সম্পাদকের বৈঠকে: সাগরময় ঘোষের ব্যঙ্গ, বাস্তবতা আর বোঝার বই
বইটি শুধুই একটি স্মৃতিকথা উপভোগ করা নয়, বরং বাংলা পত্রিকা সংস্কৃতির উজ্জ্বল, ব্যঞ্জনাময়, তবু ধূসর ইতিহাসে প্রবেশ করা। সম্পাদকের বৈঠক যেখানে মঞ্চের পেছনের আলাপটাই আসল না নাটক।
একটা ভালো পত্রিকা প্রকাশের নেপথ্যে ঠিক কতটা গোলযোগ থাকে, তা সাধারণ পাঠকের কল্পনারও বাইরে। আমাদের পাঠ-আনন্দের পেছনে এক গোটা ‘কষ্টের নাটক’ প্রতিদিন খেলা হয়, যেখানে সম্পাদক একাধারে খেলোয়াড়, কোচ, বাউন্সার আর ভ্রাম্যমাণ দর্জির কাজও করে চলেন। সাগরময় ঘোষের সম্পাদকের বৈঠকে সেই নেপথ্য কাহিনিগুলোই আমাদের সামনে মেলে ধরে। তবে কোনো কাঁদুনি গীত নয়—বরং তীক্ষ্ণ কৌতুক, চমকপ্রদ আত্মদৃষ্টি, এবং চাবুক ভাষায় রচিত এক চলমান সাহিত্যিক বিদ্যুৎছটায় মোড়া দলিল।
এই বই শুধু একটি আত্মজৈবনিক টুকরো বা পত্রিকার ইতিহাস নয়, বরং এক সম্পাদকের দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলা সাহিত্যজগৎকে দেখার এক অভিনব ‘ইনার ভিউ’। পাঠক বুঝতে পারেন, ‘সম্পাদক’ শব্দটা আসলে একটা অর্গানিক, অনিয়মিত স্পন্দন—যার সঙ্গে কখনো লেখকের অভিমান, কখনো পাঠকের আবদার, কখনো ছাপাখানার গোঁজামিল আর সর্বোপরি—সময়ের ঝাঁপসা কুয়াশা মিশে থাকে।
বইয়ের শুরুতেই ঘোষ জানিয়ে দেন—এই লেখা একপ্রকার ফাঁদে পড়ার কাহিনি। ‘জলসা’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত ‘সম্পাদকের বৈঠক’ নামক কলামের পাঠকপ্রিয় নির্বাচিত অংশই এই বইয়ের শরীর গঠন করেছে। তবে এসব নিতান্ত আত্মস্মরণ নয়; বরং একধরনের মজার আত্মআলোচনা, যেখানে সম্পাদনার অভিজ্ঞতা জীবনের গল্প হয়ে ওঠে। কখনো নাটক, কখনো ব্যঙ্গচিত্র, কখনো বা একেবারে গভীর গদ্য।
বইটি এগোলে আমরা দেখতে পাই, সম্পাদক হওয়া মানে সাহিত্য-সাগরে ঝাঁপ দেওয়া নয়—বরং একগাদা ছেঁড়া পাণ্ডুলিপির ভেতর থেকে লেখা উদ্ধারের জন্য প্রতিনিয়ত ডাইভ দেওয়া। ২২ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে সাগরময় ঘোষ যেভাবে বলেন, “শেষ মুহূর্তে লেখা না এলে, আমি নিজেই একখানা গল্প লিখে ফেলি, আর লেখকের নাম দিই সেইজনের—যিনি লেখা পাঠাবেন বলেছিলেন কিন্তু পাঠাননি,” তাতে বোঝা যায়, এ এক নিখাদ বাস্তবতার হাস্যরস। এই রকম ‘তালগোল-তবলার’ জীবনের জন্য যে ধৈর্য, স্নায়ু ও কল্পনাশক্তি দরকার—তা অনেক সাহিত্যিকের কাছেও অজানা।
আর আছে শনিবারের আড্ডা। না, এখানে সাহিত্য আলোচনা যতটা হয়, তার চেয়ে বেশি হয় গল্প, গুজব, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, চা-সিঙ্গারা আর লেখক-সম্পাদকদের মধ্যকার গোপন যুদ্ধবিগ্রহ। প্রেমেন্দ্র মিত্রের দুর্ধর্ষ নাক, সুবোধ ঘোষের অলৌকিক প্রুফ সংশোধন, ‘শেষবেলায় লেখা পাঠানোর’ শৈল্পিক স্টাইল—সব মিলিয়ে যেন একটা বোহেমিয়ান চিত্রকল্প। ‘সাহিত্যিক’দের লেখালেখির অভ্যাস যে কতটা এলোমেলো, তা বোঝাতে গিয়ে ঘোষ যেন চন্দ্রিলের সুরে বলে বসেন—“লেখক লিখবেন, তবে কখন, সেটা রাশিফল জানে না।”
