। আপনি যদি সংস্কৃতিকে শ্রেণি থেকে বিচ্ছিন্ন করেন, তাহলে সেটা হয়ে পড়ে নিছক ফ্যাশন। আর ফ্যাশন কখনও রাজনীতি নয়—সে ক্ষণস্থায়ী, খামখেয়ালি, আর একেবারেই বিপ্লববিমুখ।
অতএব, যারা গ্রামশিকে পড়ে কেবল যুদ্ধ চায়, তারা হেরে যাবে। আর যারা তার ভাষার গভীরতায় শ্রেণির কান্না শুনতে পায়, তারাই নতুন ভাষা লিখবে—যেখানে জয় মানে কেবল বিজয় নয়, বরং মুক্তির সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়া।
তাই এই ডানপন্থী গ্রামশিয়ানির অন্তঃসার শুন্যতা এখানেই। তারা গ্রামশির কথা শুনেছে, তার তত্ত্ব ধার করেছে, কিন্তু তার লড়াইয়ের জায়গা ভুলে গেছে। তারা ভাবে, স্কুলবই জিতলে রাষ্ট্র পাওয়া যাবে। কিন্তু তারা জানে না—স্কুলবই পাল্টায় যারা স্কুল বানায়, যে সমাজ সেটা টিকিয়ে রাখে।
গ্রামশি, শেষ পর্যন্ত, বোধহয় মুচকি হাসতেন। তার তত্ত্ব চুরি হয়েছে, কিন্তু তার যুদ্ধ কেউ চালায়নি।
নোটা বেনে
২৬শে মার্চ, ২০২৫
যথার্থ লিখেছেন