সবচেয়ে দারুণ অধ্যায়টি বোধহয় চিঠিপত্র নিয়ে। এমনসব চিঠি আসে, যেন সম্পাদক হোলসেল পণ্যের দোকানি—“কেন আপনি কবি অমুককে ছাপেন, অথচ আমাকে নন?”—এই প্রশ্নের পাশে থাকে খিস্তির ব্যাগ আর প্রশংসার গোলাপজল। এক পাঠক লেখেন, “আপনার কাগজটা পড়ে মনে হয়, বাংলা ভাষা মরেনি। তবে আপনার উপন্যাস ধারাবাহিকটা আরও খারাপ হলেই ভালো হত।” এইসব অপমান-অমৃত নিয়ে কীভাবে এক সম্পাদক প্রতিদিন যুদ্ধ করেন, তার ট্র্যাজিক-কমেডি প্রমাণ এই বই।
সাগরময় ঘোষের ভাষা নিজেই এক অদ্ভুত অলঙ্কার। তাতে আছে বাঙালির আত্মবিদ্রুপের ঐতিহ্য, আছে সম্পাদকের কাঠিন্য, আবার কোথাও আছে নরম আত্মদৃষ্টি। তাঁর গদ্যে ‘গম্ভীরতা’ মানেই এক প্রহসন; এবং ‘ব্যঙ্গ’ মানেই এক গভীর বোধের বহিঃপ্রকাশ। একজন লেখক যখন প্রতিনিয়ত সময়ের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, পাঠকের স্বাদ বদলের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছেন, আর নিজের কাজটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য জায়গায় জায়গায় আপোস করছেন—তখন সেই অভিজ্ঞতা পড়ে মনে হয়, সম্পাদক মানে একধরনের ‘শিল্পযোদ্ধা’—যিনি নিজে থেকে কিচ্ছু দাবি করেন না, কিন্তু পত্রিকার খুঁটিনাটি চিত্রনাট্য লেখেন নিজের ঘাম-জল দিয়ে।
শেষমেশ, বোঝা যায়, বাংলা সাহিত্যজগতে পত্রিকা কীভাবে এক বিকল্প মহাকাব্য হয়ে উঠেছিল—যার প্রতিটি সংখ্যায় কেবল লেখা নয়, একটি যুগের স্পন্দন মুদ্রিত থাকত। সাগরময় ঘোষের কলমে সেই যুগের ছায়া, গন্ধ, শব্দ, কষ্ট আর আনন্দ একসঙ্গে ফিরে আসে। তিনি একসঙ্গে ইতিহাসের দলিলকার, কৌতুকের দার্শনিক, এবং সাহিত্যের নেপথ্য নাট্যকার।
বইটি শুধুই একটি স্মৃতিকথা উপভোগ করা নয়, বরং বাংলা পত্রিকা সংস্কৃতির উজ্জ্বল, ব্যঞ্জনাময়, তবু ধূসর ইতিহাসে প্রবেশ করা। সম্পাদকের বৈঠকে একরকম ‘রিয়েলিটি শো’-এর মতো, যেখানে মঞ্চের পেছনের আলাপটাই আসল নাটক। আর সম্পাদক? তিনি এক সর্বস্বান্ত পরিচালক—হাতের চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, লেখকের মোবাইল বন্ধ, ছাপাখানা ঝাড়খণ্ডে, অথচ প্রকাশনার তারিখ—গতকাল। তবু তিনি বাঁচিয়ে রাখেন সাহিত্যকে—প্রতি সপ্তাহে, প্রতি সংখ্যায়।
বইটি শুধু একটা স্মরণিকা নয়, এটা এক অফিশিয়াল ‘ধাক্কা খাওয়া শিল্প’ নামক পেশার চিরন্তন ট্র্যাজিক কৌতুক। এটা পড়া মানে সাহিত্যের পাশে দাঁড়ানো, সম্পাদক নামক লুপ্তপ্রায় প্রজাতির দিকে একটু কাতর দৃষ্টিতে তাকানো। আর হাসতে হাসতে একটু কেঁদে ফেলা—যদি সেটা আপনি গোপনে করতে পারেন।